এ যেন বার্সেলোনাই!

এটা এখন জ্বলন্ত সূর্যের মতো সত্য। বিশ্বকাপ শিরোপা সাত দলের মণিহার হয়ে আর থাকতে পারছে না। নতুন কারও গলায় সে উঠছেই। স্পেন বা হল্যান্ড যে-ই ১১ জুলাই জোহানেসবার্গ সকার সিটি স্টেডিয়ামে বিজয়ীর হাসি হাসুক, নতুন চ্যাম্পিয়নকে পাওয়া যাচ্ছেই। কিন্তু একটা পুরোনো বিতর্কের মীমাংসা তবু হবে না। জাতীয় দলের গৌরবের পতাকা উড়িয়েও খেলোয়াড়েরা তাঁদের ক্লাবের আবেগ ভুলতে পারেন না বিশ্বকাপে এসেও। ক্লাব বনাম জাতীয় দল—এই দ্বন্দ্ব যেন অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকবে।
সেদিন সেমিফাইনালে ওঠার পর ডাচ তারকা স্নাইডারের মুখের প্রথম বাক্যটি ছিল এমন, ‘চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের পর বিশ্বকাপেরও ফাইনালে উঠলাম। এটা তো আরও বড় অর্জন।’
কোথায় বিশ্বকাপ, আর কোথায় ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নস লিগ! স্নাইডার তাঁর ক্লাব ইন্টার মিলানের সাফল্যের কথা বলছেন বিশ্বকাপের আগে! কিছুই বলার নেই। যে পেশাদার পৃথিবীর কাছে অর্থের টানটা সবকিছুর আগে সেখানে একজন ফুটবলারের কাছে তাঁর ক্লাবের কথাই মনে পড়ে যাবে সবার আগে। তাহলে তো বার্সেলোনার কথা স্পেন দলটির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হওয়ার কথা। জার্মানির আনন্দ-দৌড় থামিয়ে ফাইনালে ওঠার পর কার্লোস পুয়োলরা বলতেই পারেন, ‘এই তো শেষ ম্যাচটা জিতেই বার্সেলোনার লা লিগা জয়ের মতো হাসি হাসব আমরা!’ তাঁরা তা বলছেন না। তাঁরা বলছেন না, তবে পুরো স্প্যানিশ সমর্থক গোষ্ঠী বা সাংবাদিক সমাজের মধ্যে বার্সেলোনা বার্সেলোনা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে আগেই। বার্সেলোনা-ভিত্তিক কাতালান সাংবাদিকদের পুরো স্পেন দল থেকে আলাদা করে নেওয়া যায়। তাঁরা সংবাদ সম্মেলনে বসেন একটা জায়গায়, মিক্সড জোনে দাঁড়িয়ে যান সামনের সারিতে। স্পেনের এই দলের প্রতি তাঁদের অধিকারই তো বেশি। হিসাব করে দেখুন, স্পেনের ২৩ জনের দলে বার্সেলোনারই খেলোয়াড় ৮ জন। কার্লোস পুয়োল, জেরার্ড পিকে, জাভি হার্নান্দেজ, সার্জিও বুসকেটস, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, পেদ্রো রদ্রিগেজ, ভিক্টর ভালদেস ও ডেভিড ভিয়া। ডেভিড ভিয়া এখনো লাল-বেগুনি জার্সি গায়ে মাঠে না নামলেও তিনি বিশ্বকাপ শুরুর দিন বিশেক আগেই বার্সেলোনার হয়ে গেছেন। প্রথম একাদশের অন্তত ৬ জনই থাকছেন ‘লস ব্লগ্রানা’র। বার্সেলোনার খেলোয়াড়েরাই তো স্পেনকে ফাইনালে তুলে নিতে রাখলেন মূল ভূমিকা। যে ৭টি গোল স্পেনের ফাইনালের সেতুবন্ধ, তার সবগুলোই বার্সেলোনার। যার মধ্যে ভিয়া একাই করেছেন পাঁচটি। আর যাঁর অসাধারণ এক হেডে সেমিফাইনাল পেরোল লা ফুরিয়া রোজারা, সেই পুয়োল তো বার্সেলোনার প্রতীক, বার্সেলোনার আনন্দ-বেদনার সঙ্গী, তাঁর নিঃশ্বাসের নামই বার্সেলোনা।
পরশু জার্মানির বিপক্ষে সেমিফাইনালে ডারবানের মোজেস মাভিদা স্টেডিয়াম পুয়োলের কাছে যেন হয়ে উঠল ন্যু ক্যাম্প। অধিনায়কের বাহুবন্ধনী ইকার ক্যাসিয়াসের হাতে, কিন্তু তিনিই দিলেন নেতৃত্ব। রক্ষণ সামলালেন। মাঝমাঠে উঠে বল দিলেন ইনিয়েস্তা জাভির পায়ে। গোলমুখ খোলা যাচ্ছে না দেখে মাঝেমধ্যেই ওপরে উঠে গোল করার চেষ্টা করলেন। গোলের জন্য মরিয়া বার্সেলোনার হয়ে যেমনটা করেন। অবশেষে ৭৩ মিনিটে স্পেনের ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় গোলটাই করে ফেললেন ধ্রুপদি এক কর্নার কিকে। মাঝারি আকৃতির শরীরটা হাওয়ায় ভাসিয়ে পেরিয়ে গেলেন পার মার্টেসেকার ও সামি খেদিরার নাগাল। তারপর ঝাঁকড়া চুলে মোক্ষম হেড। গোলরক্ষক ম্যানুয়েল নয়্যার তাতে হাত ছোঁয়াতে হলেন অক্ষম। ভাগ্যলিপি লেখা হয়ে গেল জার্মানির। চতুর্থ শিরোপা দূর অস্ত, অষ্টমবারের মতো ফাইনালেই ওঠা হলো না তাদের। অসাধারণ ওই কর্নার কিকটা নিয়েছেন কে? জাভি হার্নান্দেজ, বার্সেলোনার ‘মিডফিল্ড জেনারেল’।
স্পেনের সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা হলে নিশ্চয়ই জানা যাবে, মাদ্রিদের চেয়ে বার্সেলোনায় উৎসবের রং ছিল বেশি। পুরো কাতালান হয়তো আলোকসজ্জা শুরু করে দিয়েছে।
স্পেনের এক সাংবাদিক, নাম সেবাস্তিয়ান, তাঁর দায়িত্ব ছিল আর্জেন্টিনার প্রতিটি ম্যাচ দেখে মেসির ওপর রিপোর্ট করা। মেসি কেমন খেললেন, কতগুলো পাস দিলেন, দলের সঙ্গে কতটা তাঁকে একাত্ম দেখা গেল—এসব নিয়ে। কারণ হলো, মেসি বার্সেলোনা আর কাতালানের নায়ক। এই মেসি যদি স্পেনের নাগরিকত্ব নিতেন, তাহলে কোনো কথাই ছিল না। এই স্পেন আরও বেশি বার্সেলোনা হতো। ফাইনালে মাঠে নামার আগেই হেরে বসে থাকত হল্যান্ড। সারা বিশ্বের মানুষকে যুগ যুগ ধরে ক্লাব ফুটবলের অমৃত উপহার দেওয়া স্পেনের হাতে বিশ্বসেরার স্বীকৃতি জুটতই। ‘জুটত’ এই সংশয় কেন? স্পেনই চ্যাম্পিয়ন হবে। স্পেনের মধ্যে বার্সেলোনা উজ্জ্বল আলো জ্বেলে রেখেছে না!

No comments

Powered by Blogger.