শক্তিপ্রয়োগে কাশ্মীর দখল করা হলে ভারতের প্রতিবেশীরা আনাকাঙ্ক্ষিত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে by রানা মিত্তর

গত ৫ মে কাশ্মীরী রাজনীতিবিদ মেহবুবা মুফতি এই ত্বরিত বার্তাটি পাঠান: ‘আজ জম্মু ও কাশ্মীরের পার্লামেন্ট ও সুপ্রিম কোর্টের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থা স্থাপনকারী জনগণ পরাজিত ও বিশ্বাসঘাতকতা অনুভব করছে। রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেওয়া ও প্রতারণামূলকভাবে আমাদের ন্যায়সঙ্গত ও আইনগত অধিকার কেড়ে নিয়ে তারা কাশ্মীর বিরোধকে আরো জটিল করে ফেলল।’

মুফতি চরমপন্থী বা খামখেয়ালিপূর্ণ কেউ নন। তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী, ২০১৬ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপির সাথে জোট গঠন করেছিলেন। ফলে তার সাবেক জোটকে মারাত্মক অভিযোগে অভিযুক্ত করার মধ্যে বিশেষ তীব্রতা রয়েছে। তার এই টুইটের আগে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার এমন এক সাংবিধানিক ক্যু করেন, যা ভারতের ইতিহাসে নজিরবিহীন।

এতে ঘোষণা করা হয়, ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য ভাগ করা হবে এবং এর স্বায়ত্বশাসন বিলুপ্ত করা হলো। ১৯৪৭ সালে কাশ্মীরের পাকিস্তানে না গিয়ে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অংশ হিসেবে অনুচ্ছেদ ৩৭০ যোগ করা হয়েছিল। এতে পররাষ্ট্র ছাড়া অন্য সব বিষয়ে রাজ্যটিকে বেশ বড় মাত্রায় স্বায়ত্বশাসন দেয়া হয়েছিল। গত মে মাসে বিপুলভাবে জয়ী হওয়া নির্বাচনের ইশতেহারে বিজেপি এই মর্যাদা বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু কোনো ধরনের পরামর্শ ছাড়াই বিজেপি তা করবে, তা কেউ প্রত্যাশা করেনি। গত সপ্তাহজুড়ে পুরো অঞ্চলে ব্যাপকভাবে সামরিকিকরণ করা হয়। ঘোষণার পর মুফতি ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহসহ প্রখ্যাত রাজনীতিবিদদের গৃহবন্দী করা হয়। মুফতি ২৪ ঘণ্টা ধরে টুইট করতে পারেননি।

ভারতের মানচিত্র তার সংবিধানের চেয়ে বেশি অপরিবর্তনীয় নয়। গত অর্ধ শত বছরে বিদ্যমান রাজ্যগুলো থেকে নতুন কয়েকটি রাজ্য গঠিত হয়েছে। তবে কাশ্মীর ভিন্ন। এর স্পর্শকাতরতা ও ভারসাম্যের জন্য বাকি ভারত থেকে এটি ছিল ভিন্ন, ঠিক যেমন উত্তর আয়ারল্যান্ড একইসাথে যুক্তরাজের অংশ, আবার এ থেকে ভিন্নও।

ইতিহাসে অনেক নজিরই আছে, যেখানে দেখা যায়, আকস্মিক বিভক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ১৯০৫ সালে ভারতের ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জন ঘোষণা করেন যে বাংলা ভাগ করা হবে। কিন্তু জাতীয়তাবাদী তীব্র কষাঘাতে ১৯১১ সালে পরের ভাইস রয় তা বাতিল করতে বাধ্য হন। নয়া দিল্লির বিজেপি সরকার সম্ভবত কাশ্মীর বিভক্ত করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী ব্যবহার করবেন। কিন্তু নানা নজিরে দেখা যায়, এ ধরনের দখলদারিত্ব শান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অধিকন্তু, গণতান্ত্রিক সমাজে পরিচিত ও জনবহুল সংখ্যালঘু কোনো এলাকাকে ধরে রাখলে দেশে বা বিদেশে ভাবমূর্তি ভালো হয় না।

আকস্মিক পদক্ষেপে মোদি সরকারের যুদ্ধাংদেহী মনোভাবও দেখা যায়। এ ধরনের আরেকটি নজির রয়েছে। ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী সরকার রাষ্ট্রপতির ডিক্রির মাধ্যমে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধীদের গ্রেফতার করা হয়, সংবাদপত্রগুলোর প্রকাশ স্থগিত করেন, গণতান্ত্রিক ও আইনগত রক্ষাকবচগুলো স্থগিত করা হয়। আপত দৃষ্টিতে কাশ্মীরে গৃহীত ব্যবস্থাদির সাথেও এর মিল রয়েছে। পার্লামেন্টে আলোচনা ছাড়াই সাংবিধানিক ক্ষমতার ব্যবহার, কাশ্মীরের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার, ইন্টারনেট ও টেলিকমগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

সাবেক অর্থমন্ত্রী অরুন জেটলির মতো ব্যক্তিরা টুইট করে বলেছেন যে এই পরিবর্তনের ফলে কাশ্মীরে আরো বেশি চাকরি ও বেশি রাজস্ব আদায় হবে। কিন্তু এই ধরনের অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য সাংবিধানিক ক্যু ও সামরিক শক্তি বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল না।

ভয় রয়েছে যে অকাশ্মীরীরা যাতে কাশ্মীরে জমি কিনতে পারে, সেই ব্যবস্থা করার জন্যই অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করা হয়েছে। আর ভূমি ক্রয়ের মাধ্যমে রাজ্যের জনসংখ্যায় দ্রুত পরিবর্তন করে এর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার অবসান ঘটানো হবে।

কেবল সম্পত্তির মালিকানাই নয়। আরো বিষয় রয়েছে। ১৯৪৭ সালে বলা হয়েছিল যে ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হবে না। এটা হবে সেক্যুলার রাষ্ট্র। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি সেক্যুলারবাদের অবসান ঘটিয়ে হিন্দুবাদকে সামনে নিয়ে আসতে চাইছেন।

ভারত সবসময়ই গর্ব করে বলত যে তারা রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করার জন্য সামরিক শক্তির চেয়ে সাংবিধানিক আইন প্রয়োগ করে। এখন দেখা গেল এটা ছিল ভণ্ডামি। ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী গত কয়েক দশকে বিপুলসংখ্যক লোককে হত্যা করেছে।

এসব কাজ ভারতের অন্তত একটি প্রতিবেশী দেখছে এবং তা থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। কাশ্মীর সঙ্কটের একই সপ্তাহে কয়েক হাজার মাইল পূর্বে হংকংয়ে গোলযোগ শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত বেইজিং তুলনামূলক সংযমের পরিচয় দিয়ে আসছে, সেখানকার বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থেকেছে। বিক্ষোভকারীদেরকে কঠোর পরিণামের হুঁশিয়ারি দিলেও এখন পর্যন্ত সৈন্য পাঠায়নি চীন। কাশ্মীরে ভারত সরকারের ভূমিকা বেইজিংয়ের নেতাদের ভাবার অবকাশ দেবে। তারা চিন্তা করবে, একটি গণতান্ত্রিক দেশ যদি শক্তি প্রয়োগ করে, খেয়ালখুশি মতো সেন্সরশিপ আরোপ করে, তবে একটি একনায়কতান্ত্রিক দেশ কেন উচ্চতর মানদণ্ড অনুসরণ করবে? দেশে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির যুদ্ধাংদেহী আচরণ হয়তো বৃহত্তর পরিমণ্ডলে আরো মারাত্মক প্রভাব ফেলবে, যেখানে স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে উদারব্যবস্থা সবচেয়ে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।

>>>লেখক: অধ্যাপক, আধুনিক চীনের ইতিহাস ও রাজনীতি, সেন্ট ক্রস কলেজ, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি

No comments

Powered by Blogger.