ভুটানের সুখের মন্ত্র ও মূল্যবোধ-ভিত্তিক শিক্ষা by জুলফিকলি আব্দুল রাজাক

একটি রোড সাইনে লেখা “৫০ কিমি/ঘ. গতিসীমা মেনে চলুন”। আরেকটিতে লেখা “তাড়াহুড়া করলে উদ্বেগে পড়তে হবে।” পৃথিবীর বুকে শেষ সাং-গ্রিলা – ভুটানে স্বাগতম। বিশ্বের একমাত্র কার্বন নেগেটিভ দেশটি বলে দিচ্ছে তারা দেশের পরিবেশকে ধরে রাখতে আর “সুখী” থাকতে কতটা ব্যাকুল।

এই ধারণার ইতিহাস ঘাটতে হলে ১৬২৯ সালে ফিরে যেতে হবে, যখন এই “সুখ” ভাবনার উদ্ভব। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, জাবদ্রুং নাগাওয়াং নামগিয়াল নামে এক লোক বলেছিলেন: সরকার যদি প্রজাদের সুখ দিতে না পারে তাহলে সেই সরকার থাকার কোন মানে হয় না।

কি সত্যি কথাই না তিনি বলেছিলেন! আজকের প্রেক্ষাপটে এর প্রতিটি অক্ষর সত্যি।

এই ক্ষুদ্র ও লোক চক্ষুর আড়ালে থাকা রাষ্ট্র ভুটান ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে এক সাহসী ঘোষণা দেয়: “গ্রোস ন্যাশনাল প্রডাক্ট (জিএনপি) থেকে গ্রোস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস (জিএনএইচ) অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।” এটা অনেককে অবাক করেছে। ওই গভীর নীতিমালাটি অনেকে বিস্মৃত হলেও বাকি বিশ্ব পরবর্তীতে সেখানেই ফিরে গেছে।

সন্দেহ পোষণ না করলেও জিএনএইচ ধারণাকে ‘অবাস্তব’ আখ্যা দিয়ে বাতিল করে দেন অনেকে। কেউ কেউ বলেন হাস্যকর। কিন্তু ভুটান তার কথায় অটল ও দৃঢ় থাকে। যার ফলশ্রুতিতে ২০০৮ সালের সংবিধানে ৯ নং ধারায় গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করা হয়: ন্যাশনাল গ্রোস হ্যাপিনেসের অভিষ্ঠ লক্ষ্য হাসিল করতে পারবে এমন পরিবেশ জোরদারের চেষ্টা করবে রাষ্ট্র।

২০০৮ সালেই ভুটানে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি নতুন সরকার গঠিত হয় এবং তারা জিএনএইচ রক্ষার অঙ্গীকার করে। সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য ধ্বংসকারী বিশ্বায়নের কুফলগুলো থেকে দেশকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়।

দেশের রাজপরিবার থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে সবকিছুতে এর প্রমাণ মেলে। কাউকে হিমালয় পর্বতমালার কোন চূড়ায় উঠতে দেয়া হয় না। এগুলোকে প্রাকৃতিকভাবে পবিত্র বলে গণ্য করা হয়।

অনেকটা তরুণ ৩৯ বছর বয়সী রাজা জিগমে খেসার নামগিয়ার ওয়াংচুকের মতে: জিএনএইচ সার্বিকভাবে একটি দেশের মান পরিমাপ করে। এটা বিশ্বাস করে যে কোন দেশের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উন্নয়ন পাশাপাশি ঘটলেই মানব সমাজের জন্য সেটা হবে উপকারী উন্নয়ন। এই উন্নয়ন হবে পরস্পরের জন্য সম্পূরক ও শক্তিবর্ধক।

অন্য কথায় এটা হলো মধ্যমপন্থা যা প্রতীচ্যের বিজয়ী দর্শন এবং জীবন ব্যবস্থা।

দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে জিএনএইচ মানে হলো – উন্নয়নের একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও সার্বিক ধারণা। তার সেই বিবৃতি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। এ ব্যাপারে রাজা বলেন, জাতীয় সচেতনতা আমাদেরকে (ভুটানিদের) একটি উন্নততর ভবিষ্যতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে চালিত করে।

আর সে কারণেই রয়্যাল ইউনিভার্সিটি অব ভুটানের পারো কলেজ অব এডুকেশনের গবেষণা হচ্ছে জিএনএইচ-ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে। এর লক্ষ্য হলো দয়া, সাম্য, সহানুভুতি ও মানবতার মতো নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে বস্তুগত উন্নয়নের সেতুবন্ধন রচনা।

মানুষের সত্যিকারের সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে সত্যিকারের মানুষ তৈরি এর লক্ষ্য। কোন মানব পুঁজি তৈরি এর লক্ষ্য নয়।

দেশটির জাতীয় শিক্ষা দর্শনে এই আকাঙ্ক্ষাগুলোর প্রতিফলন ঘটেছে, যাতে ভারসাম্যপূর্ণ ও সুসঙ্গত মানব লালনের কথা বলা হয়েছে। আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, জিএনএইচ এমন মানুষ তৈরি করবে যারা বিশ্বকে বোঝার ক্ষেত্রে চিন্তাশীল ও বিশ্লেষণধর্মী মনন সম্পন্ন হবে, লোভ ও অত্যধিক কামনা থেকে মুক্ত হবে।

আসলে মনযোগ অনুশীলন করাই দেশটির মন্ত্র যা ভুটানকে জাগ্রত ও শালীন করে রেখেছে। তাই দেশটি এই গ্লোবালাইজড বিশ্বের কাছে অনুকরণীয়।

>>>লেখক ইউনিভার্সিটি সাইন্স মালয়েশিয়ার সেন্টার ফর পলিসি রিসার্স এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ফেলো।

No comments

Powered by Blogger.