ভাই হত্যার বিচার কেন পাচ্ছি না? by মরিয়ম চম্পা

রাজীব চলে যাওয়ার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু তার এতিম দুই ভাই এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারছে না। যত দিন যাচ্ছে ততোই ভাইকে হারানোর ক্ষত গভীর হচ্ছে। রাস্তায় বের হলে বিআরটিসি পরিবহনের বাস দেখে ভাইয়ের কথা   মনে পড়ে। মা-বাবাকে হারিয়ে পটুয়াখালীর বাউফলের এতিম ছেলে রাজীব ও তার ছোট দুই ভাই খালা-মামাদের তত্ত্বাবধানেই বেড়ে ওঠেন। বর্তমানে খালাদের সহযোগীতায় কোনোমতে দিন পার হচ্ছে রাজীবের ছোট দুই ভাইয়ের। অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় কোচিং বা প্রাইভেট পড়তে পারছে না তারা। অনেকেই তাদের সাহায্যের আশ্বাস দিয়েও পরক্ষণে আর কোনো খোঁজ নেন নি।
সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তাদের আশ্বাস দিলেও সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। এতো কিছুর পরেও দুই ভাইয়ের একটাই দাবি আমরা খেয়ে অথবা না খেয়ে থাকি তাতে কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু আমার ভাইয়ের হত্যাকারী ঘাতক বাস চালক ও মালিকদের দ্রুত সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। 
দুই বাসের চাপায় প্রথমে হাত হারায় পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় রাজীবের। গত বছর ৩রা এপ্রিল দুপুরে বিআরটিসি বাসে চড়ে কলেজে যাচ্ছিলেন রাজীব হোসেন। মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন রাজীব। বাসের পেছনের ফটকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ করেই পেছন থেকে স্বজন পরিবহন নামের একটি বাস বিআরটিসির বাসটিকে ওভারটেক করার জন্য বাঁ দিকে গা ঘেঁষে চাপা দেয়। কাওরান বাজারের সার্ক ফোয়ারার কাছে দুই বাসের প্রবল চাপে রাজীবের হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পথচারীরা দ্রুত তাঁকে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে নিয়ে যায়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর রাজীবকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সাময়িক উন্নতির পর তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। দীর্ঘ ১২ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ১৬ এপ্রিল রাত ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে তিনি মারা যান।
রাজীবের মেজো ভাই মেহেদী হাসান বলেন, আমাদের দিনকাল বলতে মাদরাসায় আছি। ওখানেই থাকতে হয়। পড়ালেখা আসলে যতোটা ভালোভাবে চলার কথা ছিল ততোটা হচ্ছে না। আমি এখন     যাত্রাবাড়ী তামিরুল মিল্লাত মাদরাসায় অষ্টম শ্রেণীতে ও ছোট ভাই আব্দুল্লাহ সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছে। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে হলে অবশ্যই প্রাইভেট কিংবা কোচিং এর প্রয়োজন। যেটা আমরা পাচ্ছি না। নির্ধারিত খরচের অভাবে আমরা প্রয়োজনীয় কোচিং করতে পারছি না। মাদরাসায় থাকা খাওয়া এবং পড়ালেখার খরচ খালারাই তাদের সাধ্যানুযায়ী দিচ্ছেন। অনেকেই বলেছে আমাদের দুই ভাইকে পড়ালেখায় সাহায্য করবে অথচ কেউ করেনি। এটা কতোটা কষ্টের সেটা বলে প্রকাশ করা যাবে না। বাস দুর্ঘটনায় ভাইয়া মারা যাওয়ার পর আমাদের মূল দাবি ছিল ভাইয়ের হত্যার যেন সঠিক বিচার পাই। কিন্তু আজ পর্যন্ত হত্যা মামলা ও ক্ষতিপূরনের রায়ের পূর্ণাঙ্গ শুনানি হয়নি। কয়েকদিন পর শুনানি হয় আবার সেটা দু একদিন চালু থেকে পূণরায় স্থগিত হয়ে যায়। এই কথাগুলো আমরা কার কাছে বলবো। কে শুনবে আমাদের কথা?
আমার ভাইয়ের দুর্ঘটনার মূলে ছিল দুই বাসের চালক। যাদের সঠিক ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। এছাড়া আমরা মনে করি এই ঘটনার মূলে দায়ী ছিল বাস মালিক। যখন কোর্টে গিয়েছি তখন অপরাধিদের জোর গলায় বারবার বলতে শুনেছি যে, দুর্ঘটনার পরে আমরা বিশ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করেছি। অথচ সেটা ভাইয়ার একদিনের চিকিৎসা খরচের ন্যূনতম ছিল না। আগে তারা আমার ভাইকে খুন করে পরে বিশ হাজার টাকা দিয়ে দায় এড়াতে চেয়েছে। আমরাতো ওই টাকাটা চাইনি। আমরা আমাদের ভাইকে চেয়েছি। অথচ ভাইকে আমরা বাঁচাতে পারিনি।
ভাইয়াকে ছাড়া আমাদের একটি বছর কেটে গেছে। কোর্টে অপরাধিরা যখন জোর গলায় কথা বলছিল তখন আমার কিছু বলার সুযোগ ছিল না। এ বিষয়ে এখন আর কোথাও কথা বলতে ভালো লাগে না। না মিডিয়ায়। না অন্য কোথায়। অনেকেই অনেকভাবে আশ্বাস দিলেও পরবর্তীতে আর তাদের কোনো দেখা পাইনি। কেউ চাইলে আমাদের পড়ালেখায় সাহায্য করতে পারেন। সেটা মূখ্য বিষয় নয়। তবে ক্ষোভ একটাই। ভাই হত্যার বিচার কেন পাচ্ছিনা আমরা। আমাদের জীবনে যাই ঘটুকনা কেনো একটাই কথা ‘ভাইয়ের হত্যার বিচার যেন পাই’। সত্যি বলতে রাস্তায় বের হলে যখনই বিআরটিসি বাস দেখি তখনই প্রথমে মনে পড়ে ভাইয়ার কথা। সামনে রমজান মাস। গত রমজানেও ভাইয়া ছিল না। এই রমজানেও ভাইয়াকে পাশে পাবো না। এটা ভাবতেই কান্না পায়। ভাইয়ের হত্যার বিচারটাই এখন আমাদের প্রধান চাওয়া। ভাইয়াই ছিল আমাদের একমাত্র অবলম্বন। ভাইয়া থাকায় বাবা মায়ের অভাবটা তখন ওভাবে বুঝতে পারিনি।  
ছোট ভাই আব্দুল্লাহ বলেন, আগের মতো একমদই ভালো সময় যাচ্ছে না আমাদের। ভাইয়াকে  হত্যায় জড়িত বাস চালক ও মালিকদের সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ভালো সময় হয়তো আসবে না। আমরা নিজেদের জন্য কোনো কিছু চাচ্ছি না। কোনো আর্থিক সাহায্য কিংবা অনুদান চাচ্ছি না। আমাদের সবচেয়ে বড় চাওয়া অপরাধিদের কঠিন ও সর্বোচ্চ বিচার।

No comments

Powered by Blogger.