আলাদা থাকছে না আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা by শাহেদ শফিক

দীর্ঘদিন ধরে আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং বাণিজ্যিকে আবাসিক ব্যবহারের অনুমোদনে কঠোর হওয়ার কথা বলা হলেও এ অবস্থান থেকে সরে আসছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, নাগরিকদের প্রয়োজনে এবার কোনও এলাকাকে আবাসিক বা বাণিজ্যিকভাবে চিহ্নিত করে দেওয়া হবে না। সব এলাকা একই সঙ্গে হবে আবাসিক ও বাণিজ্যিক। তবে শিল্পকারখানা বা শপিংমলের জন্য শর্তসাপেক্ষে এলাকা চিহ্নিত করে দেওয়া হবে। রাজউকের ডিটেইল এরিয়া প্লানে (ড্যাপ) এসব সিদ্ধান্ত অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপ প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তবে রাজউকের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা মনে করেন, নিমতলী ও চকবাজার ট্র্যাজেডির পর আবাসিক ও বাণিজ্যিকের মিশ্র ব্যবহারকে উৎসাহিত করার নামে বিপর্যয়ের কারণ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে কিনা, সেটা গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে দেখা দরকার।
রাজউক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুরু থেকেই আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা ভাগ করে দেওয়া হলেও তা মানা হয়নি। অনেক চেষ্টা করেও ভবন মালিকদের বাণিজ্যিক ব্যবহার থেকে দূরে রাখা যাচ্ছে না। আবাসিকের বাসিন্দাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য বাণিজ্যিক ভবন বা দোকানের প্রয়োজন থাকায় এটি গুরুত্বও বহন করছে। মানুষের প্রয়োজনেই বিভিন্ন আবাসিক ভবনে দোকানপাট গড়ে উঠেছে।
তারা বলেন, নাগরিকদের প্রয়োজন মেটানোর দায়িত্ব রাজউকেরও রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে নিরাপত্তার জন্য কঠোরতার সঙ্গে কিছু শর্ত দেওয়া হবে। আবাসিক ভবনের নিচে যেসব ফ্লোর বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার হবে সেগুলোতে শুধু নাগরিকদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বেচাবিক্রি করতে হবে।
রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এক গবেষণায় দেখা গেছে, জনচাহিদার কারণে আবাসিকের প্রায় ৯০ শতাংশ ভবনে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় দোকানপাট গড়ে উঠেছে। ফলে আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা অনেকটা একাকার হয়ে পড়েছে।
তারা জানান, রাজউকের নিয়ম উপেক্ষা করে গড়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না। এসব প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগও করেছে বিপুল অর্থ। এসব দোকানপাট উচ্ছেদ করতে গেলে আন্দোলন শুরু হয়। দোকানিদের পাশাপাশি এলাকার বাসিন্দারাও রাস্তায় নামেন।
রাজউকের কর্মকর্তারা বলেন, যদি এসব দোকান না থাকে তাহলে একটা সাবান বা এক কেজি পেঁয়াজের জন্য রিকশা ভাড়া করে বা ব্যক্তিগত গাড়িটি নিয়ে এক-দুই কিলোমিটার দূরে যেতে হয়। এতে দুর্ভোগ যেমন বাড়ে তেমনই সড়কেও বাড়ে যানবাহনের চাপ।
জানতে চাইলে ড্যাপ পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পনা করা। আমাদের তো মানুষেরই জন্য চিন্তা করতে হবে। তাই এবার ড্যাপে কোনও কমিউনিটিকে আবাসিক হিসেবেও দেবো না, আবার বাণিজ্যিক হিসেবেও দেবো না। মিশ্র এলাকা হিসেবে ড্যাপে সুপারিশ করছি। কারণ, প্রতিটি এলাকায় দেখা গেছে বিভিন্ন ধরনের দোকানপাট গড়ে উঠেছে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ঢাকা শহরে দুই কোটি মানুষের বসবাস করছে। এর মধ্যে কম সংখ্যক মানুষই চাকরি করে। বাকিরা এ জাতীয় সাধারণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করছে। আমাদের এই মানুষগুলোর কথাও চিন্তা করতে হবে। যুগের প্রয়োজন এবং বাস্তবতার নিরিখে এসব বিষয় এখন প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। তাদের বিষয়টিও আমাদের দেখতে হচ্ছে। তারা হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করেছে। এই মানুষগুলো সমাজে কন্ট্রিবিউট করে যাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে অবদান রাখছে। কিন্তু রাজউক বর্তমান প্রক্রিয়ায় তাদের অস্বীকার করে যাচ্ছে।’
আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘সীমাবদ্ধতার কারণে রাষ্ট্র এই মানুষগুলোকে চাকরি দিতে পারছে না। যদি নাই দিতে পারে তাহলে তো তাদের ফরমালাইজড করতে হবে। সে জন্যই আমরা এবার এই বিষয়টি ড্যাপে অন্তর্ভুক্ত করছি।’
ড্যাপ পরিচালক বলেন, ‘আমরা পিওর রেসিডেন্সিয়াল কোথাও রাখবো না। তবে বড় বড় শপিংমলের জন্য গাইডলাইন করে দিচ্ছি। এগুলো কত ফিট রাস্তার পাশে হবে, কোন জায়গায় হবে, তার আয়তন কতটুকু হবে— সেই নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত করে দেব। শুধু ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা আলাদা করে দেবো।’
রাজউকের এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, রাজউক তাদের ব্যর্থতা ঢাকতেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাজউক যদি আবাসিককে আবাসিক আর বাণিজ্যিককে বাণিজ্যিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারতো তাহলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মিশ্র ব্যবহার রয়েছে। কিন্তু সেখানে দোকানপাটের ধরন ও তালিকা তৈরি করা আছে। এখন আমাদের দেখতে হবে এই মিশ্র ব্যবহারের নামে আমরা আত্মঘাতী কোনও সিদ্ধান্ত নিচ্ছি কিনা।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে সরকারি ব্যবস্থাপনা অনেক দুর্বল, আইন মানা হচ্ছে না, সেখানে মিশ্র ব্যবহারকে উৎসাহিত করার নামে অনেক ধরনের বিপর্যয়ের কারণ তৈরি করে দিচ্ছি কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। অস্ত্রটা কত সুন্দর, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়; গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেটা কার হাতে দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এটা যুক্তিসংগত নয়।’ পুরান ঢাকার নিমতলী ও চকবাজারের ঘটনা এমন মিশ্রব্যবহারের কারণেই ঘটেছে বলেই মনে করেন এই নগর পরিকল্পনাবিদ।

No comments

Powered by Blogger.