ডেঙ্গু জ্বর: আতঙ্ক, রোগ নির্ণয় চিকিৎসা ও প্রতিরোধে করণীয় by প্রফেসর ড. মো. আলিমুল ইসলাম

মশা বাহিত একপ্রকার ভাইরাস জ্বর ডেঙ্গু। এই জ্বর অন্যান্য ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত জ্বর থেকে আলাদা। এই জ্বর কোনোভাবেই ছোঁয়াচে নয়। এই ভাইরাস জ্বর এককভাবে অথবা অন্যান্য ভাইরাস (চিকুনগুনিয়া, ইয়েলো ফিভার, বার্মা ফরেস্ট, ফ্লু, রেসপাইরেটরি সিনসাইটিয়াল) ও ব্যাকটেরিয়া (নিউমোক্কাস)-এর সঙ্গেও হতে পারে। বিশ্বব্যাপী এই জ্বরে প্রতি বছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং প্রায় ২.৫ বিলিয়ন মানুষ এই রোগের ঝুঁকিতে আছেন।

চীনে সর্বপ্রথম এই জ্বর ৯৯২ খৃষ্টাব্দে শনাক্ত করা হয়েছিল। ১৭৭৯ সালে মশাবাহিত জ্বরকে ডেঙ্গু জ্বর নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। ডেঙ্গ জ্বর ফিলিপাইনে সর্বপ্রথম ১৯৫০ সালে মহামারি আকারে দেখা দেয়। ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ডেঙ্গু জ্বরের রোগী শনাক্ত করা হয়।
ডেঙ্গু জ্বর বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০০০ সালে বড় আকারে দেখা দেয়। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ১১২টি দেশকে ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে এ্যান্ডেমিক দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
-মানুষই কেবল ডেঙ্গু ভাইরাসের সকল সিরোটাইপ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে রোগের লক্ষণ প্রকাশের পর মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকে
-বন্য প্রাণির মধ্যে বানর ও শিম্পাঞ্জিতে ডেঙ্গু ভাইরাস রোগের লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই বংশ বৃদ্ধি করতে সক্ষম। কারণ এদের শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাসের রিসেম্‌টর বিদ্যমান।

-গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, উট, দুম্বা, মুরগি, কবুতর, অন্যান্য পাখি, কুকুর, বিড়াল, শূকর, গিনিপিগ ও খরগোস এদের এডিস মশা কামড় দিলেও ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা এরা কখনোই আক্রান্ত হবে না। কারণ এদের শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাসের কোন রিসেম্‌টর নাই অতএব এই সকল প্রাণী ডেঙ্গু ভাইরাস থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ।
এরোগের বাহক স্ত্রী এডিস প্রজাতির মশা (এডিস এজিপটাই ও এডিস এলবোপিকটাস)। স্ত্রী এডিস প্রজাতির মশা ছাড়াও অন্যান্য প্রজাতির স্ত্রী মশা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত ভক্ষণ করলে তাদের শরীরেও ডেঙ্গু ভাইরাসের অস্তিত্ব মাঝে মাঝে পাওয়া গেলেও অন্য প্রজাতীর স্ত্রী মশা দ্বারা ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা একেবারেই নেই। কারণ স্ত্রী এডিস মশা শরীরেই কেবল ডেঙ্গু ভাইরাসের রিসেপ্টর থাকে বিধায় তাদের শরীরেই একমাত্র প্রাথমিক বংশ বিস্তার সম্ভব যার ফলে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তখেকো স্ত্রী মশার সিলিভারী গ্লেন্ডে অধিক পরিমাণ ভাইরাস থাকে এবং পরে অন্য ব্যক্তিকে কামড় দেওয়ার সময় সহজেই তা উক্ত ব্যক্তির শরীরে ছড়ায়।

ডেঙ্গু জ্বর নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেকোনো বয়সে হতে পারে। ডেঙ্গু জ্বর অন্যান্য ভাইরাসজনিত জ্বর থেকে কিছুটা আলাদা। এই জ্বর কোনোভাবেই ছোঁয়াচে না এবং বাতাস দ্বারাও ছড়ায় না। এবারের (২০১৯) ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও তীব্রতা বিগত বছরগুলোর তুলনায় কিছুটা আলাদা হলেও ২০০২ সালে বাংলাদেশে যে ডেঙ্গু জ্বর হয়েছিল তার সঙ্গে অনেকটাই মিল রয়েছে, কারণ রোগের তীব্রতা, রোগ ছড়ানোর প্যাটার্ন এবং রোগীর মৃত্যুর হার প্রায় একই রকম।
টোগা গোত্রের ভাইরাস দ্বারা (চিকুনগুনিয়া, বার্মা ফরেস্ট ও রস রিভার) মানুষ আক্রান্ত হয় এবং ডেঙ্গু জ্বরের ন্যায় একই ধরনের লক্ষণ প্রকাশ করে।

ডেঙ্গু জ্বরের মশার বংশবৃদ্ধি ও পরিবেশের ভূমিকা
এডিস মশা সচরাচর আবদ্ধ জলাধারে বংশবৃদ্ধি করে থাকে, যেমন: আবদ্ধ ড্রেন, কৌটা, টায়ার, ডাবের খোল, টব, এসি ও অন্যান্য পাত্রে জমে থাকা পানিতে। অপরিষ্কার পরিবেশই মশামাছিসহ অন্যান্য কীটপতঙ্গের বংশবৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে যে কথাটি পৃথিবীর সকল দেশ, ধর্ম ও বর্ণের মানুষের জন্য বলেছিলেন তা হলো, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।’ [মুসলিম : ২২৩] তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত উক্ত মহামূল্যবান উক্তিটির প্রতি সম্মান জানিয়ে আমাদের নিজেদের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে তা পালন করা।

ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাস বাহক মশা কামড়ের কতদিন পর রোগের লক্ষণ দেখা দেবে।
ভাইরাসের ঘনত্বের মাত্রার উপর নির্ভর করে মশার কামড়ের ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে এ রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণসমূহ
(১) প্রচণ্ড মাথাব্যথা
(২) জ্বর (১০৩ থেকে ১০৬ ডি. ফা.)
(৩) বমি বমি ভাব/অস্বাভাবিক বমি (ঘনঘন বমি)
(৪) পেট ব্যথা
(৫) চোখ ব্যথা
(৬) সমস্ত শরীর ব্যথা
(৭) গিরায় গিরায় ব্যথা
(৮) চামড়ার নিচে লাল লাল ফুসকুড়ি উঠা
(৯) মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া
(১০) চোখের সাদা অংশে রক্ত জমা হওয়া
(১১) রক্ত পায়খানা ও রক্ত প্রশ্রাব হওয়া (সকল ক্ষেত্রে নয়)
(১২) জ্বরের ওষুধ (প্যারাসিটামল) খাওয়ানোর ১ থেকে ২ ঘণ্টা পর রোগীর জ্বর আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া (১০৩ থেকে ১০৬ ডি.ফা.)
(১৩) কোনো কোনো ক্ষেত্রে (ডেঙ্গু সক সিনড্রোম) অজ্ঞান হয়ে যাওয়া 
(১৪) মহিলাদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব অস্বাভাবিক ও প্রলম্বিত হতে পারে
ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাস কিভাবে ছড়ায়
(১) ডেঙ্গু ভাইরাস বাহিত মশার কামড়ে (হরিজেন্টাল ট্রান্সমিশন)
(২) ডেঙ্গু ভাইরাস আক্রান্ত মশার লার্ভা মাধ্যমে (ভার্টিক্যাল ট্রান্সমিশন)
(৩) ডেঙ্গ জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত, সুচ অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তির রক্তের সংস্পর্শে আসলে (হরিজেন্টাল ট্রান্সমিশন)।
(৪) নবজাতক শিশুর ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মায়ের দুগ্ধ পানের মাধ্যমে (ভার্টিক্যাল ট্রান্সমিশন)।
(৫) ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাস ছোঁয়াচে রোগ না।
ডেঙ্গু জ্বরের প্রকার
ক্লাসিক্যাল জ্বর, হিমোরেজিক জ্বর ও ডেঙ্গি সক সিনড্রোম।
কারা কারা ডেঙ্গু জ্বরে মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন
(১) ডেঙ্গু জ্বরে দ্বিতীয় বার থেকে ঊর্ধ্বে আক্রান্ত রোগীরা
(২) ডায়াবেটিস রোগীদের দ্বিতীয় বার ডেঙ্গু জ্বর হলে
(৩) ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর ডেঙ্গু জ্বর হলে
(৪) উচ্চ রক্তচাপের ব্যক্তির ডেঙ্গু জ্বর হলে
(৫) টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, কালা জ্বর, জাপানিজ ইনক্যাফালাইটিস ও চিকুনগুনিয়ার সঙ্গে ডেঙ্গু জ্বর হলে
(৬) গর্ভবতী মহিলার ডেঙ্গু জ্বর হলে
(৭) ৫ বছরের কম বয়সী ও বয়স্ক (৭০ ঊর্ধ্ব) ব্যক্তির ডেঙ্গু জ্বর হলে
ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয়ের পদ্ধতি
(১) জ্বর অবস্থায় ১ থেকে ৬ দিনের মধ্যে রক্ত পরীক্ষা করলে (এনএস-১ এন্টিজেন, আইজি-জি ও আইজি-এম ক্যাপচার ইলাইজা ও রক্তের সিবিসি পরীক্ষা)
(২) আক্রান্ত রোগীর রক্তের নমুনা থেকে প্লাজমা বা সিরাম (জ্বর যখন ১০৩ থেকে ১০৬ ডি. ফা. থাকে) থেকে ডেঙ্গু ভাইরাসের আরএনএ নিষ্কাশন করে ইউনিপ্লেক্স বা মাল্টিপ্লেক্স পিসিআর এর মাধ্যমে প্রথম এবং দ্বিতীয় বার আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগী কিভাবে পৃথক করবেন।
(১) ডেঙ্গু জ্বরে প্রথম বার আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে জ্বর অবস্থায় ১ থেকে ৫ দিনের মধ্যে রক্তের নমুনা করলে আইজি-জি ও আইজি-এম উভয় পরীক্ষা নেগেটিভ হবে, তবে জ্বর অবস্থায় ২ থেকে ৫ দিনের রক্তের নমুনা এনএস-১ এন্টিজেন পরীক্ষা করলে অবশ্যই ডেঙ্গি জ্বর নিশ্চিত করা যাবে।
(২) ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে ১ থেকে ৬ দিনের রক্ত পরীক্ষা করলে যদি শুধু আইজি-এম পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ হয়, তাহলে ঐ রোগী প্রথম বার আক্রান্ত বলে নিশ্চিত, অপরপক্ষে একই সময়ের রক্ত পরীক্ষা করে যদি আইজি-জি এবং আইজি-এম উভয়ই পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ হয় তা হলে অবশ্যই ঐ রোগী ২য় বার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত।

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে করণীয়
(১) শহর এলাকায় এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে কোনো রোগীর ক্ষেত্রে জ্বরসহ উপরোল্লিখিত উপসর্গ দেখা দিলে প্রথমেই নিকটস্থ ডাক্তারে শরণাপন্ন হওয়া
(২) জ্বর উপশমের ওষুধ নিয়মিত সেবনের পাশাপাশি অধিক মাত্রায় তরল পানীয় (খাবার স্যালাইন, ফলের রস, ডাবের পানি ও স্যুপ) পান করতে হবে।
(৩) জ্বর অবস্থায় ও জ্বর সেরে যাওয়ার পরেও প্রায় ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।
(৪) জ্বর অবস্থায় ডেঙ্গু নিশ্চিত হলে কোনো অবস্থায় এসপিরিন বা ডিসপিরিন জাতীয় ওষুধ সেবন করা যাবে না।
(৫) জ্বর অবস্থায় প্যারাসিটামলের পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এন্টিবায়োটিক সেবন করতে হবে, পরিস্থিতি বিবেচনা করে।
(৬) ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর রক্তের অনুচক্রিকার পরিমান যখন ১০০০০ এর নিচে আসবে তখনই কেবলে উক্ত রোগীর শরীরে অনুচক্রিকা সঞ্চালন করতে হবে।
(৭) ছাগলের দুধ প্রচুর পরিমাণে সেলিনিয়াম থাকায় ইহা ডেঙ্গু জ্বরের রোগীর প্লাটিলেট দ্রুত স্বাভাবিক মাত্রায় আনতে সাহায্য করে।
এবারে বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর অধিক মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ
প্রথমেই ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুবরণকারী সকল রোগীর আত্মার মাগফেরাত ও আক্রান্ত রোগীদের আশু সুস্থতা কামনা করছি এবং মৃত ব্যক্তির পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
সম্ভাব্য কারণ
(১) ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিরা সম্ভবত ২য় অথবা ৩য় বার ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাসের একাধিক সিরোটাইপ দ্বারা আগে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে
(২) ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাসের সঙ্গে অন্য ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রামিত হয়ে থাকতে পারে
(৩) উচ্চ রক্ত চাপের রোগী ডেঙ্গু জ্বরের আক্রান্ত হওয়ার পরে মারাত্মক শারীরিক সমস্য দেখা দিলে
(৪) শ্বাসকষ্টের রোগী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে থাকলে
(৫) ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর ডেঙ্গু জ্বরের ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রের বাইরে গেলে
(৬) ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর অনিয়ন্ত্রিত রক্তক্ষরণের ফলে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে গেলে
(৭) আশার কথা প্রথমবারে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যু হার নেই বললেই চলে

ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে করণীয়
(১) দেশে-বিদেশের ভ্রমণকারীদের প্রতিনিয়ত নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। এই ক্ষেত্রে বিমান বন্দর/সমুদ্র বন্দর এলাকায় অবস্থিত শহরে, যেহেতু এ রোগ বেশি হয়, বলতে গেল ডেঙ্গু জ্বর একটি মেগাসিটি বেজস্ট ভাইরাসজনিত রোগ, তাই এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার সঙ্গে বড় শহরের ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত লোকজনকে সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ছোট শহর গুলিতে ভ্রমণ বা যাতায়াত করতে না দেওয়া। আশার কথা প্রত্যন্ত গ্রামের লোকজন সচরাচর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত শহর থেকে আক্রান্ত রোগী গ্রামে না যায়।
(২) পূর্ণ বয়স্ক এডিস মশা নিধনে নিয়মিত মশা নিধনকারী স্প্রে করতে হবে বছরব্যাপী।
(৩) এডিস মশার ব্রিডিং প্লেস নষ্ট করে সদা সুস্থ পরিবেশ রক্ষা করতে হবে
(৪) এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করতে হবে (আবদ্ধ জলাধার ছোট হলে মাটি দিয়ে ভরাট করতে হবে, বড হলে পানির উপরে কেরোসিন বা পোড়া মবিল ঢেলে দিলে বাতাসের অক্সিজেন পানিতে প্রবেশ করতে না পারলে এডিস মশার লার্ভা গুলি মারা যাবে। এছাড়া জলাধার আরও বড় হলে কপিপোড বা তেলাপিয়া জাতীয় মাছ চাষ করলে এডিস মশার লার্ভাও ধ্বংস হবে এবং মাছও বৃদ্ধি পাবে)। 
(৫) এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ ডেঙ্গু জ্বর থেকে রক্ষা পেতে নিয়মিত টিস্যু কালচার বেজড ইনএক্টিভেটেড টেট্রাভেলেন্ট (ডেঙ্গু ভাইরাস টাইপ-১, ২, ৩, ৪) ভ্যাকসিন ব্যবহার করছে।
(৬) ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে টিস্যু কালচার বেজড ইনএক্টিভেটেড টেট্রাভেলেন্ট (ডেঙ্গু ভাইরাস টাইপ -১, ২, ৩, ৪) ভ্যাকসিন বেশ কার্যকর এবং এ ভ্যাকসিন তৈরির পদ্ধতিও সহজ। বাংলাদেশেও এদেশের ডেঙ্গু ভাইরাস দিয়ে ডেঙ্গু জ্বরের কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি করতে ও এদেশের মানুষের জন্য ব্যবহার করতে পারে। তবে টিস্যু কালচার বেজড ইনএক্টিভেটেড টেট্রাভেলেন্ট (ডেঙ্গু ভাইরাস টাইপ-১, ২, ৩, ৪) ভ্যাকসিন মশার সেল লাইন (সি৬/৩৬ই/এম) ব্যবহার করে সঠিকভাবে ইনএক্টিভেটেড করে ফাস্ট ফেজ (শিম্পাঞ্জীতে) এবং সেকেন্ড ফেজ (মানুষে) ট্রায়াল দেওয়ার পর সিরাম এন্টিবডি টাইটার নির্ণয়ের পর গণ টিকা হিসাবে এদেশের মানুষের জন্য ব্যবহার করতে পারে।

নাগরিক জীবনে ডেঙ্গু জ্বরের প্রভাবও সতর্কীকরণ
সর্বত্র ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে বিশেষ করে নাগরিক জীবনে। ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাসের শনাক্তকরণের পাশাপাশি আক্রান্ত ব্যক্তির সিরাম ওমএ  এবং ওমগ ক্যাপচার্ড ELISA এর মাধ্যমে সঠিকভাবে পরীক্ষা করা দরকার। ডেঙ্গু জ্বর সঠিকভাবে নির্ণয়র জন্য শুধুমাত্র NS-1 এন্টিজেন ডিটেকশন কিটের উপর নির্ভর করা সঠিক নয় কারণ কিটের স্পেসিফিটি এবং সেনসিটিভিটি  অনেক সময় তারতম্য হয়ে ভুল ফলাফল আসতে পারে। আমরা জানি যে, ডেঙ্গু জ্বর ভাইরাসের যেকোনো একটি সিরোটাইপ দ্বারা কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হলে ঐ সিরোটাইপের বিরুদ্ধে উক্ত ব্যক্তির শরীরে আজীবনের জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হলেও অন্য সিরোটাইপ আবারও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকায় এভাবে চারটি সিরোটাইপ দ্বারাই একই ব্যক্তি চার বার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারে।
বাংলাদেশি ডেঙ্গু ভাইরাস টাইপ-৩ এর মৌলিক গবেষণার সংক্ষিপ্ত বিবরণ

২০০২ সালে বাংলাদেশে যে ডেঙ্গু জ্বর হয়েছিল ঐ সময়ের ভাইরাসটির Predominant sero type ছিল  টাইপ-৩। ২০১৯ সালের ডেঙ্গু আউটব্রেকের sero type wUI Predominantly টাইপ-৩। ডেঙ্গুরোগের ক্ষেত্রে এ ধরনের মহামারিকে সচরাচর বলা হয়ে থাকে ডেঙ্গু ভাইরাস টাইপ-৩ এর ২য় ওয়েব। এই ধরনের ওয়েব সচরাচর ১৫ থেকে ২০ বছর পর পর ডেঙ্গু ভাইরাস যেকোনো সিরো টাইপ দ্বারা হতে পারে। ২০০২ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর রক্তের নমুনা WHO-এর রেফারেন্স সেন্টার (আইটিএম, নাগাসাকি, জাপান) এর সহযোগিতায় পরীক্ষা করে শুধু ডেঙ্গু ভাইরাস টাইপ-৩ নিশ্চিত করা হয়েছিল। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের প্রফেসর ড. মো. আলিমুল ইসলাম উক্ত গবেষণায় সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন এবং তিনি উক্ত ভাইরাস (৮টি ডেঙ্গু ভাইরাস টাইপ-৩ আইসোলেট)-এর মধ্যে চারটি আইসোলেট ও তাদের মিউটেন্ট ভাইরাস সমূহের পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য প্রথম বারের মতো উন্মোচন করেন। উল্লেখ্য প্রফেসর ড. ইসলামের আগে বাংলাদেশি ডেঙ্গু ভাইরাস টাইপ-৩ আইসোলেটের পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য পৃথিবীর কোনো দেশের বিজ্ঞানী উন্মোচন করতে সক্ষম হননি।
প্রফেসর ড. মো. আলিমুল ইসলাম
লেখক পরিচিতি:
প্রফেসর ড. মো. আলিমুল ইসলাম
মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২
ইমেইল: alim_bau@yahoo.co.in
alimmicrobau@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.