ইরাকে সাম্প্রতিক সহিংস বিক্ষোভের নেপথ্য কারণ

ইরাকে সাম্প্রতিক বিক্ষোভ
ইরাকের সাম্প্রতিক সহিংসতা ও প্রতিবাদ সমাবেশ পশ্চিম এশিয়ার অন্যতম আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গত বছরের মতো এবারের বিক্ষোভ সমাবেশও সহিংসতায় রূপ নেয়। ইরাকের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে সাম্প্রতিক সহিংসতায় ১০০ জনের বেশি নিহত এবং ছয় হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে।

গত কয়েক বছর ধরে আমরা লক্ষ্য করছি ইরাকে কোনো না কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে প্রায়ই সরকার বিরোধী বিক্ষোভ হচ্ছে। এসব বিক্ষোভের বেশিরভাগই সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। গত বছর সেপ্টেম্বর বসরায় সরকার বিরোধী বিক্ষোভ হয় এবং এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা সেখানে অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেটে হামলা চালায়। বেশ কিছু কারণে গত কয়েক বছরের প্রতিবাদ সমাবেশ গত পাঁচ বছর আগের প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথমত পার্থক্য হচ্ছে, ইরাকের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ও সহিংসতায় ১০০এর বেশি নিহত এবং ৬ হাজারের বেশী মানুষ আহত হয়েছে যা অতীতে হয়নি।

দ্বিতীয় পার্থক্য হচ্ছে, বিগত দিনে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশ হতো সাদরের মতো নেতাদের নির্দিষ্ট দল, মত বা গোষ্ঠীর সমর্থকদের নিয়ে। কিন্তু সাম্প্রতিক এসব প্রতিবাদ সমাবেশে সুনির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর পরিচয় নেই। এমনকি প্রভাবশালী শিয়া নেতা মোক্তাদা সাদর জনগণকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। এ অবস্থায় কারা এই প্রতিবাদ সমাবেশ ও সহিংসতার পেছনে মদদ দিচ্ছে সেটাই এখন প্রশ্ন।

তৃতীয়ত পার্থক্য হচ্ছে, এবারই প্রথম সরকার বিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশে ইরাকের শীর্ষ ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়া হয়েছে। অথচ ২০১৪ সালে ইরাকের শীর্ষ শিয়া ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ সিস্তানির ফতোয়া অনুযায়ী দায়েশ বিরোধী হাশদ আশ্‌ শাবি সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছিল যেখানে ইরাকের সর্বস্তরের জনগণ অংশ নিয়েছিল। এ থেকে একদিকে ধর্মীয় নেতাদের প্রতি ইরাকের জনগণের গভীর শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অন্যদিকে, এটাও প্রমাণিত হয়েছে ইরাকের বিচক্ষণ ধর্মীয় নেতারা সবসময় জনগণের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।

চতুর্থ পার্থক্য হচ্ছে, এবারের প্রতিবাদ সমাবেশে যারা অংশ নিয়েছিল তারা ইরাকের বর্তমান শাসন ব্যবস্থা উৎখাতের জন্য শ্লোগান দিয়েছিল। অথচ এসব শ্লোগান কেবল স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে দেয়া মানায়। কারণ  ইরাকে একটি নির্বাচিত সরকার রয়েছে। প্রতি চার বছর পর পর ইরাকের জনগণ পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয় এবং পার্লামেন্টে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেন থাকেন।

ইরাকে অতীতের সরকার বিরোধী বিক্ষোভের সঙ্গে এবারের বিক্ষোভের পঞ্চম পার্থক্য হচ্ছে, বিক্ষোভকারী ও সহিংসতায় জড়িতরা এবং তাদের সমর্থক গণমাধ্যম, বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব ও গ্রুপ এমন সময় ইরাক সরকারের পদত্যাগ ও নতুন করে পার্লামেন্ট নির্বাচনের দাবি তুলেছে যখন বর্তমান সরকারের মেয়াদকাল এক বছরেরও কম। নানা কারণে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ পুঞ্জিভূত হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই অসন্তোষ বিরাজ করছে। এ কারণে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আদিল আব্দুল মাহদি জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, "দুর্নীতি বা অন্যান্য সমস্যার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করার অধিকার তাদের রয়েছে কিন্তু যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইরাকের বর্তমান অবস্থায় সেসব সমস্যার সমাধান করতে হলে আরো সময়ের প্রয়োজন।"

বিশ্বে তেল রিজার্ভের দিক দিয়ে ইরাক দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। দেশটি প্রতিদিন ৩৬ লাখ ব্যারেল তেল রপ্তানি করে। সম্পদের দিক দিয়ে ইরাক এ অঞ্চলের অন্যতম ধনি দেশ হলেও যুদ্ধবিধ্বস্ত এ দেশটির জনগণ চরম অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটের সম্মুখীন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ইরাকে শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৪০ শতাংশের বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এবারের সরকার বিরোধীদের মধ্যে শিক্ষিত যুবক শ্রেণীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। এ ছাড়া সামাজিক নানা পরিসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে জনমনেও অসন্তোষ বিরাজ করছে। ইরাকের জনগণ বহুদিন ধরে বিদ্যুত সংকটে ভুগছে। স্বাস্থ্য পরিসেবার অবস্থা খুবই নাজুক। এমনকি খাদ্য পানির সংকটও বেশ প্রবল।

ইরাকে সাম্প্রতিক বিক্ষোভের দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, প্রশাসনে চলমান দুর্নীতি। আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়ম সেদেশে জনমনে অসন্তোষের অন্যতম কারণ। জনগণের কল্যাণের  বিষয়টি উপেক্ষা করে বাজেটের একটা বিরাট অংশ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।  গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, ইরাকের বর্তমান সরকার যুবকদের চাকরির প্রতিশ্রুতি এবং জনসেবামূলক কার্যক্রম বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের উন্নয়ন বাজেট ও জনসেবামূলক কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে।

যাইহোক, ইরাকে ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আয়োজিত শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ বিক্ষোভ কেন সহিংসতায় রূপ নিল, কেন জনপ্রিয় ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়া হল এবং কেনইবা সরকার পতনের ডাক দেয়া হল সেটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

এ প্রশ্নের জবাবে এর পেছনে ইরাকের ভেতরে ও বাইরের বিভিন্ন কারণের কথা উল্লেখ করা যায়।  অভ্যন্তরীণ দিক দিয়ে ইরাকি সমাজের গঠন কাঠামো বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে এবং বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর ইরাক ঐক্যবদ্ধ নয়। ইরাকের এ দুর্বলতার সুযোগে দায়েশের মতো উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছে। অন্যদিকে, ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের নিষিদ্ধ ঘোষিত বাথ পার্টির অনেক সদস্য এখনো রয়ে গেছে এবং তাদের প্রতি বাইরের বিভিন্ন মহলের সমর্থন বজায় রয়েছে। এ গোষ্ঠীর সদস্যরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং তারা বেকারত্ব, দারিদ্রতাসহ নানা সংকটে জর্জরিত যুবকদেরকে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ ও সহিংসতায় উস্কানি দিচ্ছে। সম্প্রতি সরকার বিরোধী আন্দোলনের নামে যে সহিংস ঘটনা ঘটেছে এটি ছিল তার অন্যতম কারণ। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচি সহিংসতায় রূপ নেয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, ইরাকের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমেরিকা, সৌদি আরব ও ইসরাইলের হস্তক্ষেপ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বিক্ষোভকে তারা অনেক বড় ঘটনা হিসেবে তুলে ধরে এটাকে সহিংসতায় রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।   

ইরাকে সাম্প্রতিক সহিংস বিক্ষোভের পেছনে বিদেশীদের হাত থাকার বহু প্রমাণ রয়েছে। ইরাক সরকার বিভিন্ন ইস্যুতে স্বাধীন নীতি মেনে চলায় অনেক দেশ অসন্তুষ্ট। দেশটির সরকার ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করেছে, পারস্য উপসাগরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথ নৌবাহিনীতে যোগ দিকে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং সিরিয়ার সঙ্গে ইরাকের সীমান্ত খুলে দিয়েছে। এ ছাড়া, গত মাসে ইরাকের জনপ্রিয় হাশদ আশ্‌ শাবির ঘাঁটিতে হামলার ঘটনার পর ইরাক সরকার রাশিয়ার কাছ থেক এস-৩০০ এবং এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনার জন্য ইরাকের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ফালাহ ফাইয়াজ রাশিয়া সফর করেছেন। এ ছাড়া, ইরাক সরকার প্রতিরোধ শক্তিগুলোর প্রতি সমর্থন দিচ্ছে। সিরিয়া ও ইয়েমেনে ব্যর্থতাও সৌদি আরবকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এসব কারণে ইরাক সরকারের প্রতি পাশ্চাত্য ও তাদের মিত্র দেশগুলো খুবই অসন্তুষ্ট। এ অবস্থায় বাগদাদকে কোণঠাসা করার জন্য আমেরিকা, সৌদি আরব ও ইসরাইল ইরাকের সাম্প্রতিক  বিক্ষোভকে কাজে লাগানোর চেষ্টা চালিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.