এনআরসি: অ-নাগরিকত্বের বিচারিক অনুমান by গৌতম ভাটিয়া

গত ১৭ মে একটি অতি সংক্ষিপ্ত শুনানির পর ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যবিশিষ্ট বেঞ্চ (প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈই, বিচারপতি দীপক গুপ্ত ও সঞ্জীব খান্না) আবদুল কুদ্দুস বনাম ইউনিয়ন অব ভারত শীর্ষক ১৫টি আবেদনের একটি ব্যাচের ওপর রায় দেন। ‘শিডিউল টু দি সিটিজেনশিপ (রেজিস্ট্রেশন অব সিটিজেন্স অ্যান্ড ইস্যু অব ন্যাশনাল আইডেনটিটি কার্ডস) রুলস, ২০০৩-এর দুটি প্যারাগ্রাফের মধ্যে ‘অনুমিত সঙ্ঘাত’ নিয়ে এই আবেদনটি দাখিল করা হয়েছিল। আসামে চলমান জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনে (এনআরসি) এই রুলটির অপরিসীম গুরুত্ব থাকলেও এ নিয়ে মিডিয়ায় তেমন আলোচনাই হয়নি।

দুটি সমান্তরাল প্রক্রিয়া

আবদুল কুদ্দুসের বিষয়টি কী? সংক্ষেপে বলা যায়, আসামে নাগরিকত্ব হারানো ব্যক্তিদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে পাঠানো যৌক্তিক কিনা তার সাথে এর সম্পৃক্ততা রয়েছে। আসামে আসলে নাগরিকত্ব নিয়ে দুটি প্রক্রিয়া চলছে। এর প্রথমটি হলো ফরেনার্সস ট্রাইব্যুনাল। এটি কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাহী আদেশে গঠন করা হয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো এনআরসি। এটি তদারকির দায়িত্বে রয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এই দুটি প্রক্রিয়া একটি অপরটির রক্তক্ষরণ করে চলেছে। ফলে কেউ যখন কোনো একটিতে বা উভয়টিতে জটিলতায় আটকে গেছে, তখন বড় ধরনের সমস্যায় পড়ছে।

আবদুল কুদ্দসের আবেদনে বলা হয়েছে, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের রায় কোনো নির্বাহী আদেশের চেয়ে বেশি মূল্যবান হতে পারে না। ফলে এখানে কেউ যদি নাগরিক নয় বলে ঘোষিত না হন, তবে তার মানে এই নয় যে তার নাম এনআরসি থেকে বাদ পড়ে যাবে। অধিকন্তু, নতুন কোনো নথি হাতে পাওয়া গেলে, ট্রাইব্যুনালের রায় সাথে সাথেই পর্যালোচনা করা হতে পারে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নাগরিকত্ব কার্যক্রমে অনেকবারই প্রশাসনিক ভুল দৃশ্যমান হয়েছে। আবেদনে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল ও এনআরসিকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখতে বলা হয়েছে। একটির আলোকে অপরটিতে কারো নাম থাকা বা না থাকার কোনো প্রভাব থাকা উচিত নয় বলে অভিমত প্রকাশ করা হয়।

ত্রুটিপূর্ণ ট্রাইব্যুনাল

সুপ্রিম কোর্ট আবেদনকারীদের যুক্তি খারিজ করে দিয়ে রায় দেয় যে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের ‘অভিমত’ ‘প্রায় বিচারিক রায়ের’ মতো গণ্য হবে। ফলে এনআরসি প্রস্তুতিসহ সব পক্ষকে এটি অনুসরণ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের ফলে লাখ লাখ লোকের অধিকারের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।

শুরুতেই বলা যায়, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম স্বাভাবিক আদালত হিসেবে কোনোভাবেই গণ্য করা যায় না। প্রথমত, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি সাধারণ নির্বাহী আদেশে। দ্বিতীয়ত, ট্রাইব্যুনালের যোগ্যতা বেশ শিথিল করা হয়েছে, এখানে বিচারিক অভিজ্ঞতা ন্যূনতম করা হয়েছে। তাছাড়া আমলাদের প্রভাব বেশি রাখা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, ট্রাইব্যুনাল ইচ্ছা করলেই সাক্ষীদের বক্তব্য বা প্রমাণ প্রত্যাখ্যান করতে পারে। এমনকি ট্রাইব্যুনালকে তার নিজের প্রক্রিয়া পর্যন্ত এড়িয়ে যাওয়ার কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে।

অথচ এসব ট্রাইব্যুনালেই গত কয়েক মাসে ৬৪ হাজার লোককে নাগরিক নয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

এমন অভিযোগও রয়েছে, এসব লোককে অনেক সময় ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির হওয়ার নোটিশ পর্যন্ত দেয়া হয়নি। আরো আতঙ্কের বিষয় হলো, মিডিয়া রিপোর্টে এক সাবেক ট্রাইব্যুনাল সদস্যের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে ওই সদস্যদের কে কত বেশি উইকেট নিতে পারে, তা নিয়ে কৌতুক করতে দেখা যায়। উইকেট নেয়া বলতে কে কত বেশি লোককে বিদেশী ঘোষণা করেছে, তাই বোঝানো হয়েছে।

অথচ, এসব রায়ের মাধ্যমে তারা একজনকে রাষ্ট্রহীন বলে ঘোষণা করছেন। এই রায়ের কত বিপুল প্রভাব তা কল্পনা করা যায় না। ফলে এসব মামলা অত্যন্ত যত্নের সাথে পরীক্ষা করার কথা। কিন্তু তা না করে সংবিধানের আওতায় মানবাধিকার রক্ষার শেষ রক্ষক হিসেবে পরিচিত সুপ্রিম কোর্ট তার দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

অনাকাঙ্ক্ষিত যাত্রা

সুপ্রিম কোর্ট যেভাবে রায় দিয়েছে, তাতে মনে হয়েছে, সংস্থাটি দেশের সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে নয়, বরং কোনো কোম্পানির সিইওর মতো কাজ করেছে। অথচ তাদের হাতে দেশের লাখ লাখ লোকের অধিকার রক্ষার দায়িত্ব বর্তেছে। তাদের উচিত ছিল, এসব মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ করা।

কুদ্দুস মামলায় আদালতের পর্যবেক্ষণটি সর্বনন্দ সনোওয়াল ল্যান্ড টু নামে পরিচিত ২০০০-এর দশকের মধ্যভাগে রায়ের সাথে সামঞ্জস্য দেখা যায়। এতে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার চেয়ে লোকরঞ্জক বক্তব্যকেই প্রাধান্য দিয়ে অভিবাসনকে দেশের ওপর ‘বাইরের আগ্রাসন’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। এর জের ধরেই নাগরিকত্ব প্রমাণের দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। অথচ কাউকে দোষী প্রমাণ করার দায়িত্ব, ওই দায় ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেয়া অসাংবিধানিক।

অসাংবিধানিক ও অমানবিকভাবে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল পরিচালনার কারণেই প্রতি সপ্তাহেই অনেক মর্মান্তিক ঘটনা সামনে আসছে। পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে সংবিধানের ধারা ২১, জীবনের অধিকার, যদি সার্বিকভাবে সবকিছুই বোঝায়, তবে এই পুরো আইন বিজ্ঞানই পুরোপুরি নতুন করে বিবেচনা করতে হবে।

>>>লেখক: দিল্লিভিত্তিক আইনজীবী

No comments

Powered by Blogger.