নির্বাচনী ইশতেহার-বহির্ভূত এজেন্ডা by সৈয়দ আবুল মকসুদ

কোনো কোনো অতি ছোট ঘটনা বা অতি অনুল্লেখযোগ্য দৃশ্য কোনো দিন ভোলা যায় না। তেমন একটি ঘটনার কথা আমার আজীবন মনে থাকবে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাস হবে। অর্থাত্ বঙ্গীয় বর্ষাকাল। ট্যাক্সির আশায় কলকাতার আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড দিয়ে হাঁটছিলাম। আকাশ ভেঙে ঝমঝম করে বৃষ্টি এল। দৌড়ে গিয়ে উঠলাম, এক বহুকালের পরিত্যক্ত বাড়ির বারান্দায়। সে দালানের কয়েকটি কামরার ছাদ ধসে পড়েছে। কোনো কক্ষেই দরোজা-জানালার নাম-নিশানা নেই। নানা রকম গাছপালা-গুল্ম গজিয়েছে দেয়ালে-মেঝেতে। এক শ-দেড় শ বছর আগে এ বাড়িতে নিশ্চয়ই কত মানুষ বাস করত। বহুকাল যাবত্ মানুষ নয়, সাপ-ব্যাঙ-বেজিদের বাসস্থানে পরিণত হয়েছে বাড়িটি।
কোনো রকমে বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ছাট থেকে বাঁচার চেষ্টা করছি। হঠাত্ গলা কাশার আওয়াজ পেলাম। একটি ঘরের ভেতরে দৃষ্টি গেল। দেখি, পোড়োবাড়ির ভেতরের এক ঘরে বসে এক ক্ষৌরকার এক লোকের মাথা কামাচ্ছে।
প্রবল জোরে বর্ষণ শুরু হলো। অপরাহ্নেই যেন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এল। একপর্যায়ে দেখলাম, মাথা কামানো শেষে নাপিত পুরো শরীর কামানো শুরু করেছে। নাপিতের ক্ষুর চলতে থাকল অতি নিপুণ হাতে। আমার চোখ ততক্ষণে কপালে উঠে গেছে।
নরসুন্দরের এই বিশেষ কাস্টমারটির হয়তো পরিশুদ্ধ হয়ে পাপমুক্তির প্রাথমিক প্রক্রিয়া ছিল ওটি। মনের মধ্যে যত আবর্জনাই থাক, শরীরের সবকিছু সাফ করে অতীতের পাপ ধুয়েমুছে নদীতে গিয়ে ডুব দিয়ে পরিশুদ্ধ হওয়ার আকুলতা কারও থাকলে দোষ কি?
অনেক দিন পরে ওই ঘটনাটি আমার মনে নতুন তাত্পর্য নিয়ে দেখা দেয়; বিশেষ করে ২৮ পৌষ যেদিন আমাদের দেশে এক গায়েবি সরকারের আবির্ভাব ঘটে। তাঁদের কর্মকাণ্ড দেখে আমার ওই পোড়োবাড়ির সেদিনের দৃশ্য বারবার মনে পড়তে থাকে। তাঁরা জাতির জীবনের যাবতীয় দোষ ও আবর্জনা এক সিটিংয়ে পরিষ্কার করতে চাইলেন। দুর্নীতির লেশমাত্র থাকবে না দেশে, তা নির্মূল ও দমন করতে কমিশন গঠিত হলো। যাঁরা অতীতে দুর্নীতি করেছেন—রাজনৈতিক নেতা, আমলা, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি—তাঁদের পিঠ মোড়া করে বেঁধে জালি দেওয়া প্রিজনভ্যানে নিয়ে তুললেন। দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত রেহাই পেলেন না। ফুটপাতকে ফিটফাট করতে হকারদের লাঠিপেটা করে তাড়ালেন। আইনবহির্ভূত বাড়িঘর স্থাপনাগুলোয় বুলডোজার দিয়ে মারলেন ঠেলা। ধমাধম বাড়িঘর দালানকোঠা ধসে পড়তে লাগল। আকাশচুম্বী র্যাংগ্স ভবনকেও ছাড় দিলেন না। নির্মল আনন্দে সেখানে পড়ল হাতুড়ির বাড়ি। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের আড়াই শ গজের মধ্যে আধা ডজন শ্রমিকের লাশ ঝুলে রইল এক সপ্তাহ। হাজার হাজার বীর বাঙালি সেই দৃশ্য উপভোগ করল রাস্তায় দাঁড়িয়ে। বাঙালি নারীর রাঁধুনি হিসেবে সুনাম আছে, এক কাঁচকলা দিয়ে দশ ব্যঞ্জন তৈরি করতে পারে, কিন্তু সেনা নেতৃত্বাধীন সেই গায়েবি সরকার দেখিয়ে দিল, এক গোলআলু দিয়ে কত পদ রান্না করা সম্ভব। খাওয়ার টেবিলে আলুর আইটেমগুলো দেখে আমাদের মিডিয়া ও সমাজপতিরা বললেন, সোবহান আল্লাহ। একাত্তরের ডিসেম্বরে যে চালের দাম ছিল ৩৮ টাকা মণ, সরকার সেই চাল খাওয়াল ৪২ টাকা কেজি। দক্ষ কুমার যেভাবে মাটি ছেনে পুতুল বানায়, সেইভাবে ওই সরকার পুরোনো নেতৃত্ব বাতিল করে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করতে চাইল। রাশি রাশি টাকা ঢেলে গড়ল নতুন নতুন দল। একপর্যায়ে তাদের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা ছিল, অথবা তাদের সঙ্গে ক্ষমতা শেয়ার করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বাদ সাধল জনগণ। আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকেরা পিছু হটলেন। হঠাত্ তাঁদের মধ্যে গণতন্ত্রের চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটল। বললেন, নির্বাচন দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জোটের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে কোনো রকমে কেঁদে বাঁচো।
গণতান্ত্রিক সরকার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে এ দেশের মানুষের কখনো কখনো, তবে গায়েবি সরকার আমরা দেখেছি বহুবার: ১৯৫৮-তে, ’৭৫-এ, ’৮২-তে এবং ২০০৭-এ। গায়েবি সরকার রাতারাতি অনেক কিছু সাফসুতরো করতে পারে, গণতান্ত্রিক সরকার তা পারে না। কিন্তু বারবার লক্ষ করেছি, আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক সরকারের গুরু যেন গায়েবি সরকারগুলো। গায়েবি সরকারের স্বৈরাচারী ফিলোসফিকেই আদর্শ ও দর্শন হিসেবে গ্রহণ করে নির্বাচিত সরকারগুলো। আর একটি জিনিস লক্ষ করেছি যে গণতান্ত্রিক সরকারের নাভিশ্বাস না ওঠা পর্যন্ত তাদের হুঁশ হয় না। বাহাত্তর-পঁচাত্তরের সরকারের হুঁশ ছিল না, গায়ের জোরে তারা কাজ করা পছন্দ করত এবং তার মূল্য দিতে হয়েছে। ওই সরকারের কুমন্ত্রণাদাতা ও মোসাহেবদের গায়ে আঁচড়টিও পড়েনি।
১৯৯১-৯৬ সরকারের হুঁশ না থাকায় খেসারত দিতে হয়েছিল। ১৯৯৬-২০০১-এর সরকার প্রথম বছর দুই-তিন ভালোই ছিল, তারপর বেহুঁশ হয়ে পড়ে। মূল্য তাকেও দিতে হয়। ২০০১-২০০৬-এর সরকার অতিরিক্ত আসন পেয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ায় খুশিতে বেহুঁশের ঘোরে প্রথম দিন থেকেই গাইতে থাকে: প্রথম বাংলাদেশ আমাদের—শেষ করা পর্যন্তও বাংলাদেশ আমাদেরই। তাদের জুনিয়ার পার্টনারের কাছে গান-বাজনা হারাম, বাংলা গান আরও হারাম। তবু তাঁরা সুর না করে শুধু আওড়ান: বাংলাস্থান, পাকিস্তান, আরব জাঁহা হামারা, সারে জাঁহা আচ্ছা, বাংলাস্থান আচ্ছা। স্বাধীনতা আমরা এনেছি—ক্ষমতায় চিরকাল আমাদের থাকতে হবে। বিএনপি-জামায়াতের বাড়াবাড়িতে বিশ্বায়নের যুগে বিদেশি বন্ধুরাই যে মুখ ভার করল তা-ই নয়, দেশের মানুষও বেঁকে বসল। পরিণাম ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনী ম্যান্ডেট।
মানবজাতির রাজনৈতিক শব্দভান্ডারে কিছুকাল যাবত্ মার্কিনদের উদ্ভাবিত একটি নতুন শব্দ ‘রোডম্যাপ’ যোগ হয়েছে। দুনিয়াটা কোন দশকে কীভাবে চলবে, তার একটা মহা রোডম্যাপ করাই আছে। কোন দেশ কোন সরকারের নেতৃত্বে, কীভাবে চলবে, তার জন্য আছে আলাদা রোডম্যাপ। এবং সেই রোডম্যাপ মোতাবেক না চললে বা সরকার না চালাতে পারলে, কোথাকার কোন সরকারকে কীভাবে টোকা দিয়ে সরিয়ে দিতে হবে, তারও রোডম্যাপ আছে। তারপর কোন গোত্রকে কী প্রক্রিয়ায় রোডম্যাপ বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচনের মাধ্যমে হোক বা গায়েবি প্রক্রিয়ায় হোক, ক্ষমতায় বসাতে হবে, তারও রোডম্যাপ করা আছে। সুতরাং খাতির জমায় বসে থাকার কোনো কারণ নেই। সবই ওপরওয়ালাদের ইচ্ছা। অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল বেনজিরকে সরিয়ে দিয়ে পাকিস্তানে এক রোডম্যাপ বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশে নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে অন্য রকম রোডম্যাপ বাস্তবায়িত হচ্ছে। নেপালে সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল আন্তর্জাতিক রোডম্যাপ মোতাবেক হয়নি, জনগণ মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টিকে বেশি ভোট দিয়ে ফেলে। বৃহত্তম দলের নেতা হিসেবে মাওবাদী নেতা পুষ্পকমল দহল প্রচণ্ড প্রধানমন্ত্রী হন। গণতন্ত্রকে যাঁরা ধর্মশাস্ত্রের মতো পূজা করেন, তাঁরা এক বছরও প্রচণ্ডকে ক্ষমতায় থাকতে দিলেন না, তাঁকে ফেলে দিলেন। তাঁরাই আবার মিয়ানমারের সু চির জন্য সারা রাত জেগে চোখের পানিতে বুক ভাসান। সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক মিয়ানমারের পাশে চীন না থাকলে এত দিনে কতবার যে সেখানে সরকার বদল হতো, তার ঠিক নেই। এগুলোকে বলে রোডম্যাপ। বাংলাদেশ রোডম্যাপের বাইরে নয়।
প্রায় এক বছর হতে যাচ্ছে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। আন্তর্জাতিক রোডম্যাপের সঙ্গে সংগতি রেখে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের একটি নির্বাচনী অঙ্গীকার ও নিজস্ব রোডম্যাপ ছিল। অঘোষিত কিছু এজেন্ডাও নিশ্চয়ই থাকবে। কিন্তু এক বছরে সরকার নির্বাচনী ইশতেহারের চেয়ে ইশতেহার-বহির্ভূত ব্যাপারেই বেশি মনোযোগ দিয়েছে। বিরোধী দল হাত-পা-মেরুদণ্ড ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকায় সরকার নানা রকম এজেন্ডা বাস্তবায়নে বেশি উত্সাহ বোধ করছে। জনগণ জাতিগঠনমূলক কাজই পছন্দ করে, এজেন্ডা বাস্তবায়ন নয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০২১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা তো দূরের কথা, চার বছর পরের নির্বাচনে যে জয়লাভ করা যাবে, সে ব্যাপারে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। শনিবার এক আলোচনা সভায় পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার বলেন, ‘আমাদের মধ্যে অনেকে মনে করছেন, আওয়ামী লীগকে কেউ ক্ষমতা থেকে হটাতে পারবে না। এ ধরনের চিন্তা হঠকারিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা যদি কাজ না করি, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ না করি, তবে আবার ক্ষমতায় আসব—এমন চিন্তা আমি করি না। আমার মনে হয়, সাধারণ মানুষও করে না।’ [ইত্তেফাক]
কাকে উদ্দেশ করে তিনি এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন বলা মুশকিল, তবে সঠিক কথাই বলেছেন। ওই একই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপন ও প্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম প্রশাসনে বিভিন্ন পদে থাকা রাজাকার এবং স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্মকর্তাদের তালিকা দেওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, তথ্য-প্রমাণসহ নাম বলতে পারলে সরকার ব্যবস্থা নেবে।
জনাব ইমাম শান্ত, নম্র ও অমায়িক ব্যক্তিত্ব; প্রশাসনিক ব্যাপারে তাঁর অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের, প্রবাসী সরকারের তিনি ছিলেন একজন নির্ভরযোগ্য কর্মকর্তা। বাংলাদেশের প্রশাসনের নাড়ি-নক্ষত্র তিনি জানেন, তাঁর সমসাময়িক ও সামান্য পরবর্তী কর্মকর্তাদের চরিত্রও তাঁর ভালো জানা। একাত্তরের রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধী কারও পক্ষে কি এখন চাকরিতে থাকা সম্ভব? তাঁরা তো ইতিমধ্যে অবসরে গেছেন। এখন যাঁরা চাকরিতে আছেন, তাঁদের চাকরি জীবনের শুরু আশির দশকে। এখন প্রশাসনে যদি রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধী বলে কর্মকর্তাদের খোঁজা হয়, তাহলে তা হবে হিংসা-প্রতিহিংসার খেলা। এ ঘোষণায় প্রশাসন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।
সমস্যাজর্জরিত দেশে মন্ত্রিপরিষদের অসংখ্য কাজ। কেবিনেট সভায় বড় বড় ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। ১৪ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব করেন, যদিও তা এজেন্ডাভুক্ত ছিল না। নতুন নাম কী হবে—এ নিয়ে উপস্থিত সদস্যরা একাধিক নাম প্রস্তাব করলেও হজরত শাহজালাল (রহ.) নামকরণের ব্যাপারে সব সদস্যই একমত পোষণ করেন। একই সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে যেসব স্থাপনার নামকরণ হয়েছিল, তা আগের নামে ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
নাম পরিবর্তনের নোংরা কাজটি খালেদা জিয়াও করেছিলেন। তাঁর নিজের নামে ও জিয়ার নামে বহু প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের আমলে সাভারে যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নাম করা হয়েছিল শেখ হাসিনার নামে। বিএনপি-জামায়াত সরকার যখন ওই নাম তুলে দেয়, তখন ঘৃণায় আমার রক্তচাপ বেড়ে গিয়েছিল এবং আমি আমার কলামে প্রতিবাদ করেছিলাম। বরিশালে শহীদ জিয়াউর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বদলে বলার কিছু নেই, কিন্তু ‘জিয়া’র নাম পরিবর্তন কোনো রকম যুক্তির মধ্যে পড়ছে না।
১৯৮১-তে জিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর নামে তত্কালীন সরকার বিমানবন্দরের নামকরণ করে। তখন বেগম জিয়া ক্ষমতায় ছিলেন না। জিয়া শুধু সেক্টর কমান্ডার নন। পাঁচ বছর রাষ্ট্রের শাসক ছিলেন। দেশের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর সুনাম ছিল। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের শাসক ও তাঁদের ছেলেমেয়েরা দুর্নীতিগ্রস্ত। ব্যক্তিগত জীবনে জিয়া দুর্নীতির ঊর্ধ্বে ছিলেন। জিয়ার জানাজায় যত মানুষ হয়েছিল, পৃথিবীর কম মুসলমানের জানাজায় তত লোক হয়েছে। প্রতিটি দেশের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস থাকে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১-র ইতিহাস জিয়াকে বাদ দিয়ে হবে না। প্রশাসক হিসেবে তিনি বাংলাদেশের কোনো শাসকের চেয়ে খারাপ ছিলেন, তা এখন পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি। জিয়া পাঁচ বছর বাংলার শাসক ছিলেন, শেরশাহ চার বছর ভারতের শাসনকর্তা ছিলেন—১৫৪০ থেকে ১৫৪৪। তাঁর নামে নয়াদিল্লিতে বিরাট শেরশাহ রোড আছে।
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জিয়া পাঁচ বছরে একটি অসৌজন্যমূলক উক্তিও করেননি। নিহত হওয়ার সপ্তাহখানেক আগে তিনি দক্ষিণ বাংলা থেকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় আসার সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে স্বাধীনতাসংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার আন্তরিক প্রশংসা করছিলেন। তবে নিশ্চয়ই তাঁর রাজনীতি ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির বিপরীত আদর্শের রাজনীতি। জিয়ার রাজনীতির যখন আমরা মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করব, সেখানে তিনি সমালোচিত হবেন।
গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিমান প্রতিমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদেশে অবস্থানকালে বিমানবন্দর থেকে জিয়ার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। পত্রিকায় খবর হওয়া মাত্র রাজপথে নেমে পড়েছিল মানুষ। জিয়ার কবরসংলগ্ন ক্রিসেন্ট লেক থেকে ভাসমান সাঁকোটি রাতের বেলা সিলেটে সরিয়ে নেওয়া হলেও অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। এসব খুবই নিম্নমানের প্রতিহিংসামূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এসব করে কোনো অবস্থাতেই কেউ লাভবান হতে পারে না। জিয়ার পেছনে এই সরকার যত লাগবে, তত জিয়ার অনুরাগীরা বঙ্গবন্ধুর দোষত্রুটি খুঁজে বের করে প্রচার করবে। শেষ পর্যন্ত বেশি ক্ষতি কার, সেটা ভেবে দেখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীরা ছিটেফোঁটা পেয়ে ঘাপটি মেরে আছেন। কোনো বড় বিপর্যয় ঘটলেও তাঁরা নীরবতাই অবলম্বন করবেন, যেমন করেছিলেন ২৮ পৌষের পরে পৌনে দুই বছর। অথবা উদীয়মান শক্তিকে বলবেন: আমরা তো মহাজোট সরকারের কাজকারবার সমর্থন করিনি। তখন তা বললে পাওয়া যাবে নতুনদের থেকে নতুন সুবিধা। এ-ই তো হচ্ছে ৪০ বছর যাবত্। দুঃখের বিষয় হলো, সরকারকে সত্ পরামর্শ বা সাবধান করার কেউ নেই।
তড়িঘড়ি করে যাবতীয় কাজ করতে গিয়ে গায়েবি সরকার নিজেদের জন্য যে বিপদ ডেকে এনেছিল, মহাজোট সরকারও সেই পথই ধরেছে। এই সরকারের হিতার্থীরা শনিবার এক আলোচনা সভায় বলেছেন, আওয়ামী লীগ আজও বিপদমুক্ত হয়নি। আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটতে পারে। আশার কথাও বলা হয়েছে: দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সন্ত্রাস দমন ও দলীয় টেন্ডারবাজি বন্ধ করতে পারলে আগামী ৫০ বছরেও বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারবে না। পাটমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী বলেছেন, ‘সরকারের ভেতরে যে অস্থিরতা চলছে, তা আমরা মোকাবিলা করতে পারছি না।’ এই সরকারের বিপর্যয় ঘটলে বিএনপিই যে ক্ষমতায় আসবে, তার নিশ্চয়তা কি? আরও তো ‘দেশপ্রেমিক’ শক্তি থাকতে পারে? পঁচাত্তরের আগস্টে জাসদ বা ভাসানী ন্যাপ ক্ষমতায় যায়নি, অজ্ঞাতনামারাই গিয়েছিল।
যেকোনো দূরদর্শী ক্ষমতাসীন দলের উচিত, শত্রুর সংখ্যা কমিয়ে আনা, বাড়ানো নয়। গণতন্ত্রকামী প্রত্যেক মানুষ চায় একটি স্থিতিশীল সরকার এবং যথাসময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন। কিন্তু সরকার নিজেই যদি অস্থিতিশীলতা ডেকে আনে, তখন জনগণের কিছুই করার থাকে না। আশা করি, সরকার প্রতিপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের পরিচয় দেবে এবং খুব ভেবেচিন্তে কাজ করবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.