হুমায়ূনের স্মরণসভায় কাঁদলেন গুলতেকিন by মাহমুদুল হাসান

এতোদিন পর্দার অন্তরালে ছিলেন তিনি। ৩০ বছর সংসার করা সাবেক স্বামী বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর থেকে নানা জটিলতায় অহেতুক নাক গলাননি তিনি। এজন্যে সবাই প্রশংসা করেছেন তার। শনিবার বিকেলে অভিমান ভুলে হুমায়ূনের স্মরণে নাগরিক শোকসভায় যোগ দিলেন গুলতেকিন খান। এক সময়ের অতি প্রিয়জন হুমায়ূনের স্মৃতিচারণ শুনে দর্শক সারিতে বসে ঝরালেন চোখের জলও।

হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণে শাহবাগে জাতীয় গণ গ্রন্থাগারে শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে নাগরিক এ স্মরণ সভার আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। উপস্থিত দর্শকদের চমকে দিয়ে সেখানে ছেলে নুহাশের হাত ধরে উপস্থিত হন গুলতেকিন। নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ ও বিপাশা আহমেদও উপস্থিত ছিলেন। গুলতেকিনের পাশে বসে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন মুহম্মদ জাফর ইকবালের স্ত্রী ইয়াসমিন হক। তবে এ শোকসভায় প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের বর্তমান স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন ছিলেন না।
হুমায়ূন আহমেদের ছোটভাই বিশিষ্ট লেখক ও বিজ্ঞানী মুহম্মদ জাফর ইকবাল যখন হুমায়ূনের স্মৃতিচারণ করছিলেন তখন নিরবে অশ্রু ফেলতে থাকেন গুলতেকিন। তার চোখে মুখে ফুটে ওঠে তীব্র বেদনার অভিব্যক্তি।

শোকসভায় অবশ্য গুলতেকিন কোনো বক্তব্য রাখেননি,  কথা বলেননি গণমাধ্যমের সাথেও।

অনুষ্ঠানে বরেণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সাংসদ ও অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর, চলচিত্র পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ।

হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু  আসাদুজ্জামন নূর বন্ধুর স্মৃতিচারণ করতে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কান্নার বেগে তিনি কথা বলতে পারছিলেন না।

কান্নাজড়িত কন্ঠেই তিনি  বলেন, “আড্ডার মাধ্যমেই আমাদের সম্পকের্র শুরু। কিছুদিন আগেও যে মানুষটির সাথে আমি নিউইর্য়কে  আড্ডা দিয়ে এলাম আজ সে মানুষটির স্মরণসভা। আমার জীবনে হুমায়ূন আহমেদের অবদান অনেক। `বাকের ভাই` চরিত্রের মধ্য দিয়ে তিনিই আমাকে সর্বপ্রথম মানুষের কাছে (ব্যাপকভাবে) পরিচিত করেছেন।”

আসাদুজ্জামান নূর আরও বলেন. “হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে এমন মধুর সময় কাটিয়েছি যে তা ভুলে থাকা কঠিন। তারপরও তাকে নিয়ে কাটানো আনন্দময় সময়টুকু মনে রেখে শোক ভুলে থাকতে চাই।”

“আমার জীবনের যা অর্জন তার অনেকটাই হুমায়ূনের জন্য,” যোগ করেন আসাদুজ্জামান নূর।

হুমায়ূন আহমেদ স্মরণে প্রফেসর এমিরিটাস ড. আনিসুজ্জামান বলেন , “হুমায়ূন আহমেদকে যে কত মানুষ ভালোবাসে তার প্রমাণ পাওয়া যায় কেন্দ্রীয় শহীদমিনারে যেদিন তার মরদেহ রাখা হয়েছিল সেদিন। সর্বস্তরের মানুষ এসেছিল তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।”

হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিশীলতা নিয়ে তিনি আরও বলেন,“তাঁর লেখনীর মাধ্যমে নতুন পাঠক সৃষ্টি হয়েছিল, চলচ্চিত্র নির্মাণ করে সিনেমা হলগুলোতে দর্শক ফিরিয়ে এনেছিলেন। এমনকি তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোকে তিনি বাস্তব রূপ দিতে পেরেছিলেন, এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় সৃষ্টিশীলতা।”

হুমায়ূন আহমেদের ছোটভাই ও লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, “হুমায়ূন আহমেদ একজন অসম্ভব সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন। তিনি ভালো গল্প লিখতেন, নাটক লিখতেন, সিনেমা বানাতেন, ছবি আঁকতেন, জাদু দেখাতেন।”

তিনি আরও বলেন, “হুমায়ূন আহমেদ চলে যাবার পর যারা আমাদের পরিবারকে বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন তাদের সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা রইল।”

নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে বলেন, “হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন একইসাথে জনপ্রিয় ও মানসম্পন্ন লেখক। তিনি যা সত্য মনে করতেন তা অকপটে বলতেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি সরাসরি যুক্ত না হলেও তিনি বিভিন্ন সময় তার লেখনীর মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে বেগবান করতেন।“

চলচ্চিত্র পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম জানান, “হুমায়ূন আহমেদ তাঁর চলচিত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সঞ্চারিত করেছেন। আগুনের পরশমনি সিনেমা নির্মাণ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছেন।”

তিনি আরও বলেন, “বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে তিনি ’বহুব্রীহি’ নাটকে পাখির মুখ দিয়ে `তুই রাজাকার’ সংলাপ উচ্চারণ করিয়ে রাজাকারদের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছেন।”

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেন, “হুমায়ূন আহমেদ আমাদের মধ্যে চিরদিন তাঁর কর্মের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন। তিনি ছিলেন বিবেকের কন্ঠস্বর, গল্পের জাদুকর ও স্বপ্নের কারিগর।”

আগামী ২০১৩ সালের একুশে বইমেলা যেন তাঁর নামে উৎসর্গ করা হয় সে দাবি জানান সৈয়দ হক। এমনকি  বাংলাবাজারের একটা রাস্তা যেন হুমায়ূন আহমেদের নামে করা হয় সে ব্যাপারে সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানান।

অনুষ্ঠান শেষে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে  হুমায়ূন আহমেদের একটি তৈলচিত্র তাঁর পরিবারে হাতে তুলে দেওয়া হয়।

শোক সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু করে প্রয়াত লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শুরুতেই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.