বীরের মৃত্যু নেই by আশরাফুল ইসলাম

জন্ম তার কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত হাওরের এক প্রান্তিক কৃষক পরিবারে। দারিদ্র্যের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বেড়ে উঠতে হয়েছে। পরিবারের আটপৌরে জীবনে সচ্ছলতার আশা ছিল আকাশ ছোঁয়ার মতোই। বালক বয়সেই হাওরের জিরাত ঘরে থেকে প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে পত্তনি জমিতে ফলিয়েছেন ধান।
আধপেটা খেয়ে চলেছে দিনের পর দিন। অটোরিকশা-টমটম চালিয়ে পাঠবিরতি দিয়ে করেছেন লেখাপড়া। দেশসেবার আশা নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ফায়ারম্যান হিসেবে। কে জানতো এমন দুর্গম হাওর বালকই একদিন দেখাবেন অসীম সাহসিকতায় আত্মত্যাগের অসামান্য নজির।
উদ্ভাসিত হবেন বীরের মহিমায়। অন্যের জীবন বাঁচাতে গিয়ে অকাতরে বিলিয়ে দেবেন নিজের জীবন। বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে আটকা পড়াদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে গুরুতর আহত সোহেল রানাকে আর বাঁচানো যায়নি। চিকিৎসকদের প্রাণান্ত চেষ্টা আর দেশবাসীর অফুরান প্রার্থনাকে ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তার মৃত্যুতে কাঁদছে পুরো দেশ। এই অগ্নিযোদ্ধার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ছুটে যান আগুন নেভানো ও আটকেপড়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করতে। ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মীদলে ছিলেন কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনের ফায়ারম্যান সোহেল রানাও। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের উঁচু ল্যাডারে উঠে আগুন নেভানোর পাশাপাশি ভবনে আটকে পড়াদের উদ্ধারে সক্রিয় ছিলেন সোহেল রানা। অসীম সাহসিকতায় অগ্নিকুণ্ড থেকে বের করে এনে জীবন বাঁচিয়েছেন অনেকের। কিন্তু বিধি বাম! হঠাৎ ল্যাডারটি বন্ধ হয়ে গেলে বিপাকে পড়েন সোহেল। কেননা ল্যাডারের বাস্কেটে তখন ভবন থেকে উদ্ধার করা পাঁচ-ছয় জন রয়েছেন। ফলে বাস্কেটে জায়গা হচ্ছিলো। উদ্ধার করা ব্যক্তিদের ঝুঁকির কথা ভেবে সোহেল রানা ল্যাডারের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করেন। তখনই ঘটে চরম দুর্ঘটনাটি। ল্যাডারে পা আটকে গিয়ে ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে যায় সোহেলের ডান পায়ের হাড়। টান পড়ে কোমরে বাঁধা সেফটি হুকেও। মই থেকে পিছলে পড়ে বিপজ্জনকভাবে ঝুলছিলেন তিনি।
পেটে চাপ লেগে নাড়িভুঁড়িও থেঁতলে যায়। কিছুক্ষণ পরেই অজ্ঞান হয়ে যান সোহেল রানা। নিয়ে যাওয়া হয় সিএমএইচ-এ। সিএমএইচ-এর আইসিইউতে ভেন্টিলেশনে রেখে দেয়া হয় চিকিৎসা। সহকর্মীরা দিয়েছেন ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত। কিন্তু কিছুতেই আশার আলো দেখছিলেন না চিকিৎসকরা। এ রকম পরিস্থিতিতে গত ৪ঠা এপ্রিল সোহেল রানার চিকিৎসার খোঁজ নিতে গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরদিনই ৫ই এপ্রিল সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সোহেল রানাকে সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৭ মিনিটে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ফায়ার ফাইটার সোহেল রানা।
সোমবার গভীর রাতে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে সোহেল রানার যখন হৃদস্পন্দন থেমে যায়, তখনো ছেলের সুস্থতা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় নিদ্রাহীন রাত পার করছিলেন মা হালিমা বেগম। সকাল ৭টার দিকে যখন একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন তিনি, তখনই আসে মায়ের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেয়া খবরটা। সিঙ্গাপুর প্রবাসী মামাতো ভাই শফিকুল ইসলাম ফায়ারম্যান সোহেল রানার ছোটভাই রুবেল মিয়াকে মুঠোফোনে জানান সোহেল রানার মারা যাওয়ার চরম দুঃসংবাদটি। এরপর থেকেই পরিবারটিতে চলছে মাতম আর আহাজারি।
নিহত ফায়ারম্যান সোহেল রানা (২৪) কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার চৌগাংগা ইউনিয়নের কেরুয়ালা গ্রামের প্রান্তিক কৃষক নূরুল ইসলামের ছেলে। তার মায়ের নাম হালিমা খাতুন। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয় এবং ভাইদের মধ্যে সবার বড় সোহেল রানা। বড় বোন সেলিনা আক্তার বিবাহিত, ছোট তিন ভাইয়ের মধ্যে রুবেল মিয়া (২৩) উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক প্রথমবর্ষের ছাত্র, উজ্জ্বল মিয়া (২১) করিমগঞ্জ সরকারি কলেজে বিবিএ তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এবং সবার ছোট দেলোয়ার হোসেন (১৫) চৌগাংগা শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির ছাত্র।
সোমবার দুপুরে ফায়ারম্যান সোহেল রানার কেরুয়ালা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের চৌচালা ঘরটির জরাজীর্ণ দশা। বাড়িভর্তি শোকাহত লোকজন। মা হালিমা খাতুন বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন। পাগলপারা সোহেলের মাকে সান্ত্বনা দেয়া ভাষা নেই আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীর। ঘরের এক কোণে পড়ে থেকে বড় বোন সেলিনা ভাই হারানোর শোকে বিলাপ করছেন। কাঁদছেন আত্মীয়স্বজন আর পাড়াপড়শীরাও।
স্বজনেরা জানান, সোহেল রানার বাবা নূরুল ইসলাম প্যারালাইসিসের রোগী। তিনি পার্শ্ববর্তী বর্শিকূড়া হাওরে পত্তনি জমিতে জিরাত চাষ করেন। ছোট তিন ভাইয়ের মধ্যে ছোটভাই দেলোয়ার হোসেন পড়ালেখার পাশাপাশি অন্যের অটোরিকশা ভাড়ায় চালায়। ফায়ার সার্ভিসে সোহেলের চাকরি হওয়ায় আশার আলো দেখেছিল পরিবারটি। ফায়ারম্যান সোহেল রানার চাকরির সামান্য বেতনই ছিল পরিবারের মূল উপার্জন। সোহেল রানা নিজে উদ্যোগী হয়ে কয়েক বছর ধরে ছোটভাই বিবিএ শিক্ষার্থী উজ্জ্বল মিয়াকে ফায়ার সার্ভিসে চাকরির জন্য চেষ্টা করে আসছিলেন। কিন্তু তিন বারের চেষ্টায়ও লিখিত পরীক্ষার বাঁধা পেরোতে পারেনি উজ্জ্বল মিয়া। এরপরও মা হালিমা খাতুনের আশা ছিল, ছেলের চাকরি আয়ে জরাজীর্ণ ঘরটি ভেঙে নতুন ঘর উঠাবেন, ছেলেকে বিয়ে করাবেন। কিন্তু সকল আশা ভরসা ভেঙে চুরে শেষ হয়ে গেছে তার।
সোহেল রানা স্থানীয় কেরুয়ালা জামে মসজিদে কোরআন শিক্ষা, চৌগাংগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে চৌগাংগা শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায় সোহেল রানার লেখাপড়া। এই সময়ে অটোরিকশা ও টমটম চালিয়ে পরিবারকে সহায়তা করেছেন। এভাবে দুইবছর পাঠবিরতির পর করিমগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে ২০১৪ সালে এইচএসসি পাস করেন। এইচএসসি পাসের পর ২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে ফায়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সে। ট্রেনিং শেষে মুন্সীগঞ্জে প্রথম যোগদান করেন সোহেল রানা। সেখানে মাস চারেক দায়িত্ব পালন করার পর থেকে তিনি কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
সোহেল রানার ছোটভাই রুবেল মিয়া জানান, সর্বশেষ গত ১৫ই মার্চ ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন সোহেল রানা। ছুটি শেষে ২৩শে মার্চ তিনি কর্মস্থলে যোগ দেন। কর্মস্থলে যোগ দেয়ার মাত্র ৫দিন পরেই ২৮শে মার্চ ঘটে বনানীর এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মর্মন্তুদ ঘটনা।
রুবেল বলেন, ভাই-ই ছিলেন আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর মৃত্যু আমাদের স্তব্ধ করে দিয়েছে। সামনে আমাদের জীবন অন্ধকার। এখন একমাত্র সরকারই পারে আমাদের এই অকুলপাথার থেকে বাঁচাতে।
সিঙ্গাপুর প্রবাসী মামাতো ভাই শফিকুল ইসলামের বরাত দিয়ে ফায়ারম্যান সোহেল রানার ছোটভাই রুবেল মিয়া জানান, সোমবার বাংলাদেশ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সিঙ্গাপুর থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সোহেল রানার মরদেহ দেশে পাঠানো হবে। রাত সাড়ে ১০টায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটির অবতরণ করার কথা রয়েছে। মঙ্গলবার সোহেল রানার মরদেহ কেরুয়ালা গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হবে। স্থানীয় ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে গ্রামের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
বিকাল ৪টার দিকে রুবেলের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে হাওর থেকে বাড়িতে ফিরেন সোহেল রানার বাবা নূরুল ইসলাম। তখনও তিনি জানতেন না, তার আদরের ধন সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে দূরে বহুদূরে। বাড়িভর্তি মানুষজন আর স্ত্রী-কন্যা-স্বজনদের কান্না আর আহাজারি দেখে তিনি নির্বাক হয়ে যান। বুঝতে পারেন, সোহেল রানার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শেষ আশার প্রদীপটিও যে নিভে গেছে। তাঁর চোখের কোণ বেয়ে নীরবে ঝরে পড়ে অশ্রুবিন্দু।
সোহেল রানার বাল্যবন্ধু শহীদুল ইসলাম জানান, সোহেল খুব বন্ধুবৎসল ছিল। তার মাঝে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ ছিল না। মানুষের সঙ্গেশার তার অসাধারণ একটি গুণ ছিলো। যে কারণে সে সহজেই সবার সঙ্গে মিশতে পারতো।

No comments

Powered by Blogger.