সিলেটে সক্রিয় আদম ব্যবসার ৫০০ প্রতিষ্ঠান by ওয়েছ খছরু

সিলেটে আদম ব্যবসার হাট খুলে বসেছে অনুমোদনহীন ট্রাভেলস এজেন্সির মালিকরা। এর সংখ্যা প্রায় ৫০০। সিলেটের এমন কোনো বহুতল মার্কেট নেই যেখানে গড়ে উঠেনি ট্রাভেলস ব্যবসা। খোদ আটাব কর্মকর্তারা এসব অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানের তালিকা নিয়ে প্রশাসনের কাছে ধরনা দিলেও ওদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে পারেনি। চোখের সামনেই তাদের হাতে প্রতারিত হচ্ছে মানুষ। আর প্রতিনিয়ত জীবন দিচ্ছে তরতাজা যুবকরা। স্বপ্নের ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতে টাকা দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে ধরনা দেন যুবকরা। অনেকেই হন প্রতারিত। কিন্তু দেখার কেউ নেই।
এই অবস্থায় ভূমধ্যসাগর ট্রাজেডি নাড়া দিয়েছে সিলেটে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এখন ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ মানুষ। সাগর ট্র্যাজেডির পর নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসনও। গতকাল থেকে সিলেটে ভুঁইফোড় এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। সিলেটের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগরজুড়ে ৫টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান শুরু করা হয়। আর এই অভিযানে প্রায় ২৪ টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হানা দিয়ে কাগজপত্রের বৈধতা মিলেনি। ৮ জনকে তাৎক্ষণিক কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। অথচ এরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানুষ পাঠাতে নানা ব্যবসার ফাঁদ পেতে বসেছে। আর এদের ফাঁদে পা দিয়ে নিঃস্ব হওয়ার পাশাপাশি জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে স্বপ্নাতুর যুবকগুলো। সিলেটের রাজা ম্যানশনে রয়েছে এসব ভুঁইফোড় ট্রাভেলস এজেন্সির অন্যতম হাট। এই মার্কেটে অন্তত ১০টি ট্রাভেলস এজেন্সি রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ইয়াহিয়া ওভারসিজ। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইতালি পাড়ি জমাতে গিয়ে সিলেটের ৬ যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে।
গতকাল জেলা প্রশাসনের একটি টিম দুপুরের আগেই হানা দেয় রাজা ম্যানশনে। এ ম্যানশনের তৃতীয় তলায় গিয়ে তারা ইয়াহিয়া ওভারসিজ বন্ধ পান। আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অভিযানে টের পেয়েই বন্ধ করে দেয়া হয়। মালিকরাও আড়ালে যায়। তবে- প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন- রাজা ম্যানশনের এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। ইয়াহিয়া ওভারসিজের মালিক এনামুল হক চৌধুরীকে খোঁজা হচ্ছে। ঘটনার পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মার্কেট সমিতির নেতারা জানিয়েছেন- যারাই মানুষের ভাগ্য নিয়ে এসব কর্মকাণ্ড করে যাবে তাদের কোনো ভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। তারা এ নিয়ে বৈঠক করবেন। এবং যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের মার্কেট থেকে তাড়িয়ে দেবেন। প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নেবেন তারা। আটাব সিলেট জোনের সভাপতি আব্দুল জব্বার জলিল গতকাল বিকেলে মানবজমিনকে জানিয়েছেন- সিলেটের ৫ শতাধিক ভুঁইফোড় সংগঠন তারা চিহ্নিত করেছেন।
এই সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময় আটাবের সদস্য হতে তাদের কাছে আবেদন করেছিলো। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে তারা তালিকা প্রস্তুতি করে অনেক আগে থেকেই জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। প্রায় ৬ মাস আগে দুইবার অভিযান চালানো হয়েছিলো। পরে জেলা প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে সেই অভিযান চলমান রাখা যায়নি। এবার ভূমধ্যসাগর ট্র্যাজেডির পর অভিযান শুরু করা হয়েছে। এই অভিযান অব্যাহত থাকলে সিলেট থেকে অবৈধ পথে আদম পাচার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে দাবি করেন তিনি। সিলেটের সিটি মার্কেট, আল হামরা মার্কেট, ওয়েস্টওয়ার্ল্ড, রাজা ম্যানশন, ব্লুওয়াটার, কাকলী শপিং সেন্টার, সুবহানীঘাটের কয়েকটি মার্কেট এবং উপশহরের কয়েকটি মার্কেটে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই হচ্ছে ইউরোপের আদম ব্যবসার দালাল। তারা মূলত সিলেটে লোক সংগ্রহ করে। এরপর টাকার এজেন্সির সঙ্গে মিলে বিভিন্ন দেশে অবৈধপথে মানুষ পাঠিয়ে থাকে।
সজল আহমদ, মিনার হোসেন সহ কয়েকজন যুবক গতকাল সিটি মার্কেটে অবস্থানকালে জানান- ওই মার্কেটের ৯ তলার একটি প্রতিষ্ঠান পোল্যান্ড পাঠানোর কথা বলে তাদের কাছ থেকে অনেক আগেই পাসপোর্ট নিয়েছে। দাবি করেছে ১১ লাখ টাকা। এর মধ্যে তারা প্রায় ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছেন। টাকা ও পাসপোর্ট নিলেও গত ৬ মাস ধরে তাদের বিদেশ পাঠাচ্ছে। এখন পাসপোর্ট ফেরতও দিচ্ছে না। প্রথমে তারা বিশ্বাস করে টাকা ও পাসপোর্ট দিয়েছিলেন। এখন তারা দেখেন ওই প্রতিষ্ঠানটি ভুয়া। তারা কখনো কখনো নিজেরা ভিসা ও টিকিট তৈরি করে প্রতারণা করে বলে জানায় তারা।
এদিকে- গতকাল সকালে সিলেট জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আশরাফুল হকের নেতৃত্বে এ অভিযানে রোজভিউ কমপ্লেক্সের আবিদ ওভারসিজকে ২০ হাজার, আসসালাম হজ্জ এবং ওমরা (প্যারাডাইস) ১৫ হাজার, আলকেফা ২০ হাজার, খাজা এয়ার ইন্টান্যাশনাল সর্ভিসকে ২০ হাজার, হোয়াইট ট্রাভেলস থেকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এ সময় ম্যাজিস্ট্রেট জানান- লাইন্সেস-নিবন্ধনবিহীন ট্রাভেলসগুলোতে অভিযান চালানো হচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত এগুলো পুরোপুরি বন্ধ না হবে ততদিন এ অভিযান চলবে। একই সময় সিলেট নগরীর জিন্দাবাজার এলাকার ওয়েস্ট ওয়ার্ল্ড শপিং সিটির অবৈধ ট্রাভেলস এজেন্সিগুলোতে অভিযান চালিয়েছে প্রশাসন। গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. হেলাল চৌধুরীর নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় ওয়েস্ট ওয়ার্ল্ড শপিং সিটি থেকে ৩ জন মানবপাচারকারী আটক করা হয় এবং তাদেরকে একমাসের কারাদন্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
আটককৃতরা হচ্ছেন- ইউসিএস এ্যাডুকেশনের হীরা, রিচ রিল্যাশন গ্রুপের মাহবুব এবং জাকির এডুক্যাশনের কর্মচারী। এসময় ম্যাজিস্ট্রেট মো. হেলাল চৌধুরী বলেন, মানবপাচার বন্ধে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে লাইন্সেস-নিবন্ধন বিহীন ট্রাভেলস গুলোতে অভিযান চালানো হচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত এগুলো পুরোপুরি বন্ধ না হবে ততদিন ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলবে। নগরীর আম্বরখানা এলাকায় অভিযান চালিয়েছে মোবাইল কোর্ট। এ সময় লাইসেন্স-নিবন্ধন না থাকায় কয়েকটি ট্র্যাভেলসকে মোটা অংকের জরিমানা করা হয়। সিলেট জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইরতিজা হাসানের নেতৃত্বে গতকাল সোমবার আড়াইটার দিকে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে আম্বরখানাস্থ আবুসাইদ এন্টাপ্রাইজকে ত্রিশ হাজার, ট্রাভেল টাইমকে পঁচিশ হাজার টাকা, জিলানী এয়ার ইন্টারন্যাশনালকে পাঁচ হাজার, মিরাজ এয়ার ইন্টারন্যাশনালকে বিশ হাজার, জে স্কয়ার কনসালটেন্সিকে বিশ হাজার, রেন্‌জার ইন্টারন্যাশলকে বিশ হাজার ও নিউ জান্নাত ট্রাভেলসকে ত্রিশ হাজার এবং ট্রাভেলস কর্মচারী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে  পনের  দিনের ও নজমুল ইসলাম খানকে দশদিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.