আলোচনায় বুয়েট সমস্যা নিষ্পত্তি করুন ॥ প্রধানমন্ত্রী-ভিসি প্রোভিসি ও সিন্ডিকেট সদস্য দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে

বুয়েটের শিক্ষক সমিতির সঙ্গে অবিলম্বে আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট সমাধানে সিন্ডিকেটকে নির্দেশ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানা অসন্তোষের মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে উপাচার্যসহ সিন্ডিকেট সদস্যদের ডেকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করুন।


এদিকে চ্যান্সেলর ও রাষ্ট্রপতির কাছে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এসএম নজরুল ইসলাম। একই সঙ্গে বলেছেন, আমি কোন অপরাধ করিনি। ‘অনৈতিক’ একটি দাবির প্রেক্ষিতে পদত্যাগ করা হবে আরেকটি অনৈতিক কাজ। আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতি অনিয়মের যদি একটিও প্রমাণিত হয় তবে আমি সরে যাব। চ্যান্সেলরের কাছে কমিশনের প্রস্তাব পাঠিয়েছি। আশা করি সংশ্লিষ্টরা এখন বিষয়টি বুঝবেন। এদিকে বিচার বিভাগীয় কমিশনের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে তৃতীয় দিনেও অবস্থান ধর্মঘটর ও বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক সমিতির দাবি আগে উপাচার্যের পদত্যাগ তারপরে কমিশন।
জানা গেছে, টানা তিন দিন অসন্তোষের মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন বুয়েট সিন্ডিকেট সদস্যরা। বৈঠকে সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এসএম নজরুল ইসলাম ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সিন্ডিকেটের আট সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা আধা ঘণ্টা গণভবনে ছিলেন। বৈঠক সম্পর্কে উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা সার্বিক বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেছি। ক্যাম্পাসে কিভাবে কাজ করছি, তাও বলেছি। প্রধানমন্ত্রী সব শুনে শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা চালাতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী কোন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন কি না জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব শুনেছেন। পরে হয়ত শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেবেন। বৈঠকে তিনি আমাদের আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। জানা গেছে, শিক্ষকরা কোন আলোচনায় বসার কথা শুনছেন না এমন বিষয় প্রধানমন্ত্রীকে তুলে ধরা হলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁরা যে অবস্থানই নিক না কেন আলোচনায় না বসতে চাইলেও আপনারা আলোচনার পথ বন্ধ রাখবেন না। আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। এর আগে মঙ্গলবার রাতে সংঘর্ষের আশঙ্কায় আগাম ছুটি ঘোষণার পর বুধবার দাবি বাস্তবায়নে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘট শুরু করে শিক্ষক সমিতি। শিক্ষকদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আন্দোলনে যোগ দেয় শিক্ষার্থীরাও। দাবি বাস্তবায়নে স্ব স্ব পদ থেকে গণপদত্যাগের ঘোষণা দেন বিভিন্ন বিভাগের প্রধান ও ডিনরা। এরপর রাতে জরুরী সিন্ডিকেট সভায় সমিতির অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করতে চ্যান্সেলর বা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উপাচার্যের কমিশন গঠনের প্রস্তাব অনুমোদন করে সিন্ডিকেট সদস্যরা বলেন, আশাকরি শিক্ষক সমিতি এখন শিক্ষার্থীদের স্বার্থে শিক্ষাঙ্গন সচল করতে সাহায্য করবে। কিন্তু সিন্ডিকেট বিচার বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিলেও তা প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষক সমিতির নেতারা। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বুয়েটের দিকে বিশেষ নজর ছিল সকলের। বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের প্রস্তাবকে কিভাবে নেবে আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা এই ছিল আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে। তবে বৃহস্পতিবার অবস্থান কর্মসূচীতে আগের দিনের তুলনায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কম ছিল। শিক্ষকদের দাবি অনুসারে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ প্রশ্নে অনেকেই সাংবাদিকদের বলেছেন, আমরা অত শত বুঝিনা। আমরা চাই শিক্ষা কার্যক্রম। কিন্তু আন্দোলনরত অধিকাংশ শিক্ষার্থীই শিক্ষক সমিতির সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেছেন, অবিলম্বে উপচার্য, উপ-উপাচার্যকে পদত্যাগ করতেই হবে। দিনভর ক্যাম্পাসে অবস্থান করে সমাবেশ করেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তাঁরা আন্দোলনের প্রশ্নে অনঢ়। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে শামিয়ানা টাঙ্গীয়ে তার নিচে চলতে থাকে বক্তৃতা, প্রতিবাদী গান ও আবৃত্তি। এদিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন জামিলুর রেজা চৌধুরী ও স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন চৌধুরী। শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কর্মকর্তা কর্মচারীরাও যোগ দিয়েছেন। এই অবস্থায় তাদের অপসারণের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। আর তদন্ত যদি হয়ও, তা হতে হবে তারা পদ থেকে সরে যাওয়ার পর। তাদের অভিযোগ, উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য নিজেরা তদন্তের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা সিন্ডিকেটকে জানিয়েছেন। সভাপতি অভিযোগ করেছেন, বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের বিষয়টি সিন্ডিকেট অনুমোদন করেনি। সিন্ডিকেট সুপারিশ করেনি। এটা কেবল উপাচার্য বলেছেন। কিন্তু কমিশন নিয়ে শিক্ষক সমিতির আনা অভিযোগ সত্য নয় বলে দুপুরে সাংবাদিকদের জানালেন উপচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। নিজ বাসভবনে উপাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, এটা সিন্ডিকেট অনুমোদন করেছে। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোন অবকাশ নেই। সিন্ডিকেট সদস্যদের সঙ্গে কথা বললেও যে কেউ তার সত্যতা পবেন। তিনি বলেন, আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি- অনৈতিকভাবে আমি পদত্যাগ করব না। নৈতিকভাবে আমার বিরুদ্ধে কেন অভিযোগ আনা হয়নি। ১৬টি অভিযোগ প্রমাণের প্রয়োজন নেই। এর মধ্যে মাত্র একটি অভিযোগর যদি প্রমাণ পাওয়া যায় তবে আমি পদত্যাগ করব। বিক্ষোভরত শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের একাংশের পদত্যাগের দাবির প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে কোন অনিয়ম বা বিশৃঙ্খলার অভিযোগ নেই। তাহলে পদত্যাগ করা অনৈতিক হবে। শিক্ষামন্ত্রী বুয়েট বন্ধ করা ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে উপাচার্য বলেন, এটি শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত বিষয়। আন্দোলন ও বিক্ষোভের সময় ক্যাম্পাসে ছিলেন না। তিনি হয়ত ভাবছেন তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। তবে আমি শিক্ষামন্ত্রীকেও জানিয়েছি, আন্দোলন নিয়ে রাতেই দুটি পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছিল। বন্ধ না করলে সংঘাত অনিবার্য ছিল। বিচার বিভাগীয় কমিশন সম্পর্কে অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষকরা যেহেতু-এর আগের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন মেনে নেননি, সে ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনে মত দিয়েছেন। এর পাশাপাশি শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা চলবে। তিনি আচার্যকেও বিষয়টি জানাবেন বলে জানান। বুয়েটের ২৪ জনের পদত্যাগকে অবৈধ ও প্রতীকী বলে উল্লেখ করে উপাচার্য বলেন, এভাবে পদত্যাগ হয় না। একটি কাগজে একযোগে পদত্যাগ হয় না। আর আইন অনুসারে এটা গ্রহণ করারও সুযোগ নেই।
এদিকে জানা গেছে, বুয়েটের পুরো বিষয়টি মনিটরিং করছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী। তিনি শিক্ষক সমিতির সভাপতির সঙ্গে কয়েক দফা কথাও বলেছেন এবং আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের কথা বলেছেন। কিন্তু কোন ধরনের আলাপ আলোচনায় সাড়া না দেয়ায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ ইউজিসি চেয়ারম্যান। সমিতির অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেছেন, এভাবে শিক্ষকরা আন্দোলন করলে কিভাবে চলবে? আলোচনাও করবে না, কথাও শুনবে না এটা ঠিক নয়। আমি শিক্ষকদের বলেছি, তদন্ত করে যা পাওয়া যাবে সেই অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। শিক্ষকরা আলোচনা না করলে কিভাবে সঙ্কটের সমাধান হবে? এমন এক প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, এটা ঠিক। কিন্তু এই ধরনের অসহযোগিতা টাইপের মনোভাব কতটুকু যৌক্তিক। আমি আবারও শিক্ষকদের বলি, কারও শাস্তি চাইলে তার অপরাধ তো প্রমাণ হতে হবে। আলোচনাই যদি না করা হয় তাহলে সমস্যার সমাধান কিভাবে হবে। এদিকে দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পুরো পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন ইউজিসি চেয়ারম্যান।
সূত্র জানিয়েছে, সঙ্কট সমাধানে শিক্ষক সমিতির অসহযোগিতামূলক আচরণে অসন্তুষ্ট প্রধানমন্ত্রী। উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে বুয়েটের শিক্ষক সমিতি এর আগে গত ৭ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের দাবি বিবেচনার আশ্বাস দিলে সমিতি আন্দোলন এক মাসের জন্য স্থগিত করে। পরে শিক্ষক সমিতির দাবি অনুসারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির তদন্ত কমিটি গঠন হয়। কিন্তু তদন্তে উপাচার্যের বিরুদ্ধে কোন অনিয়মের প্রমাণ পায়নি কমিটি। এর পরই দ্বিতীয় দফা আন্দোলন শুরু করে শিক্ষক সমিতি। এদিকে উপাচার্যকে দলীয় বিবেচনায় সরকার নিয়োগ দিয়েছেন সমিতির এমন অভিযোগ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমান উপাচার্যই এই মুহূর্তে বুয়েটের সবচেয়ে প্রবীণ শিক্ষক। এবং বুয়েটের ১৯৬২ সালের অধ্যাদেশ অনুসারে চ্যান্সেলর যে কাউকে উপাচার্য নিয়োগ করতে পারেন। আইন অনুসারে চ্যান্সেলর যে কাউকে উপাচার্যও নিয়োগ করতে পারেন।

No comments

Powered by Blogger.