সুচির স্কুল ব্যাগ নিয়ে মা-বাবার মাতম by মরিয়ম চম্পা

৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১২টা। উত্তরা রাজউক অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের সুরমা-১ বিল্ডিংয়ের ২০৫ নম্বর ফ্ল্যাটে কেবলই কান্নার সুর-আহাজারি। মাইক্রোবাস চাপায় নিহত স্কুলছাত্রী ফাইজা তাহসিনা সুচির ঘুম ঘরের খাটে বসেই আর্তনাদ করছিলেন পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীরা। খাটের ওপর সুচির গোলাপি রং-এর ব্যাগ আর বারবি ডল আঁকা হার্ডবোর্ড পড়ে আছে। নেই শুধু সুচি। ‘আমার সুচি ডাক্তার হতে চেয়েছিল। সে সব সময় বলতো আম্মু আমি ডাক্তার হয়ে গ্রামে চলে যাবো। গ্রামের গরিব মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা করবো।
সুচি গ্রাম খুব ভালোবাসতো। স্কুলে যাওয়ার পথে রাস্তায় কোনো ভিক্ষুক দেখলেই বলতো আম্মু ওদেরকে টাকা দাও। বাবা বলেছে ভিক্ষুককে টাকা দিলে তার দ্বিগুণ আল্লাহ ফিরিয়ে দেয়। আমার সুচিতো আর তার বাবার পকেটে চকলেট খুঁজবে না’। সুচির মায়ের এমন আর্তনাদে চারপাশের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে।
সুচির মা নার্গিস ইসলাম বলেন, ওর বাবা যত রাত করেই বাসায় ফিরতো না কেন সুচি জেগে থাকতো। কখন বাবা আসবে। বাবার পকেট থেকে চকলেট নেবে। বাবাকে বলতো, বাবা মাথা নিচু করে আমার মুখের কাছে তোমার কানটা দাওতো। গোপন কথা আছে। আম্মু শুনতে পাবে। তাই চুপি চুপি বলবো।
তিনি বলেন, সুচি খুবই অভিমানী মেয়ে ছিল। রাতে ওর বাবা আর আমার মাঝখানে ঘুমাতে পছন্দ করতো। ছোট ছেলে নাকিব মুনসিফ বর্ণকে একপাশে রেখে মেয়েকে আমাদের মাঝে রাখতাম। ছোট ভাই আর বাবার সঙ্গে ছিল তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। যেকোনো বিষয়ে বাবাকে আগে জানাতো। ওর বাবাতো পাগল হয়ে যাবে। একটি চকলেট হলেও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ভাগ করে খেতো। ভাইয়ের সঙ্গে কখনো ঝগড়া করতো না। আমার ছেলে শুধু বোন নয় একটি ভালো বন্ধুকে হারালো। সুচি এর আগে মণিপুরিপাড়া স্কুলে পড়ালেখা করতো। তার পরীক্ষার ফলাফল সবসময়ই ভালো ছিল। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে গত এক সপ্তাহ আগে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছে। ওকে সবসময়ই বলতাম, মাগো তোমাকে আরো বেশি পড়ালেখা করতে হবে। ও বলতো, মা আমিতো খুব ভালো রেজাল্ট করছি। তারপরও তুমি কেন বেশি পড়তে বলো। আমার মা পাখির স্কুলব্যাগ পড়ে আছে। পরীক্ষায় লেখার হার্ডবোর্ড পড়ে আছে। কিন্তু আমার সুচি নেই। সে মৃত্যুর আগে একবার মা কিংবা বাবা বলে চিৎকার করার সুযোগ পায় নি। স্কুল ব্যাগে থাকা হার্ডবোর্ডটি দুমড়ে মুচড়ে গেছে। না জানি আমার মেয়ে কত কষ্টটাই না পেয়ে মারা গেছে।
বোনকে হারিয়ে সুচির ৫ বছর বয়সী ভাই নাকিব মুনসিফ বর্ণ অনেকটা হতবিহব্বল হয়ে পড়েছে। কোনো কথা বলছে না। গালে হাত দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ছোট্ট বর্ণ বোনের সঙ্গে একই স্কুলে পড়ে। বোন ছিল তার খেলার সঙ্গী। তার গল্প করার, দুষ্টুমি করার মানুষটা আজ হারিয়ে গেছে। বোনের কথা জানতে চাইলে বর্ণ বলে, আপু মরে গেছে। সে এখন কবরে।
সুচির বাবা ফাইজুল ইসলাম বলেন, উত্তরা রাজউকের প্রকল্পে নতুন বাসা নিয়েছি। আমার মা খোলামেলা ও সুন্দর পরিবেশে বিকশিত হবে এই ভেবে। সে প্রকৃতি প্রেমিক ছিল। ফুল, ফল, গাছপালা, নদী, পুকুর, জলাশয় এসব পছন্দ করতো। মেয়ের আবদার রাখতে অনেক ভেতরে হওয়া সত্ত্বেও এখানে বাসা নিয়েছি। এখানে পাশেই জলাশয় রয়েছে। আছে বিল। গাছপালা ও আলো হাওয়াসহ গ্রামীণ আবহ। সবই পড়ে আছে। আমার মামনি নেই। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। কোর্ট-কাচারি পছন্দ করি না। কিন্তু যে গাড়িটি আমার মেয়েকে চাপা দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাদের মনুষ্যত্ববোধ বা মানবিকতা নেই। তারা একটিবার আমার কাছে আসে নি। এমনকি নিজেদের ভুল স্বীকার করে সহানুভূতি প্রকাশ করেনি। তাই মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে আমি ঘাতক চালক ও গাড়িতে থাকা টিভি অভিনেতার বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ঘটনার দিন সুচির সঙ্গে থাকা নাজিফা আলম বলে, মাইলস্টোন স্কুলে আমরা একই ক্লাসে পড়তাম। তার সঙ্গে গল্প করতাম। খেলতাম। ওইদিন আমি আর সুচি একসঙ্গেই হাঁটছিলাম। হঠাৎ ও আমার একটু আগে চলে যায়। এ সময় আঙ্কেল (সুচির বাবা) সুচিকে বলে সুচি সাবধানে যাও। তার কথা শুনে সুচি পেছন পানে ঘুরতেই বিপরীত দিক থেকে একটি মাইক্রোবাস এসে প্রথমে তাকে বাড়ি মেরে ফেলে দেয়। এরপর গাড়িটি সুচির শরীরের ওপর চাপা দিয়ে চলে যায়। আমি তখন কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। কি যে হয়ে গেলো। কিছুই বুঝতে পারিনি।
সুচিদের এক প্রতিবেশি বলেন, কি প্রাণবন্ত তরতাজা একটি ফুলের মতো নিষ্পাপ জীবন আমাদের চোখের সামনে নিভিয়ে দেয়া হলো। এটাতো স্বাভাবিক মিত্যু নয়। সুচিকে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনার পর আমাদের ছেলে-মেয়েরা এখন স্কুল-কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে ভয় পাচ্ছে। কম্যুউনিটির অনেক ছেলে মেয়ে গতকাল স্কুলে যায় নি। কোনো বাচ্চা স্বাভাবিক হতে পারছে না। সবার ভেতরে একটি চাপা আতঙ্ক কাজ করছে। আমরা এই হত্যাকান্ডের সঠিক বিচার চাই। নইলে আজকে সুচি গেছে। আগামীকাল আমার বাচ্চার বেলাতেও একই ঘটনা ঘটতে পারে।
নিহত ফাইজা তাহাসিনা সুচি (১০) উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। ঘটনার সময় রাস্তা পার হচ্ছিল তারা। রাস্তা পারাপারের সময় বেপরোয়া গতিতে একটি মাইক্রোবাস তাকে চাপা দিলে এ ঘটনা ঘটে। ওই গাড়িতে করেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় রক্তাক্ত সুচিকে দ্রুত উত্তরার বাংলাদেশ মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করার পরপরই গাড়ির চালক ও যাত্রীরা পালিয়ে যায়। এসময় ঘাতক মাইক্রোবাসটিকে (ঢাকা মেট্রো-চ-১৩-৪১৫৭) জব্দ করে তারা। নিহত ফাইজা তাহাসিনা সুচির বাবা ফাইজুল ইসলাম দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক।

No comments

Powered by Blogger.