তাঁহার ফুটবল-দর্শন

ঘরোয়া ফুটবল মৌসুমে সপ্তাহে পাঁচটি করে ম্যাচ দেখেন তিনি। তাঁর মোবাইলে ফোন করলে শোনা যায় ফুটবল ধারাভাষ্যের আওয়াজ। প্রেম করেছেন স্টেডিয়ামে পরিচয় হওয়া এক তরুণীর সঙ্গে।
কী বলবেন তাঁকে! ফুটবলপাগল? এটুকু বললেও থুলানি এনকোবোকে ঠিক বোঝা যাবে না। থুলানিকে বলতে পারেন ‘বিশ্বসেরা ফুটবল-দর্শক’। হ্যাঁ, ১১ জুলাই বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচ দেখার ভেতর দিয়ে এই স্বীকৃতিটাই পেয়ে যাচ্ছেন এনকোবো। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম উঠছে তাঁর এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পূর্ণাঙ্গ ম্যাচ দেখার জন্য।
গিনেসে এর আগে সবচেয়ে বেশি বিশ্বকাপ ম্যাচ দেখার রেকর্ড ছিল ২০টি। সে রেকর্ড এবার অনেক আগেই পার করে এসেছেন এনকোবো। আসলে বিশ্বকাপ শুরুর আগেই অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল এনকোবোর এই রেকর্ড।
‘লাস্ট ফ্যান স্ট্যান্ডিং’ নামের একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সেরা পুরস্কার হিসেবে বিশ্বকাপের ৩৮টি ম্যাচের টিকিট পেয়েছিলেন এনকোবো। তবে এই টিকিট পাওয়াই তো আর শেষ কথা নয়। ৬৪টা (এখন পর্যন্ত ৬২টি) ম্যাচের অর্ধেকেরও বেশি ম্যাচ বিশাল দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে ছুটে ছুটে দেখাটা সোজা কথা না।
সবচেয়ে চাপ গেছে তাঁর ওপর প্রথম পর্বে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চারটি ম্যাচ দেখতে হয়েছে। নেলসপ্রুইট থেকে পোর্ট এলিজাবেথ, কেপটাউন থেকে পোলকওয়ানে পর্যন্ত ছুটে বেড়াতে হয়েছে এনকোবোকে। শুধু গাড়িতে ঘুমানো ছাড়া বিশ্রামেরই সময় পাননি।
স্পনসর কোম্পানির সৌজন্যে স্টেডিয়ামের বাইরে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থেকেছে। একটা খেলা শেষ করেই ছুট বিমানবন্দরে। গাদা গাদা ভিটামিন বড়ি গিলতে হয়েছে অনিদ্রাজনিত অসুস্থতা থেকে দূরে থাকার জন্য। তার পরও মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, ছোটখাটো বিপাকে পড়েছেন।
এই যেমন ফ্লাইট বাতিল হয়ে যাওয়ায় একটা ম্যাচে পৌঁছাতে ৭ মিনিট দেরি হয়ে গিয়েছিল। প্রতিটি ম্যাচ তিনি পুরোটা দেখছেন কি না, এটা দেখার জন্য আবার গিনেস কর্তৃপক্ষের লোক ছিল সেখানে। তাঁদের সাক্ষ্য অনুযায়ী এ রকম সাতটি ম্যাচ তাঁর রেকর্ডে আসবে না। কারণ, কোনো না কোনোভাবে এসব ম্যাচের কিছু সময় মিস করেছেন তিনি।
এনকোবো অবশ্য দাবি করছেন, ‘আমি একটাও ম্যাচ মিস করিনি।’ সে যাই হোক, রেকর্ড যে হচ্ছে, তাতেই মহা খুশি এনকোবো, ‘স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো একটা ব্যাপার। এ রকম সুযোগ জীবনে একবারই আসে।’
এনকোবো শুধু রেকর্ড করার জন্য খেলা দেখে গেছেন, তা না। যেহেতু ফুটবল-পাগল মানুষ, তাই নিজের মতো করে বিশ্বকাপের বিশ্লেষণও করেছেন। তাঁর মতে, দ্বিতীয় পর্বের জাপান-প্যারাগুয়ে ম্যাচটা ছিল সবচেয়ে বিরক্তিকর। ঘানার বিদায় সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার। মেক্সিকোর সমর্থকেরা এনকোবোর কাছে সবচেয়ে আবেগপ্রবণ মনে হয়েছে।
নিজে দক্ষিণ আফ্রিকান সমর্থক বলেই কিনা, শাবালালার করা টুর্নামেন্টের প্রথম গোলটাকে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ বলছেন এনকোবো। উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে পর্তুগালের ৭-০ ব্যবধানে জেতা ম্যাচ দেখে মনে হয়েছে, ‘সরাসরি হাইলাইটস দেখছি।’
ওয়েইন রুনি, কাকা, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোরা ভালো কিছু করতে না পারায় কষ্ট পেয়েছেন। তবে মন ভরে গেছে তাঁর মেসির খেলা দেখে। আর্সেনাল কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারের মতো এনকোবোরও ধারণা, মেসি ভিডিও গেমের চরিত্র, ‘আগে আমি তাকে টেলিভিশনে দেখেছি। কিন্তু ওকে সরাসরি খেলতে দেখলে মনে হয়, প্লে-স্টেশনের চরিত্র। কিংবা মনে হয়, ওকে কোনো মেশিন দিয়ে চালানো হচ্ছে। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ওকে দেখাটা আমার জন্য স্রেফ একটা মহাবিস্ময় ছিল।’
শুনলে মনে হয়, সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো। একটার পর একটা বিশ্বমানের খেলা দেখছেন, গ্যালারিতে বসে মেসি-কাকাদের দেখতে পাচ্ছেন; কী আনন্দ! কিন্তু ত্যাগটা দেখলেন না? এই রেকর্ড করতে গিয়ে খাওয়া-নাওয়া ত্যাগ তো করতেই হয়েছে। একটা মাস ধরে দেখতে পান না তিন বছর বয়সী ছেলেটাকে।
তার পরও এনকোবোর কষ্ট নেই। মধ্যবিত্ত একটা পরিবারের মানুষ হয়ে এতগুলো বিশ্বকাপ ম্যাচ দেখতে পাওয়ার তো তৃপ্তি আছেই, ‘আমি বড়লোক নই। সাধারণ একটা মানুষ। তার পরও কাজটা করতে পারছি। আসলে ব্যাপারটা নির্ভর করে সুযোগ নিতে পারার ওপর।’
সেটা পেরেছেন এনকোবো। নিজে যেমন রেকর্ড করছেন, আনন্দ পাচ্ছেন; তেমনই দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য একটা গর্বের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে—আর কেউ না হোক বিশ্বকাপ ফাইনালে অন্তত একটা লোক থাকবে দক্ষিণ আফ্রিকার পতাকা হাতে!
এমন গর্বের মালিক হতে চান? এনকোবোর সমর্থন পাবেন। তবে শর্ত আছে, ‘আমার চেয়েও আবেগপ্রবণ একজন মানুষ কবে আমাকে চ্যালেঞ্জ করবে, সেদিকে চেয়ে থাকব আমি। কিন্তু তাকে বুঝতে হবে, কাজটা সোজা হবে না। খুব, খুব কঠিন। আপনি যদি ফুটবল-পাগল হয়ে থাকেন, তাহলে আমাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন।’
২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপে একটা চেষ্টা করবেন নাকি?

No comments

Powered by Blogger.