অমিতাভ ঘোষের বই ‘গান আইল্যান্ড’: ভেনিসে বাঙালি বণিক by বৈষ্ণ রায়

জ্ঞানপীঠ চলতি বছর অমিতাভ ঘোষকে আমাদের সময়ের অন্যতম সেরা গল্পকথক হিসেবে সম্মানিত করেছে। তিনি দারুণ কিছু সৃষ্টি করেছেন, প্রতিটিই তার ভাষাগত দক্ষতা, তার ঐতিহাসিক গবেষণার গভীরতা ও তার উপন্যাসক চরিত্রের বিপুল বিস্তারের সক্ষমতার প্রমাণ দিচ্ছে।
তার বইগুলো কিছু গল্প ও কিছু চরিত্রের অনুসন্ধানই নয়, বরং একটি যুগ, একটি ধারা, একটি একক সত্তার পরিস্ফূটন। দি গ্লাস প্যালেসের (২০০০) মতো বইগুলো মোটেই ফিকশন নয়, বরং সেইসাথে চমৎকার ইতিহাসও।
তারপর দি গ্রেট ডেরেঞ্জমেন্ট (২০১৬) প্রকাশিত হয়েছে। এটি নন-ফিকশন গ্রন্থ। এতে ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয় ও এর প্রতি আমাদের চোখ বুঝে থাকার বিষয়টিই তুলে ধরেছেন। তার সৃষ্টিশীল সফরের একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবেই আমরা একে চিহ্নিত করতে পারি। তার গ্রন্থে প্রকৃতি, বন্যা, ঝড় বারবার আসে, সম্ভবত তার অবচেতন মনের তাড়নায়। শিল্প ও উপন্যাসে জলবায়ু পরিবর্তনকে অগ্রাহ্য করা হয় কেন, তিনি সে দিকেও প্রশ্ন সৃষ্টি করেছেন এই বইটির মাধ্যমে।
এই অগ্রাহ্য অবস্থা সংশোধন করতেই ‘গান আইল্যান্ড’ তার দারুণ সব চরিত্র নিয়ে সুন্দরবন থেকে ভেনিস যাত্রা করে, অতীত ও বর্তমানকে সামনে নিয়ে আসে, বিশ্ব যে নজিরবিহীন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আমরা যে সমাপ্তির দিকে যাত্রাকে বুঝতে পারছি না, সে দিকে নজর দিয়েছেন।
স্থির দর্শন
বর্ণনাকারী দীন ব্রুকলিনভিত্তিক দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের ব্যবসায়ী। তিনি কলকাতা সফর করেন বন্দুকি সওদাগরের (দি গান মার্চেন্ট) একটি আশ্চর্য কাহিনী শুনে। তার লক্ষ্য সুন্দরবন যাওয়া। সেখানে এক প্রাচীন ইটের আখড়ায় এখনো বন্দুকি সওদাগরের সাথে সর্পদেবী মনসার দ্বন্দ্বযুদ্ধের কিংবদন্তির ছাপ রয়েছে। তরুণ টিপুকে চন্দ্র গোখড়ার দংশনের কাহিনী এতে প্রকাশিত হয়েছে। টিপু বেঁচে যান তিনিই প্রাচীন বিশ্বের সাথে আধুনিক দুনিয়ার, পাশ্চাত্যের সাথে প্রাচ্যকে, মানুষকে অমানবীয় সত্ত্বার সাথে সংযোগ সাধন করিয়ে দেন।
বর্তমানে যে পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, সেটাকে সম্ভবত সংশোধন করা যাবে না। ঘোষও সচেতনভাবে তা জানেন। এ ধরনের অনিবার্যতার মুখে ঘোষ দৃশ্যত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কুইকজোটের তাগিদে নিজেকে বায়ুকলে নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেন। গান আইল্যান্ডের উপজীব্য আসলে সবকিছুই। এখানে জাদু, কল্পকথা, ইতিহাস, বিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, পরিবেশবিদ্যা সবকিছুই আছে। এটা জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক, তবে আকস্মিকভাবে এটি অভিবাসন আর মানবপাচারের বিষয়ও।
ফিকশন ঈর্ষাকাতর প্রণয়পাত্রীর মতো, লেখকের বিশ্বস্ততা দাবি করে। যখনই সে প্রতিদ্বন্দ্বিতার গন্ধ পায়, এখানে তা হলো ‘কারণ’, তখনই সে ওঠে চলে যায়। একটি পরিবেশবাদী উপন্যাস লেখার প্রতি তিনি নিজেকে এতই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছিলেন যে ঘোষ তার প্রণয়পাত্রীর অপছন্দের শিকার হয়ে পড়েন। প্রতিটি বাঁকেই তার থিমই প্রাধান্য পায়, তার গল্পকাহিনীকেও তা ছাপিয়ে যায়। চরিত্রগুলো যদি কেবল তথ্য প্রদানের হাতিয়ারে পরিণত হয়, তবে সেগুলো আর ফুটে ওঠে না। বর্ণনাকারী দীন নিস্তেজ হয়ে পড়েন। একবার তিনি একেবারে নির্ভুলভাবে বলেন, তাকে যেভাবে তার ইতালিয়ান বন্ধু চিন্তা করে, যেভাবে দেখে, তিনি তা জানেন না। প্রিয়া দি হাঙ্গরি টাইড থেকে এই বইটি ফেরত দেন, কিন্তু বইটি তেমন আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারে না।
ছকবাঁধা পথ
জীবন ও ঘটনাপ্রবাহ অনিবার্য পথে আগায় না। তবে তারা সামনে বাড়তে থাকে, একটি জায়গার দিকে যেতে থাকে। সন্ধ্যায় হাঁটাহাঁটির সময় চিন্তা ও দীন শিপওয়ার্মের সাক্ষাত পান। সাগরের পানির উষ্ণতা বাড়ার কারণেই এই প্রাণিটির ব্যাপকতা বাড়ছে। প্রাণিটি এখন ভেনিসের কাঠের পাইলিং খেয়ে ফেলছে। বিচে হাঁটার সময় মৃত একটি হলুদ বুকের সামুদ্রিক সাপের উপস্থিতি অস্বাভাবিক ঠেকে। কেউ হয়তো ভাবতে পারে, জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক একটি উপন্যাসে এমনটি ঘটা অনিবার্য। ভালো যুক্তি, কিন্তু এগুলো হাজির হয় আগেভাগে তৈরী রাখা ব্যবস্থা হিসেবে। রচনাকারী শেষ কী কী সামনে নিয়ে আসবেন, সবই যেন আগেই নির্ধারণ করে রেখেছিলেন।
দি গ্রেট ডেরেঞ্জমেন্টে ঘোষ মনে করেছিলেন, টর্নেডো হবে যথার্থ বিষয়। আবার বাস্তবতার বদলে আরব্য রজনীর মতো প্রাক-আধুনিক বর্ণনাগুলো বসাবেন কিনা তাও ভেবেছেন।
গান আইল্যান্ডে ঘোষকে উভয় সঙ্কটের সাথে লড়তে হয়েছে। জাদু লড়াই করছে বাস্তব দুনিয়ার সাথে এবং বাস্তবতাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে। তিনি পরাবস্তবতার দিকে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নিজেকে তা থেকে বিরতই রেখেছেন।
তবে তিনি তার গল্পকে রহস্যময় সুন্দরবনের কাদা আর সবুজ পানিতে নিয়ে গেছেন। টিপু আর রাফির মিলন স্বাভাবিক ও গতিশীল। প্রাচীন কিংবদন্তিকে রহস্যজনক আধুনিক প্রকাশে অপার্থিব কিছুর সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দেয়। ঘোষ পারতেন মনসা দেবীকেই তার পথ দেখানোর সুযোগ করে দিতে।
আমরা বর্তমানে সুনামি, টর্নোডো, গলতে থাকা বরফ, মৃত পাখির মতো আমাদের বোধশক্তির বাইরে থাকা অনেক কিছুর মুখোমুখি হওয়ার মতো অবস্থায় রয়েছি। আর শিল্পকলা যেভাবে যুদ্ধ বা সন্ত্রাসের মোকাবিলা করেছে, সেভাবেই সাড়া দেয়ার পথ খুঁজে নিতে হবে। এই সফরে ঘোষ পরীক্ষামূলক প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তবে তার আসলে প্রয়োজন তার কৃতিত্বকে উদ্ভাসিত করার জন্য ঘষামাজা করা।

No comments

Powered by Blogger.