ভয়াবহ খরার মুখে ভারত by দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী

ভারত দুই দশকের মধ্যে ভয়াবহ খরা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। চলতি বর্ষা মৌসুমে গত সপ্তাহ পর্যন্ত দেশটির চার ভাগের তিন ভাগ জেলায় স্বল্প বা অনাবৃষ্টির কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণে গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিকে প্রধান করে ১০ জন মন্ত্রীর সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানের তথ্য নিয়ে ওই কমিটি ‘পুরোমাত্রায় খরা’ বিরাজ করছে—এমন জেলাগুলোকে খরাপীড়িত বলে ঘোষণা করেছে। সর্বশেষ পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রের ১০টি জেলাকে খরাপীড়িত ঘোষণা করা হয়েছে। এ নিয়ে সারা দেশে ১৭৭টি জেলাকে খরাপীড়িত ঘোষণা করা হয়েছে। এই সংখ্যা দেশটির মোট জেলার এক-চতুর্থাংশেরও বেশি।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি) এ সপ্তাহের প্রথমদিকে জানায়, চার মাসের বর্ষা ঋতুতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৯৩ শতাংশ থেকে ৮৭ শতাংশে নেমে এসেছে। আইএমডি জানায়, ১২ আগস্ট থেকে আগের সপ্তাহে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৬ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর আগের সপ্তাহে স্বাভাবিকের চেয়ে ৬৪ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছিল। বিশ্লেষকদের মতে, এবারের খরা পরিস্থিতি ২০০২ সালের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে।
গত সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেন, ১৪১টি জেলায় ভয়াবহ খরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দিল্লিতে আগামী ১৭ আগস্ট খরা ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। এরপর ২১ আগস্ট বিভিন্ন রাজ্যের কৃষিমন্ত্রীদের বৈঠক হওয়ারও সম্ভাবনা আছে। কেন্দ্রীয় খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী শারদ পাওয়ার বলেন, ১৭৭টি জেলায় ‘খরা বা খরার মতো’ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এই জেলাগুলোর বেশির ভাগই বিহার, উত্তর প্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র, হিমাচল প্রদেশ, আসাম ও মণিপুর রাজ্যের।
একটি সূত্র জানায়, কোনো এলাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে ২৬ থেকে ৫০ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হলে তাকে ‘মাঝারি ধরনের খরা’ বলে ধরা হয়। আর বৃষ্টিপাত ৫০ শতাংশের চেয়ে কম হলে ‘প্রকট খরা’ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এভাবে কোনো এলাকায় মাঝারি বা প্রকট খরা দেখা দিলে ওই মৌসুমে পুরো দেশের বৃষ্টিপাতের সঙ্গে তুলনা করা হয়। তুলনায় সারা দেশের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ শতাংশের কম হলে ওই বছরকে খরা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেশে ৪০ শতাংশের চেয়ে বেশি এলাকায় খরা পরিস্থিতি বিরাজ করলে সারা ভারতে প্রকট খরার বছর বলে ধরা হয়।
২০০২ সালের পুরো মৌসুমে (১ জুন থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর) স্বাভাবিকের চেয়ে বৃষ্টিপাত কম হয়েছিল ১৯ শতাংশ। খরা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল দেশের ২৯ শতাংশ এলাকায়। ওই বছর ২১ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন ধান, ২ দশমিক ২ মিলিয়ন টন ডাল, সাত মিলিয়ন টন গম ও সাত মিলিয়ন টন অন্যান্য খাদ্যশস্যের উত্পাদন কমে গিয়েছিল।
চলতি বর্ষা মৌসুমের ১ জুন থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত স্বাভাবিকের চেয়ে বৃষ্টিপাত কম হয়েছে ২৯ শতাংশ। দেশের মোট আয়তনের ৪০ শতাংশেরও বেশি এলাকায় এ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ কারণে এখন পর্যন্ত ৫৭ লাখ হেক্টর জমিতে ধানের চারা রোপণ করা যায়নি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, এই মৌসুমে চাষাবাদের জন্য পরবর্তী তিন-চার সপ্তাহ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখনও দেড় মাস বর্ষা মৌসুম রয়েছে।
এ বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই জুন মাসে অত্যন্ত কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। এখন মৌসুমের অর্ধেকেরও বেশি সময় পার হলেও অন্যান্য বছর জুনে যে স্বাভাবিক বৃষ্টি হয়, সেই বৃষ্টিও হয়নি। তবে জুলাইয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। ১৩০ বছরের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, জুন-জুলাইয়ে সারা দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ১২ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে খরা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার ৬৭ শতাংশ আশঙ্কা রয়েছে।
সাধারণত বর্ষাকালের মোট বৃষ্টিপাতের ৩০ শতাংশ হয় আগস্ট মাসে। তবে এই মাসের শুরুতে সারা দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ২৫ শতাংশ বৃষ্টি কম হয়েছে। বৃষ্টির পরিমাণ না বাড়লে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ইতিমধ্যে কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ অঞ্চলে এখন পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.