নতুন করে হিজবুল্লাহ ও ইসরাইলের মধ্যকার উত্তেজনা ও সংঘাতের কারণ

হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা
ইহুদিবাদী ইসরাইল ২০০৬ সালে লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংঘটিত ৩৩ দিনের যুদ্ধে পরাজয়ের তিক্ত স্মৃতি আজো ভুলতে পারেনি। সুযোগ পেলেই তারা লেবাননে হামলা চালিয়ে প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করে। সর্বশেষ গত ২৫ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিজবুল্লাহ ও ইসরাইলের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ও হামলা পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে।

হিজবুল্লাহ-ইসরাইল সর্বশেষ সংঘর্ষ থেকে ইসরাইলের আগ্রাসী ও সম্প্রসারণবাদী নীতির পরিচয় পাওয়া যায়। গত ২৫ আগস্ট ইসরাইল দুটি ড্রোন দিয়ে লেবাননে হামলা চালায়। প্রথম ড্রোনের হামলায় কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও দ্বিতীয় ড্রোনের হামলায় হিজবুল্লাহর প্রচার দফতরের একটি ভবনের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর আগেও ইসরাইল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের দক্ষিণে অবস্থিত হিজবুল্লাহর একটি সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ওই ঘটনায় দু'জন শহীদ হন। কয়েক দফা এসব হামলার পর হিজবুল্লাহ মহাসচিব সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ ইসরাইলি হামলার শক্ত জবাব দেয়া হবে বলে ঘোষণা দেন। এরপরই ১ সেপ্টেম্বর পাল্টা হামলা চালিয়ে তিনি প্রতিশোধ নেন। ২০০৬ সালের ৩৩ দিনের যুদ্ধের পর এটিই ছিল ভারি অস্ত্রের যুদ্ধ। গায়ে পড়ে নতুন করে হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার পেছনে ইসরাইলের অন্যতম একটি কারণ ছিল আসন্ন নির্বাচন। কেননা ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও যুদ্ধমন্ত্রীও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভাল অবস্থানে নেই।

এ অবস্থায় দেশের ভেতরে নিজের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার জন্য নেতানিয়াহুর সামনে দুটি লক্ষ্য রয়েছে। প্রথমত, আমেরিকার প্রস্তাবিত 'ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরি' পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা ও এ থেকে ফায়দা হাসিল করা। ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উপায় খুঁজে বের করার জন্য গত জুনে বাহরাইনের রাজধানী মানামায় আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জামাতা ও নেতানিয়াহুর অতি ঘনিষ্ঠ জারেড কুশনার 'ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরি' পরিকল্পনার প্রতি আরব দেশগুলোর সমর্থন আদায়ের জন্য ব্যাপক চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু তার ওই প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। কারণ সবার সমর্থন না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবের বিস্তারিত আর প্রকাশ করা হয়নি। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতিকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগানো। গত মে মাসে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলায় যুদ্ধ মাত্র দুই দিন স্থায়ী হয় এবং ইসরাইল যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য হয়।

এরপর ইসরাইল যুদ্ধ কৌশল পাল্টে ফেলে এবং ইরাকে অবস্থিত প্রতিরোধ সংগঠন হাশদ্‌ আশ্‌ শাবি এবং সিরিয়ার সেনা অবস্থানের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এ ছাড়া, লেবাননের হিজবুল্লাহর অবস্থানেও সীমিত পর্যায়ে হামলা চালায় ইসরাইল। লেবাননের দৈনিক আল আখবার এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে লিখেছে, "ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু লেবাননের বিরুদ্ধে ছোট বড় হামলা চালিয়ে আসলে ইসরাইলিদের সমর্থন লাভের চেষ্টা করছেন যাতে নির্বাচনে বিজয় লাভ করা যায়। অর্থাৎ তিনি অভ্যন্তরীণ ফায়দা হাসিল ও ব্যক্তিগত স্বার্থের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। আর এটাই লেবাননে হামলার প্রধান কারণ।"  লেবাননের হিজবুল্লাহ মহাসচিব সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহও গত ২৫ আগস্ট এক ভাষণে বলেছেন, নেতানিয়াহু আসলে নির্বাচনে জেতার জন্যই সম্প্রতি লেবাননে হামলা চালিয়েছে।

ইসরাইলের সাম্প্রতিক আগ্রাসনের প্রতিশোধ হিসেবে লেবাননের হিজবুল্লাহও পাল্টা হামিলা চালিয়ে ইসরাইলকে সতর্ক করে দিয়েছে। ইসরাইলে হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র হামলার উদ্দেশ্য সেখানকার নির্বাচনকে প্রভাবিত করা নয় বরং প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইসরাইলকে এটা দেখিয়ে দেয়া যে তাদের যেকোনো হামলা বিনা জবাবে পার পাবে না। হিজবুল্লাহ সংগঠন ইসরাইলি নেতৃবৃন্দ ও তাদের সমর্থকদের এটাও বুঝিয়ে দিয়েছে যে, হামলা করে পালিয়ে যাওয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে। পাল্টা হামলা সম্পর্কে হিজবুল্লাহ মহাসচিব নাসরুল্লাহ বলেন, আগ্রাসন না চালাতে আমরা ইসরাইলকে বাধ্য করব।

যাইহোক, হিজবুল্লাহর এ নীতি আত্মরক্ষামূলক এবং তারা এটাও প্রমাণ করেছে যে, হিজবুল্লাহ কখনো যুদ্ধের সূচনাকারী নয়। কিন্তু যেকোনো আগ্রাসনের কঠোর জবাব দিতে তারা কুণ্ঠাবোধ করবে না। হিজবুল্লাহর পাল্টা হামলার লক্ষ্য কেবল সংগঠনকে রক্ষা করা নয়। এ ব্যাপারে সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ যেমনটি বলেছেন, "গোটা লেবাননের নিরাপত্তা বিধান করা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ হিজবুল্লাহ লেবাননের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বাইরের কিছু নয়।"

ইসরাইলে হিজবুল্লাহর পাল্টা আঘাতের তৃতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে, তারা যদি জবাব না দিত তাহলে ইসরাইল আবারো হামলার ধৃষ্টতা দেখাতো। হিজবুল্লাহর জবাবের কারণে দখলদার ইসরাইল হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র  ও অন্যান্য সামরিক শক্তি সম্পর্কে অবহিত হতে পেরেছে এবং এই সংগঠনের নেতার বক্তব্যের দৃঢ়তার বিষয়টিও তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে। সুতরাং তারা বুদ্ধিমান হলে লেবানন কিংবা হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে আর আগ্রাসনের সাহস পাবে না।

ইসরাইলে হিজবুল্লাহর পাল্টা আঘাতের চতুর্থ উদ্দেশ্য হচ্ছে, হিজবুল্লাহ এটা দেখিয়ে দিয়েছে, তারা ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধ চায় না কিন্তু যেকোনো মূল্যে লেবাননসহ গোটা পশ্চিম এশিয়ার নিরাপত্তা রক্ষা করবে। অন্যদিকে ইসরাইলিরা খুব ভাল করেই জানে বৈরুতে ইসরাইলের ড্রোন হামলার জবাবেই হিজবুল্লাহ পাল্টা হামলা চালিয়েছে। তাই বৃহত্তর যুদ্ধ শুরুর কোনো কারণ নেই।

১৯৮৫ সালে লেবাননে ইসরাইল বিরোধী প্রতিরোধ সংগঠন হিজবুল্লাহ গড়ে ওঠে। এরপর গত ৩৪ বছরে হিজবুল্লাহ এ অঞ্চলে অত্যন্ত সুসংগঠিত সংগঠন ও বিরাট শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এটি বর্তমানে লেবাননের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগঠন যার প্রমাণ ২০১৮ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে তাদের অভাবনীয় বিজয়। ওই নির্বাচনে প্রতিরোধ জোট ১২৮টি আসনের মধ্যে ৬৮টি আসন পেয়ে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। শুধু লেবাননের ভেতরেই নয় একইসঙ্গে সমগ্র পশ্চিম এশিয়ায়ও হিজবুল্লাহ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। এ কারণে চিন্তিত হয়ে পড়েছে আমেরিকা, ইসরাইল ও সৌদি আরব। এই তিন অপশক্তি হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে এবং এ সংগঠনকে সন্ত্রাসী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। আমেরিকা ও সৌদি আরবের ধারণা হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী তালিকায় ফেলে নিষেধাজ্ঞা দিলে মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিশোধ শক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। কিন্তু সিরিয়া সংকটে হিজবুল্লাহর গঠনমূলক ভূমিকা ও জনপ্রিয়তা এবং হিজবুল্লাহর প্রভাব বিস্তারে ইসরাইলের আতঙ্কিত হয়ে পড়া থেকে বোঝা যায়, এ সংগঠন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বীরবিক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে।

মোটকথা, মধ্যপ্রাচ্যে হিজবুল্লাহসহ অন্যান্য প্রতিরোধ সংগঠনগুলোর প্রতি এ অঞ্চলের জনগণের সমর্থন দেয়া থেকে বোঝা যায়, প্রতিরোধ শক্তিগুলো ভালই প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। এ প্রসঙ্গে, লেবাননের হিজবুল্লাহ ছাড়াও ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠনগুলো, ইরাকের হাশদ্‌ আশ্‌ শাবি জোট ও ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ সংগঠনের কথা উল্লেখ করা যায়। এ সংগঠনগুলোর যেমন জনভিত্তি রয়েছে তেমনি আদর্শিকভাবেও তারা সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ। এ কারণে তাদের দমনের জন্য শত্রুদের সব ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ হয়েছে। আমেরিকা ও ইসরাইলের সমর্থন নিয়ে সৌদি আরব ২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেনের আনসারুল্লাহর বিরুদ্ধে হামলা চালিয়ে আসলেও আনসারুল্লাকে তারা দমন করতে তো পারেনি বরং এ সংগঠন আরো শক্তিশালী হয়েছে।
হিজবুল্লাহর হাতে ভূপাতি ইসরাইলি ড্রোন

No comments

Powered by Blogger.