শ্রীলঙ্কার ওয়েরেলেগামা মন্দিরে গৈরিক পোশাকধারী তরুণ প্রহরীদের মন গড়ে দিচ্ছেন এক শ্রদ্ধেয় ভিক্ষু by ফ্রান্সিস বুলাতসিঙ্ঘালা

শান্তভাবে সারি বেঁধে একে একে এগিয়ে চলেছেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। লাইনের একেবারে শেষপ্রান্তে আছে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য, সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন তার পরিধেয় বস্ত্র সংযত রাখতে। তার বয়স ৫ বছর। ভিক্ষুরা ক্যান্ডির একটি পল্লীর মঠ থেকে কলম্বোর সবচেয়ে ঐতিহাসিক ও বিখ্যাত বৌদ্ধ উপাসনালয় গঙ্গারামায়া মঠে এসেছে। সন্ন্যাসীদের সামনে আছেন শ্রদ্ধেয় সূর্যগোদা জিনাসিরি হিমি। তিনি শিক্ষক ও তরুণ ভিক্ষুদের কাছে পিতৃতুল্য ব্যক্তিত্ব। তারা বৌদ্ধ মূর্তির কাছে তাদের প্রার্থনা সম্পূর্ণ করলেন। তবে তরুণ সন্ন্যাসী থেকে শিশুতে পরিণত হতে বেশি সময় লাগল না তাদের।
একজন দৌড়ে জিনাসিরি হিমির জোব্বা টেনে ধরলেন। আরেকজনও অনুসরণ করলেন তাকে। অল্প সময়ের মধ্যেই ছাত্রদের দল তাকে ঘিরে ফেলল। ছুটির দিনে শিশুরা যা করে, তারাও সেটি করার সুযোগ হারাতে চাইলেন না। সাগর সৈকতে কখন তারা খেলার সুযোগ পাবেন? তারা কি নৌকায় চড়তে পারবেন? মন্দিরের শোভাযাত্রায় অংশ নেয়ার আগে তারা কি হাতিগুলো দেখার সুযোগ পাবেন? জিনাসিরি হিমি প্রশ্নগুলোর জবাব দিলেন, সবকিছুর জবাবে বললেন, হ্যাঁ।
এখানে ৫ বছর বয়সের আরেকজন আছেন। তাকে তার মা-বাবা কয়েক সপ্তাহ আগে মঠের কাছে হস্তান্তর করেছেন। তিনি এখন ৪০ দিনের বৌদ্ধ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। এটি শেষ হলে তিনি পোশাক পাবেন। চেহারায় রুষ্ট ভাব তার। এক বয়স্ক সন্ন্যাসী হেসে জানালেন, এই শিশুটিও গৈরিক পোশাক পরে কলম্বো আসতে চেয়েছিল।
শ্রীলঙ্কার পার্বত্য রাজধানী ক্যান্ডির ওয়েরেলেগামা গ্রামের একটি মঠ থেকে ১৫টি শিশু এসেছে। তারা ১৯ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বার্ষিক হেরাহেরা (ধর্মীয় শোভাযাত্রা) ও পূর্ণ পোয়া দিবস উদযাপন করতে। ওই দিন বৌদ্ধ ছুটির দিন। কলম্বোর সবচেয়ে পুরনো ও জাঁকজমকপূর্ণ মঠ হলো গঙ্গারামায়া। তরুণ সন্ন্যাসীরা শ্রদ্ধায় অবনত। তাদের অনেকে এই প্রথম রাজধানী নগরীতে এসেছে।
জিনাসিরি হিমি বলেন, তার সাথে এখন ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী ১৫ জন ইন-হাউস প্রশিক্ষণ গ্রহণরত সন্ন্যাসী রয়েছেন। তারা রিরিভেনায় তারই ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়ন করে। ৪৭ বছর বয়স্ক জিনাসিরি হিমি বলেন, তরুণ সন্ন্যাসীদের শিক্ষা ও কল্যাণের জন্য অনেক কিছু করা উচিত।
তিনি বলেন, আমি তাদের মা, বাবা, শিক্ষক ও প্রধান সন্ন্যাসী। আমি ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালনরত থাকি। এই এক দিন আগে একজন গাছে চড়তে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছে। আমার সবসময় মনে থাকে যে তারা শিশু, তাদের পরিচর্যার প্রয়োজন, যত্নের সাথে তাদের পরিচর্যা করা উচিত। অনেক সময় শিশুদের মা-বাবা ও স্বজনেরা মন্দিরে আসেন। শিশুরা তাদের বাড়িতে যায়, তবে তারা তাদের নতুন বাড়ি সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন থাকে, এখানকার শিশুরা তাদের নতুন ভাইয়ে পরিণত হয়ে যায়।
জিনাসিরি হিমি বলেন, ১৯৮৮ সালে তিনি নিজে ১৩ বছর বয়সে একটি পল্লী মঠে প্রবেশ করেছিলেন। তখন সিংহলি প্রদেশগুলোতে জেভিপি মাক্সির্স্ট আন্দোলনে আক্রান্ত। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী কার্যক্রমে প্রবেশের এক বছরের কম সময়ের মধ্যে একটি সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে মঠের প্রধান নিহত হন। তার মৃত্যুর পর যিনি মঠের দায়িত্ব লাভ করেন, তিনি জিনাসিরি হিমিকে পছন্দ করলেন না। তখন শুরু হলো তার বিভিন্ন মঠে গিয়ে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা চালানো। এই প্রক্রিয়ায় অনেক কষ্টের পর তিনি পেরাডেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্বে ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষা জীবন শেষ করেন।
আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শৈশবের মঠ (এই মঠটিকে তিনি গৃহ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন) ত্যাগ করে কার্যত গৃহহীন অবস্থায় থাকার স্মৃতি নিয়ে তিনি শিশুদের জন্য একটি মঠ আবাস কাম স্কুল নির্মাণের ইচ্ছাপ্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, এখানে যেসব শিশু আসে, তারা চরম গরিব। তাদের পরিবারগুলো তাদের ব্যয়ভার বহন করতে পারে না। তাদের মা-বাবার যথার্থ আয় নেই, তাছাড়া শিশুদের জন্য ক্ষতিকর অনেক বিষয়ও থাকে। অনেকের মা-বাবাও থাকে না। আবার কারো মা বা বাবা আবার বিয়ে করায় শিশুটিকে তাদের সাথে রাখতেও চায় না। তবে এই মন্দির-স্কুলে এলে তারা যথার্থ শিক্ষা পায়। সাধারণ স্কুলের সিলেবাসের পাশাপাশি তাদেরকে পালি, সংস্কৃত ও বৌদ্ধ ধর্ম শেখানো হয়। তারো অন্যান্য ধর্মীয় দর্শনও শেখে।
তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সাত শতাধিক সন্ন্যাসীকে পড়াশোনা করিয়েছেন। তাদের একটি বড় অংশই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছে। শিক্ষা সমাপ্ত করে অনেকে পুরোহিত্বও ত্যাগ করেছে। তিনি বলেন, থাকা বা না-থাকাটা ইচ্ছার ব্যাপার। শৈশবে এখানে এসে শিক্ষা গ্রহণ করার আগ্রহ থাকায় এসব শিশুকে নিয়ে আমি খুশি।
পাশ্চাত্য ও অন্যান্য দেশের বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী ইংরেজি শিক্ষা দিয়ে থাকেন শিশু সন্ন্যাসীদের। এছাড়া জিনাসিরি হিমি প্রতিষ্ঠা করেছেন টিম গ্রিন লাইফ ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তরুণ ছাত্র সন্ন্যাসীরা যাতে গ্রাম পর্যায়ের সামাজিক কার্যক্রমে জড়িত হতে পারে, সেজন্যই তিনি এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তরুণ সন্ন্যাসীদের মনে পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষার ভালোবাসা সৃষ্টি করা হয়। মন্দির প্রাঙ্গনের একটি বড় অংশ ফলমূল, সব্জি ও ওষুধ গাছ লাগানোর জন্য ছেড়ে রাখা হয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে এই বাগানটি জেলা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কৃষি উদ্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
শ্রীলঙ্কাসহ অনেক দেশে ধর্মের সাথে যখন অস্থিরতা সম্পৃক্ত, তখন জিনাসিরি হিমির বৌদ্ধ স্কুলটি তরুণ সিংহলি শিশুদের অন্য ধর্ম ও সংস্কৃতির লোকজনের জন্য সন্ন্যাসী হওয়ার শিক্ষা দিচ্ছে। তার মঠের আশপাশে বেশ কয়েকটি মুসলিম পরিবার রয়েছে। এসব পরিবারের সদস্যরা এসব শিশু সন্ন্যাসীদের দেখাশোনা করেন, তাদের যত্ন নেন।
তরুণ সন্ন্যাসীরা সাধারণত কঠোর সময়সূচি মেনে চলে, প্রার্থনা করে। তবে রোববারগুলোতে তারা অবৌদ্ধসহ অন্য সম্প্রদায়ের সদস্যদের সাথে খেলাধুলা করে। সরকারি ছুটির দিনগুলোতে জিনাসিরি হিমি দেশের অন্যান্য স্থানে ঘুরতে নিয়ে যান শিশুদের। তাদেরকে দেশের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন করে তোলেন।
ওয়েরেলগামার পাশের গ্রামের একটি স্কুলের শরত বিজেসিঙ্গে নানাভাবে জিনাসিরি হিমিকে সহায়তা কর থাকেন। তিনি বলেন, শিশুরা খুবই দুষ্টু। তিনি ৫ বছর বয়সের এক শিশু সন্ন্যাসীকে শূন্যে ছুঁড়ে দেন। শিশুটি এই খেলায় খুশিই হয়। হাসিতে ফেটে পড়ে। তবে তার পরপরই তার মনে পড়ে, সে সন্ন্যাসী। সাথে সাথে লজ্জায় জিনাসিরি হিমির পেছনে লুকায়।
অন্যরাও তার সাথে হাসি-তামাশায় মেতে ওঠে। তবে সবকিছুই ম্লান হয়ে যায় ১১ বছর বয়স্ক ক্রিকেটপ্রেমীর নাম ঘোষিত হওয়ার সময়। সন্ন্যাসী হিসেবে ভর্তি হওয়ার সময় তার নাম ছিল ভিন্ন। মন্দিরে তাদের নাম রাখার ব্যবস্থাটি বেশ ভিন্ন। এর সাথে জড়িত থাকে তাদের জন্মস্থানের ঠিকানাও। যেমন মহাসেনপুরা ধাম্মানান্দ। তার নামের প্রথম অংশটি তার গ্রামের নাম। শ্রীলঙ্কার নর্থ সেন্ট্রাল প্রদেশের পুলুনেরুয়ায় গ্রামটি অবস্থিত। তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, ব্যাট করার সময় সে কয়টি জানালার কাচ ভেঙেছে, তখন সে হাসি থামাতে পারল না।
মহাসেনপুরা ধাম্মানান্দের বয়স যখন ৩ তখন তাকে মঠে নিয়ে আসেন তার মা-বাবা। স্কুলে তার প্রিয় বিষয় হলো ইংরেজি। তবে সুকণ্ঠ ও বৌদ্ধ প্রার্থনা আবৃতির জন্যও সে বিখ্যাত। এসব কথাবার্তায় একটি সাবলীল পরিবেশ সৃষ্টি হলে শিশুরাও মনখুলে কথা বলতে শুরু করে। তারা একে একে তাদের প্রিয় বিষয় ও বড় হলে কী করতে চায়, সবই বলতে থাকে। বেশির ভাগই জানান, তারা বড় হয়ে হবেন বিখ্যাত সন্ন্যাসী। তবে ১২ বছর বয়স্ক কাতুকেলিয়াওয়ে মেদাননান্দ ঘোষণা করেন, তিনি হতে চান ইঞ্জিনিয়ার। আরেকটি ভিন্ন একটি প্রশ্ন নিয়ে হাত তোলেন। তিনি জানতে চান, নতুন ইংলিশ কোচিং কবে থেকে শুরু হবে।
গ্রামের স্কুলের প্রিন্সিপ্যালের দায়িত্ব পালনকারী বিজেসিঙ্গে জানেন, শ্রীলঙ্কার স্কুলগুলোতে মৌলিক সুবিধাগুলো কত অপ্রতুল। এই প্রেক্ষাপটে তিনি স্বীকার করছেন, মঠ-স্কুলগুলো কতটা ভালো করছে তুলনামূলক। এখানে পড়াশোনাকারী শিশুরা ভালো চাকরি পায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগও পায়। আর সন্ন্যাসীর জীবন অব্যাহত রাখবে কিনা তা তাদের নিজের ব্যাপার হয়ে পড়ে।
জিনাসিরি হিমির এখন তার শিক্ষা মন্দিরটি সম্প্রসারণই বড় কথা। তিনি শ্রীলঙ্কার ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা, বিশেষ করে হস্তশিল্প শেখানোর কাজটি শুরু করতে চান। এসব শিল্প দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা থেকে। এগুলো সংরক্ষণ করা খুবই প্রয়োজন।
মনের মুক্তির বৈজ্ঞানিক নীতিমালা প্রতিষ্ঠাকারী গৌতম বুদ্ধের পথ অনুসরণকারী শিশুরা এখন তাদের বাড়ি থেকে দূরে এক বাড়িতে অবস্থান করছে। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে, ভবিষ্যতে তারা কী হতে চায়।

No comments

Powered by Blogger.