জাকাত কে কাকে দেবেন by মুফতি এহছানুল হক মুজাদ্দেদী

প্রধানত ইসলামি রাষ্ট্রের জিহাদরত, জিহাদে আহত বা জিহাদের খাত। আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) বলেন, ফি সাবিলিল্লাহর অর্থ- যারা ইসলাম প্রচার প্রসারের কাজে নিয়োজিত আছেন।
‘জাকাত’ আরবি শব্দ। অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া, পবিত্রতা বা পরিশুদ্ধতা। জাকাতের আরেক অর্থ পরিবর্ধন। ইসলামি বিশ্বকোষে জাকাতের অর্থ লেখা আছে, জাকাত অর্থ পবিত্রতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী (সা.)! আপনি তাদের মালামাল থেকে জাকাত গ্রহণ করুন, যাতে আপনি এর মাধ্যমে সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং বরকতময় পরিশুদ্ধ করতে পারেন।’ (সূরা তওবা : ১০৩)। এটাকে জাকাত বলার কারণ হলো এভাবে জাকাত দাতার অর্থসম্পদ এবং তার নিজের আত্মা পবিত্র-পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। প্রিয় রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘জাকাত ইসলামে ধনী-গরিবের সেতুবন্ধন।’ (মুসলিম)।
যাদের ওপর জাকাত ফরজ
প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন সব ‘সাহেবে নিসাব’ সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ, সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের মালিক মুসলিম পরুষ-নারীর ওপর জাকাত প্রদান করা ফরজ। কোনো ব্যক্তি মৌলিক প্রয়োজনীয় উপকরণ ব্যতীত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার পর চাঁদের হিসাবে পরিপূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হলে তার ওপর পূর্ববর্তী বছরের জাকাত প্রদান করা ফরজ। অবশ্য যদি কোনো ব্যক্তি জাকাতের নিসাবের মালিক হওয়ার পাশাপাশি ঋণগ্রস্ত হয়; তবে ঋণ বাদ দিয়ে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে, তার ওপর জাকাত ফরজ হবে। জাকাত ফরজ হওয়ার পর যদি কোনো ব্যক্তি জাকাত প্রদান না করে টাকা খরচ করে ফেলে, তাহলেও তাকে তার পূর্বের জাকাত দিতে হবে। নাবালেগ ও পাগলের ওপর জাকাত ফরজ হবে না। কারণ তাদের ওপর শরিয়তের বিধান আরোপিত হয় না। তবে যদি কোনো মস্তিষ্ক বিকৃত ব্যক্তি নিসাবের মালিক হওয়ার সময় এবং বছর পরিপূর্ণ হওয়ার সময় সুস্থ থাকে; কিন্তু মধ্যবর্তী সময় মস্তিষ্ক বিকৃতির শিকার হয়, তাহলেও তাকে জাকাত প্রদান করতে হবে।
জাকাত বণ্টনের খাত
জাকাত বণ্টনের ব্যাপারে কোরআনের স্পষ্ট ঘোষণা হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই সদকা (জাকাত) তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও জাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটাই আল্লাহর বিধান।’ (সূরা তওবা : ৬০)।
মহাগ্রন্থ কোরআনের আলোকে জাকাত ব্যয়ের খাত আটটি। যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো।
নিঃস্ব ফকির : ফকির বলা হয় যার কোনো সম্পদ নেই, নেই তার উপযোগী হালাল উপার্জন, যা দ্বারা তার প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। যার খাওয়া-পরা ও থাকার স্থান নেই। অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেই। আবার কেউ বলেছেন, ফকির সে, যার সামান্য সম্পদ আছে। তবে জীবন ধারণের জন্য অপরের ওপর নির্ভর করে।
অভাবগ্রস্ত মিসকিন : মিসকিন বলা হয় যার এমন পরিমাণ সম্পদ আছে, যা দ্বারা তার ওপর নির্ভরশীল লোকদের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট নয়। মিসকিন সেই, যার কোনো কিছুই নেই। আবার কারও মতে, মিসকিন সে ব্যক্তি যার কিছু সম্পদ আছে; কিন্তু লজ্জা সম্মানের ভয়ে কারও কাছে হাত পাতেন না যারা। তারা জীবন-জীবিকার জন্য প্রানান্তকর প্রচেষ্টা করার পরও প্রয়োজন মতো উপার্জন করতে পারেন না। এতকিছুর পরও নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারেন না। মোটকথা, মিসকিন এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যার কিছুই নেই, যিনি মানুষের কাছে হাত পেতে বেড়ান এবং খোরাক-পোশাকের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হন।
জাকাত বিভাগের কর্মচারী : যারা জাকাত আদায়কারী, সংরক্ষণকারী, পাহারাদার, লেখক, হিসাবরক্ষক এবং জাকাতের বণ্টনকারী এদের সবাইকে জাকাতের ফান্ড থেকে বেতন দিতে হবে। তবে এমন যেন না হয়, আমিল কর্মচারীদের পারিশ্রমিক দিতে গিয়ে জাকাতের কোনো অর্থ অবশিষ্ট না থাকে, সে ক্ষেত্রে তাদের আদায়কৃত জাকাতের অর্ধেকের বেশি দেওয়া যাবে না। এ ব্যবস্থা এজন্য করা হয়েছে, যেন তারা জাকাতের মালের মালিকদের থেকে অন্য কিছু গ্রহণ না করেন। বরং এটা আসলে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলদের আওতায় পড়ে। রাষ্ট্রের দায়িত্ববান জাকাতের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা, গঠন ও পরিচালনা করবেন।
যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য : ইসলামের জন্য যাদের মন আকর্ষণ করা প্রয়োজন কিংবা ইসলামের ওপর তাদের সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য এমন লোকদের জাকাতের খাত থেকে জাকাত প্রদান করা। অধিকাংশ হানাফি আলেমের মতে, এ খাতটি রহিত হয়ে গেছে।
দাসমুক্তির জন্য : যে ক্রীতদাস তার মালিককে অর্থ প্রদানের বিনিময়ে মুক্তিলাভের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এখানে এ পর্যায়ে মুসলিম যুদ্ধবন্দিও এ খাতের আওতায় পড়বেন। কাজি ইবনুল আরাবি বলেন, মুসলিম দাসকে যখন মুক্ত করতে জাকাতের খাত থেকে দেওয়া যাবে, ঠিক তেমনি মুসলিম বন্দিকে ও কাফেরদের দাসত্ব শৃঙ্খলা ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত করার কাজে জাকাতের অর্থ ব্যয় করা অধিক উত্তম বলে বিবেচিত হবে। এ বিষয়ে বিখ্যাত তাফসিরকারদের অভিমত, কোরআনে ফির রিকাব বলে জাকাতের যে ব্যয় খাতটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে তাকে পরাধীন গোত্র ও জাতিগুলোকে মুক্ত করার কাজে ও ব্যবহার করা যাবে।
ঋণগ্রস্তদের জন্য : এমন ব্যক্তি, যিনি ঋণভারে জর্জরিত অবস্থায় পতিত। তাকে জাকাতের ফান্ড থেকে সাহায্য করা। তবে যে কোনো অসৎ কাজে বা অপব্যয়ের কারণে ঋণগ্রস্ত হলে তওবা না করা পর্যন্ত জাকাতের ফান্ড তাকে দেওয়া যাবে না। আবার ঋণগ্রস্ত এর পর্যায়ে যেমন জীবিত ব্যক্তি শামিল, তেমনি মৃত ব্যক্তিও এর আওতায় পড়ে, মৃতব্যক্তি যিনি ঋণ রেখে মারা গেছেন। ইমাম কুরতুবি (রহ.)ও তাই বলেছেন।
আল্লাহর পথে : প্রধানত ইসলামি রাষ্ট্রের জিহাদরত, জিহাদে আহত বা জিহাদের খাত। আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) বলেন, ফি সাবিলিল্লাহর অর্থ- যারা ইসলাম প্রচার প্রসারের কাজে নিয়োজিত আছেন।
মুসাফিরদের জন্য : এমন ব্যক্তি, যার নিজ আবাসস্থলে সম্পদ আছে; কিন্তু সফরে তিনি বিপদগ্রস্ত ও নিঃস্ব অবস্থায় আছেন, তাকে জাকাতের তহবিল থেকে সাহায্য করা। তবে তার সফর পাপের কাজের বা অনুরূপ পর্যায়ের কোনো সফর হওয়া যাবে না। আল্লামা তাবারি (রহ.) মুজাহিদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন, জাকাতের সম্পদ ধনীর হওয়া সত্ত্বেও এ ধরনের নিঃস্ব পথিকেরও একটি হক রয়েছে। যদি তিনি নিজের ধনসম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

No comments

Powered by Blogger.