চীনা গুপ্তচরের বয়ানে মুসলিম উইঘুর নির্যাতন

হ্যাঁ, প্রত্যেক দেশের নিজস্ব আইন রয়েছে। কিন্তু সর্বব্যাপী একটা আন্তর্জাতিক আদর্শও রয়েছে।
আমার মতে, ওরা এ আদর্শ চরমভাবে লঙ্ঘন করছে। নিজেদের মতো স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের অধিকার উইঘুরদের নেই আমাত একজন উইঘুর। ২০১২ সালে গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করেন। কারণ কর্মকর্তারা তার মাকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করছিল। আমাত ওদের হয়ে কাজ না করলে তাকে বন্দি করে রাখারও হুমকি দেয় কর্তৃপক্ষ।
‘আমি ছোটবেলা থেকেই ঠিক করেছিলাম মাকে সুরক্ষিত রাখব। কিন্তু আমি সেটা করিনি। ওরা যখন উনার সঙ্গে আমাকে দেখা করতে নিয়ে যায়, আমার এমন কষ্ট হয়েছিল!’ জানান আমাত।
আমাতের নিয়োগকর্তা ওকে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য বিদেশেও পাঠিয়েছিলেন। বিশ্বজুড়ে গুপ্তচরবৃত্তির নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করতে আমাতকে ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও তুরস্কের উইঘুরদের সঙ্গে মিশতে বলা হয়। বিশ্বজুড়ে বেইজিংয়ের ‘অসংখ্য’ ইনফর্মার রয়েছে বলে জানান তিনি।
‘আমি কারামায় নামের ছোট একটা টাউন থেকে এসেছি। আমার মতো আরও বহুজনকে পরিচালনা করেন আমার নিয়োগকর্তা। জিঞ্জিয়াংজুড়ে কয়েক ডজন এরকম ছোট শহর রয়েছে। আর বড় শহর তো আছেই। তার ওপর আছে আন্তর্জাতিক কার্যক্রম। আপনি ভাবতেই পারছেন কতগুলো চোখ নজরদারি করছে।’
চীন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরও সাহসী হয়ে উঠছে দাবি করে আমাত বলেন, ‘সরকার বিদেশেও উইঘুরদের অপহরণ করেছে।’ চীনে ফিরে যাওয়ার পর অনেকেই পুনঃশিক্ষা কেন্দ্রে নিখোঁজ হয়ে যান, বলেন তিনি।
উইঘুরদের যথেচ্ছভাবে গ্রেপ্তার করে আটকে রাখার অভিযোগ অস্বীকার করেছে চীনের সরকার। তারা বলছে, এসব কেন্দ্রে মানুষ ‘স্বেচ্ছায়’ পেশাগত প্রশিক্ষণ নিতে যায় এবং ‘চরমপন্থি’ মনোভাব দূর করার জন্য কাজের প্রশিক্ষণ দিতে এসব জায়গার নকশা করা হয়েছে।
আমাত বলেন, সরকার ‘ডাহা মিথ্যা’ বলছে এবং তিনি নিজে এমন বন্দিশালায় দেড় বছর আটক ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে পালিয়ে গিয়ে মুসলিম যোদ্ধাদের সঙ্গ দিতে চাওয়ার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
সাজাভোগ করার সময় কর্তৃপক্ষ তাকে গুপ্তচর হিসেবে নিযুক্ত করে। ইনফর্মার হতে রাজি হওয়ার পর তাকে বন্দিশালা পরিষ্কার করার কাজ দেওয়া হয়।
এ কাজ করার সময় এ কেন্দ্রগুলোর অনেক জায়গায় প্রবেশের সুযোগ পান তিনি।
‘ভেতরে জিজ্ঞাসাবাদের সময় অনেক মানুষকে মার খেতে দেখেছি। কোনো কোনো সময় খালি বৈদ্যুতিক তার (ইলেকট্রিক কর্ড) ব্যবহার করা হতো, যাতে কল্পনাতীত ব্যথা লাগে। যাদের মারা হয়, বিশেষ করে আমার মতো বয়সের নারীরা, তারা ভয়ানক চিৎকার করেন। আমি যেটা ভুলতে পারি না, সেটা হচ্ছে রক্তÑ মেঝেতে, দেয়ালে সব জায়গায় পড়ে থাকত মানুষের রক্ত,’ বলেন আমাত।
প্রায় এক ডজনেরও বেশি সাবেক বন্দির সঙ্গে কথা বলেছে কাতারের সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। তাদের অনেকেই এসব কেন্দ্রে নির্যাতন ও টর্চার দেখেছে বা ভোগ করেছে।
চীনা কর্তৃপক্ষ নির্যাতনের সব অভিযোগ ঢালাওভাবে অস্বীকার করে আসছে এবং এ ‘পুনঃশিক্ষা’ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক মহলের আহ্বান উপেক্ষা করছে।
সরকার বলছে, তারা জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের এসব কেন্দ্র ঘুরে দেখতে দেবে, যদি তারা ‘চীনের আইন মেনে চলে, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে এবং এর বদলে নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে।’
আমাত বলেন, তার পক্ষে আর তার জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনের বিষয়ে চুপ করে থাকা সম্ভব নয়।
‘চীন মনে করছে ওরা যেটা করছে, সেটা সঠিক। কিন্তু ওরা ভুল করছে,’ বলেন তিনি। ‘হ্যাঁ, প্রত্যেক দেশের নিজস্ব আইন রয়েছে। কিন্তু সর্বব্যাপী একটা আন্তর্জাতিক আদর্শও রয়েছে।’
আমার মতে, ‘ওরা এ আদর্শ চরমভাবে লঙ্ঘন করছে। নিজেদের মতো স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের অধিকার উইঘুরদের নেই।’
সগোত্রীয় উইঘুরদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করায় আমাত অনুশোচনায় ভুগছেন বলেও জানান।
এখন তিনি এসব তথ্য কেন প্রকাশ করছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তার এখন হারানোর বিশেষ কিছু নেই। ওর গুপ্তচরবৃত্তির কারণে তার পরিবারের বেশিরভাগ লোককেই বিভিন্ন বন্দিশালায় রাখা হয়েছে।’
‘আমার বোন, আমার মা, আমার দুলাভাই, ওর ভাই, ওদের বাবা-মা, আমার মামা... এরা সবাই কারাগারে। সবাই ওখানে রয়েছে।’
আমাত বলেন, তিনি জঙ্গুলডাকে চলে এসেছেন। কারণ এখানে অল্প কিছু উইঘুর বাস করে। এখানে চীনা কর্মকর্তারা তাকে বেশি গুপ্তচরবৃত্তি করতে বলতে পারবেন না।
কিন্তু এখন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলায় তাকে কর্তৃপক্ষের রোষের মুখে পড়তে হতে পারে বলেও মনে করেন আমাত। তবে তিনি এজন্য প্রস্তুত আছেন বলে জানান, এটা শুধু আমার নিজের পরিবারের জন্য করিনি, প্রতিটি উইঘুরের হয়ে কথা বলার জন্য আমি এটা করেছি। ওরা সবাই আমার পরিবার। আমার নিজের জীবন কোনো ব্যাপার না। যা হবে, হবেই। আমি যথেষ্ট বেঁচে থেকেছি।
সূত্র : আলজাজিরা ও অন্যান্য

No comments

Powered by Blogger.