কর্তৃত্বপরায়ণ পুঁজিবাদের উত্থানে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আধিপত্য হারাচ্ছে গণতন্ত্র by ফ্রেডেরিক কেম্পে

গত ৪ঠা জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য ও তার সব সামরিক অনুষঙ্গে এক মিনি ড্রামা সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ২৪৩তম বার্ষিকীতে বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক অবনমনের বিষয়টি আরো বেশি উল্লেখযোগ্য। এমন উল্লেখযোগ্য ইস্যু থেকে ট্রাম্পের ওই ড্রামায় কারো মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেয়া উচিত হবে না।
যে গণতান্ত্রিক আদর্শে যুক্তরাষ্ট্রের বিপ্লব অনুপ্রাণিত হয়েছিল তার প্রতি ভয়াবহতা ত্বরান্বিত হচ্ছে। বর্তমান প্রবণতায় যদি অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনা না ঘটে- যেমন ধরুন চীনে একটি গণতান্ত্রিক উত্থান, রাশিয়ায় শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন অথবা আরো উল্লেখযোগ্য হলো ভেনিজুয়েলায় স্বৈরাচারের অবনমন না ঘটে তাহলে সামনের দশকের মধ্যেই অর্থনীতির আকারের দিক থেকে গণতন্ত্রকে অতিক্রম করে যাবে স্বৈরাচারী শক্তিগুলো এবং প্রভাব বিস্তার করবে।
ইতিহাস দেখিয়ে দিয়েছে আধিপত্যবাদী রাজনীতি নিয়ে আসে সমৃদ্ধি।
বর্তমানে ব্যাপকভাবে রিপোর্টে যে বিষয়টি বলা হয়েছে, তাহলো বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ১৩তম বছরে অবনমন ঘটছে। এর ফলে স্বৈরাচার উদার গণতন্ত্রের স্বাধীনতাকে রাশিয়া ও চীনের মতো দেশ ভীত করে তুলেছে এবং পশ্চিমা আত্মতুষ্টিকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলছে।
২০১৯ সালে ফ্রিডম হাউস রিপোর্টে বলেছে, বিগত বিংশ শতাব্দীর অর্জনের তুলনায় এখনও সার্বিকভাবে ক্ষতি স্বল্প। এই প্রবণতা সঙ্গতিপূর্ণ এবং অমঙ্গলজনক।
কম স্বীকৃত কিন্তু অধিকন্তু নিশ্চিত হলো, বর্তমান প্রবণতার অধীনে আগামী ৫ বছরের মধ্যে বৈশ্বিক আয়ের অর্ধেকের বেশি আসবে স্বৈরাচারী দেশগুলো থেকে। এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথমবারের মতো এমনটা ঘটবে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ)-এর বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্তো স্টেফান ফোয়া এবং ইয়াসচা মৌউঙ্কের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এ কথা বলা হয়েছে।
১৯৫০-এর দশক ও ১৯৬০-এর দশকে, যখন আইজেনহাওয়ার ও কেনেডি প্রশাসন তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের স্পুটনিক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সফল জবাব দিয়েছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে তাদের গণতান্ত্রিক মিত্ররা ও জাপান বৈশ্বিক অর্থনীতিতে দুই-তৃতীয়াংশ অবদান রেখে চলেছিল। অতি সম্প্রতি, যেমন ১৯৯০ এ, যেসব দেশ ফ্রিডম হাউস থেকে অগণতান্ত্রিক খেতাব পেয়েছে তারা বৈশ্বিক অর্থনীতির উপার্জনে শতকরা মাত্র ১২ ভাগ সরবরাহ দিতে পেরেছে। এখন তারা এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন করে, যেটা কিনা ১৯৩০-এর দশকে ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থানের সময় স্বৈরাচার পরিচালিত অর্থনীতির অর্জনের সঙ্গে তুলনীয়।
এর ফলে অনিষ্পন্ন কিছু প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিবিশেষের অধিকারের মতো পশ্চিমা মূল্যবোধের আকর্ষণ থেকে কতটা গণতান্ত্রিক সফলতা এসেছে? এর পরিবর্তে নতুন গণতন্ত্রগুলো চাইছে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের সমৃদ্ধিকে ঝাঁকুনি দিতে। তার ফলই বা কতটুকু এবং তারা সোভিয়েতের কাছ থেকে ও অন্যদের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা থেকে, যাদের কাঠামো একই রকম, ঋণখেলাপি থেকে কতটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে?
এটা ছিল অবশ্যই উভয় বিষয়ের মিশ্রণে তৈরি একটি ফল। স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে অধিকতর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হবে গণতন্ত্রকে, যদি তারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তুলনামূলক কম সমৃদ্ধি অর্জন করেও।
ফোয়া ও মৌউঙ্ক লিখেছেন, যদি পশ্চিমকে এই নতুন বিশ্বের সফলতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়, তাহলে এটা অনুধাবন করা প্রয়োজন যে, কত দ্রুত গণতান্ত্রিক আধিপত্য থেকে কর্তৃত্ববাদে পুনরুত্থান ঘটছে। তারা তাদের লেখায় স্বৈরতান্ত্রিক পুঁজিবাদের উত্থানের জন্য দুর্বল হয়ে পড়া গণতন্ত্রের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টরের কথা বলেছেন।
এর আগে তারা লিখেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো অথবা দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, পর্তুগাল, গ্রিস ও অন্য সাবেক সামরিক শাসকগোষ্ঠীর মতো দেশে, যেখানে আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছিল স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী, তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর বাইরে থাকে সিঙ্গাপুর, যা একটি অগণতান্ত্রিক, তারা সমৃদ্ধি অব্যহাত রাখে, যদিও ইতিহাসে তাদের আকৃতি অপর্যাপ্ত।
ফোয়া ও মৌউঙ্ক লিখেছেন, ক্রমবর্ধমান সংখ্যক দেশ শিখে গেছে স্বৈরাচারী শাসনের সঙ্গে বাজার-বান্ধব প্রতিষ্ঠানকে এক করে ফেলতে। যে অবস্থানে গণতান্ত্রিক পটপরিবর্তন হয় তাকে পেছনে ফেলে তারা অব্যাহতভাবে অর্থনৈতিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যদি এমন কোনো সংশয় থাকে যে, বর্তমান সময়ের স্বৈরাচাররা নিজেদের উদার গণতন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবরুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করেন এবং তারা নিজেদের বিজয়ী হিসেবে ভাবেন, যেটা গত সপ্তাহে বেরিয়ে এসেছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের লিওনেল বারবার ও হেনরি ফোই-এর সাক্ষাৎকারে।
জাপানের ওসাকায় জি ২০ শীর্ষ সম্মেলনের প্রাক্কালে পুতিন বলেছেন, উদার ধারণা তার উদ্দেশ্যকে অতিক্রম করেছে। উদারপন্থিরা কোনো কিছু কারো উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না, যেমনটা তারা সাম্প্রতিক দশকগুলোতে চেষ্টা করেছেন।
পুতিন অন্যদের চেয়ে বেশ ভালোই জানেন যে, এই ইতিহাস এখনও পূর্ণাঙ্গভাবে লেখা হয় নি।
প্রথমত, স্বৈরতন্ত্রে মৌলিক দুর্বলতা ও অনমনীয়তা তাদেরকে ঠুনকো করে তোলে। তাদের সরকারি ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে যেভাবে তার বাইরে গিয়ে তারা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা প্রসারিত করার জনপ্রিয় প্রচেষ্টা চালায়।
পলিটিকো’র ফ্রিদা ঘিতিস সাম্প্রতিক তিনটি ইভেন্ট তুলে ধরেছেন, যা নির্ণায়ক থেকে দূরে, তা জুনকে স্বৈরাচারদের জন্য একটি বাজে মাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
হংকংয়ের অধিবাসীদের ওপর একটি প্রত্যাবর্তন বিষয়ক বিল চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল চীন। তার বিরুদ্ধে বিরাট আকারের এবং কঠোর হংকং প্রতিবাদের মুখোমুখি হন চীনের নেতা শি জিনপিং। এদিকে আটক সাংবাদিকের পক্ষে জনগণ এবং মিডিয়া ব্যাপকভাবে সমর্থন দেয়ার পর অনুসন্ধানী সাংবাদিক ইভান গোলুনভের বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ প্রত্যাহার করেন রাশিয়ার পুতিন।
এ ছাড়াও তুরস্কের গণতন্ত্র একটি নতুন জীবন দেখতে পেয়েছে সেখানে ইস্তাম্বুলে মেয়র পদে উপ-নির্বাচনের মাধ্যমে। ওই নির্বাচনে অধিকতর এবং ভূমিধস বিজয় পেয়েছেন বিরোধী দলীয় প্রার্থী একরেম ইমামোগলু। তাকে ঘিতিস দেখে থাকেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোগানের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসন ও ধীর গতির অর্থনীতির বিরুদ্ধে একটি বড় আঘাত হিসেবে।
দ্বিতীয়ত, এই হিসাবগুলো আবার গণতন্ত্রের দিকে ঠেলে দিতে পারে। ভারত, নাইজেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো বড় বড় দেশগুলো কেবল সমৃদ্ধ গণতন্ত্র হিসেবেই স্থিতিশীল নয়, বরং বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদের বিরোধী অংশ হিসেবে তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে।
চূড়ান্ত দফায়, গণতান্ত্রিক শাসনকে উদ্বুদ্ধকরণ, টেকসই ও বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকাকে আবার আলিঙ্গন করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। এর শুরু হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে নিঃসঙ্গ এক বিপ্লবী গণতন্ত্র হিসেবে। তাতে দূরে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল রাজতন্ত্রের শাসনের শেকল। তারা শীতলযুদ্ধ পরবর্তীতে ইউরোপের নেতাদের সঙ্গে কাজ করেছে একটি গণতান্ত্রিক সম্প্রদায় সৃষ্টিতে। এর মধ্য দিয়ে ইতিহাসে প্রথমবার বৈশ্বিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক সেই উদ্দেশ্য পুনরুদ্ধারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে অসম্ভাব্য হতে পারেন বলে মনে হয়। সমালোচকরা তার কঠোর মনোভাবাপন্ন প্রবণতা ও শি জিনপিং, ভ্লাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের মতো স্বৈরাচারদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার নিন্দা করেন। তবে তার রেকর্ডে আছে, ভেনিজুয়েলায় গণতান্ত্রিকভাবে স্বৈরাচার মাদুরোকে সরিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা, চীনের রাষ্ট্রীয় নেতাদের দ্বারা অন্যায্য বাণিজ্যিক চর্চাকে টার্গেট করা, ইরানের মোল্লা ও তাদের রেভ্যুলুশনারি গার্ড কোরের বিরোধিতা।
এ সপ্তাহে লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি সঠিক কথাই বলেছেন।
ট্রাম্প বলেছেন, আমরা যখন এই সন্ধ্যায় এখানে সমবেত হয়েছি স্বাধীনতার আনন্দে, তখন আমরা স্মরণ করি, আমরা একটি সত্যিকার অসাধারণ ঐতিহ্যকে সবাই শেয়ার করি। আমরা সবাই মিলে, সবচেয়ে বেশি বলা হয় যে গল্প, সেই আমেরিকার কাহিনীর অংশ।
৫০৮ খিস্টপূর্বাব্দে গণতন্ত্রের জন্ম এথেন্সে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে দুই হাজার বছর তা ছিল সুপ্ত অবস্থায়। রবার্ট কেগান আমাদেরকে মনে করিয়ে দেন যে, র‌্যাডিক্যাল উদার নীতির ওপর একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ১৭০০এর দশকে উত্থান ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের। মহৎ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারকারীদের মধ্যে একে দেখা হয় একটি অ্যালার্ম হিসেবে।
তখন থেকেই, গণতন্ত্রের কেন্দ্রে অবস্থান করছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেই গণতান্ত্রিক সম্প্রসারণকে উদ্বুদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইউরোপের ফ্যাসিবাদের মুখে পড়ে যখন গণতন্ত্রের অবনমন হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র চুপচাপ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তারা টিকে থাকার জন্য লড়াই করছিল এবং শীতল যুদ্ধে বিজয়ের জন্য চেষ্টা করছিল, যা ছিল গণতন্ত্রের চূড়ান্ত বিজয়।
এই নতুন সংগ্রামকে শূন্য হতে দেয়া যাবে না। যদি স্বৈরাচারী দেশগুলো বিশাল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্লক তৈরি করে, যদি প্রত্যাশা করে অন্যদেরকে তারা অনুমোদন দেবে না ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণকারী আইন প্রণয়নে।
(ফ্রেডেরিক কেম্পে হলেন বেস্ট-সেলার লেখক, পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক। আটলান্টিক কাউন্সিলের সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। আটলান্টিক কাউন্সিল হলো বৈশ্বিক সম্পর্ক বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী থিং ট্যাংকের অন্যতম। ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রতিনিধি হিসেবে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে কাজ করেছেন ফ্রেডেরিক কেম্পে। এ ছাড়া তিনি এ পত্রিকাটির সহকারী ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ইউরোপীয় সংস্করণের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সর্বশেষ বই- ‘বার্লিন ১৯৬১: কেনেডি, ক্রুশ্চেভ, অ্যান্ড দ্য মোস্ট ড্যাঞ্জারাস প্লেস অন আর্থ’ হলো নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার। এটি এক ডজনেরও বেশি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। তার এ লেখাটি অনলাইন সিএনবিসি থেকে অনূদিত)

No comments

Powered by Blogger.