বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছবি ব্যবহার করে বার্মিজ সেনাদের মিথ্যাচার

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত পাকিস্তানি বাহিনী ও এর দোসরদের গণহত্যার ছবি ব্যবহার করে রোহিঙ্গা বিদ্বেষী প্রচারণা চালাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সম্প্রতি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রকাশ করা একটি বইয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাঙালিদের ওপর নির্যাতনের ছবিকে রাখাইনের ছবি হিসেবে প্রচার করা হয়। এর মিথ্যা বর্ণনা দিয়ে রাখাইনে গণহত্যা ও নির্যাতনের জন্য রোহিঙ্গাদের ওপর দোষ চাপায় তারা। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বিশ্লেষণে ওই বইটিতে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি ছবির বর্ণনা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে।
এ বছরের জুলাইয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পাবলিক রিলেশন ও সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার ডিপার্টমেন্ট ১১৭ পৃষ্ঠা বিশিষ্ট বইটি প্রকাশ করে। ‘মিয়ানমার পলিটিক্স অ্যান্ড দ্য তাতম্যাডো’ শীর্ষক এ বইয়ে গত বছরের আগস্টে রাখাইনের সেনা অভিযানের বর্ণনা দেয়া হয়। বইটিতে প্রকাশিত কয়েকটি ছবি গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ ও টিনআইয়ের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে দেখে রয়টার্স। কোনো ছবি পূর্বে প্রকাশিত হয়েছে কিনা তা এই পদ্ধতিতে যাচাই করা হয়। সাধারণত সংবাদমাধ্যমগুলো এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। এতে দেখা যায়, বইটিতে প্রকাশিত মোট ৮০টি ছবির বেশিরভাগই বিদেশি প্রতিনিধিদের সঙ্গে সেনাপ্রধানের বৈঠক বা স্থানীয় কর্মকর্তাদের রাখাইন পরিদর্শনের ছবি। যা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরে। কয়েকটি ছবি আবার উগ্রপন্থি রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরসার প্রকাশ করা ভিডিও থেকে নেয়া হয়েছে।
রাখাইনে স্থানীয় সংখ্যালঘুদের ওপর রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের চিত্র হিসেবে বইটিতে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। ছবিতে দুটি মৃতদেহের পাশে এক ব্যক্তি কৃষি উপকরণ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন তিনি জলাশয়ের তীরে ভেসে থাকা ওই মৃতদেহকে উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রকাশ করা বইয়ে এ ছবির ক্যাপশন দেয়া হয়েছে, ‘বাঙালিরা নৃশংসভাবে স্থানীয় সংখ্যালঘুদের হত্যা করেছে।’ সেখানে এটিকে ১৯৪০ সালে রাখাইনে সংঘটিত জাতিগত দাঙ্গার ছবি হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। ওই অধ্যায়ে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। কিন্তু রয়টার্সের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার ছবি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ই-আর্কাইভেও হুবহু একই ছবি সংযুক্ত রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসর আল বদরের হাতে গণহত্যার শিকার বাঙালিদের মৃতদেহ বুড়িগঙ্গা নদী থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে। জাতিগত দাঙ্গার বিষয়ে বার্মিজ সেনাদের ‘ট্রু নিউজ’ বা সত্য বার্তাতে এ ছবিটিই প্রকাশ করা হয়েছে।
ঐতিহাসিক ছবি হিসেবে প্রকাশিত আটটি ছবির মধ্যে তিনটি ছবির উৎস রয়টার্সের বিশ্লেষণে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। আর বাকি পাঁচটি ছবির মূল উৎস যাচাই করা সম্ভব হয়নি। একটি ধূসর সাদা-কালো ছবিতে দেখা যায়, তল্পিতল্পা নিয়ে একদল মানুষ দীর্ঘপথে হেঁটে চলেছে। এই ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, মিয়ানমারের নিম্নাঞ্চলীয় অঞ্চল বৃটিশ উপনিবেশের দখলে যাওয়ার পর বাঙালিরা মিয়ানমারে অনুপ্রবেশ করছে। মূলত এই ছবিতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে রয়টার্সের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ছবিটি ১৯৯৬ সালের। এটি রুয়ান্ডার গণহত্যা থেকে প্রাণ বাঁচাতে তানজানিয়ায় পালাতে থাকা শরণার্থীদের ছবি। পিটার্সবার্গ-পোস্ট গেজেট নামের একটি পত্রিকার আলোকচিত্রী মার্থা রিয়াল ছবিটি তুলেছিলেন। পরে তিনি পুলিৎজার পুরস্কার জিতেছিলেন। এই বিষয়ে পত্রিকাটির মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে তারা সাড়া দেননি।
সেনাবাহিনীর ওই বইয়ে প্রকাশিত আরো একটি ছবিকে ভুয়া বলে শনাক্ত করেছে রয়টার্স। সাদাকালো ওই ছবিতে বিপুলসংখ্যক মানুষকে একটি ভঙ্গুর প্রায় নৌকায় আরোহণ করতে দেখা যায়। বইটিতে এ ছবির ক্যাপশন দেয়া হয়, পানিপথে বাঙালিরা মিয়ানমারে প্রবেশ করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের নৌপথে মালেশিয়া ও থাইল্যান্ড পাড়ি দেয়ার ছবি। ২০১৫ সালে অভিবাসন প্রত্যাশী এসব মানুষকে বহনকারী নৌকাটি আটক করে মিয়ানমারের নৌবাহিনী। মূল ছবিকে উল্টে দিয়ে ও ‘ব্লার’ (অসচ্ছ) করে বইয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। সোর্স হিসেবে মিয়ানমারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
ছবির সত্যতা নিয়ে মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র জ হতে ও সেনাবাহিনীর মুখপাত্রের সঙ্গে রয়টার্সের পক্ষ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। আর মিয়ানমারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ইউ মো মিন্ট এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এখনো বইটি পড়েননি বলে জানান তিনি।
বইটিতে বেশিরভাগ তথ্যের সূত্র হিসেবে সেনাবাহিনীর তথ্য ইউনিট ‘ট্রু নিউজ’ এর উল্লেখ করা হয়। রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর থেকেই এই ইউনিটটি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পক্ষে, বিশেষ করে ফেসবুকে বিভিন্ন প্রচারণা চালিয়ে আসছে। ইয়াঙ্গুনের দোকানগুলোতে এই বইটি বিক্রি করা হচ্ছে। সেখানকার একজন বই বিক্রেতা জানান, তাদের কাছে থাকা ৫০ কপি বই বিক্রি হয়ে গেছে। তবে নতুন করে বইটি বাজারে তোলার কোন পরিকল্পনা তাদের নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই বই বিক্রেতা বলেন, ‘বেশি মানুষ বইটির খোঁজে আসেন না।’
এদিকে, জাতিগত ও ধর্মীয় উত্তেজনা উস্কে দেয়ার অভিযোগ তুলে সোমবার মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ফেসবুক। একই দিনে, জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন তাদের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে রাখাইনে গণহত্যার অভিপ্রায়ে সেনা অভিযান চালানোর দায়ে জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা মিন অং হ্লাইংসহ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করে তারা। মানবতাবিরোধী অপরাধ করার দায়ে তাদের বিচারের মুখোমুখি করার সুপারিশ করে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন।
কিন্তু বইটিতে সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা রাখাইনের সহিংসতার জন্য বাঙালি সন্ত্রাসীদের ওপর দোষ চাপিয়েছে। বলেছে, বাঙালি সন্ত্রাসীরা রাখাইনে ‘আর্কিস্তান’ নামে একটি রোহিঙ্গা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। প্রথমে আরসা’র উগ্রপন্থি রোহিঙ্গারা সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। এর প্রেক্ষিতেই গত বছরের আগস্টে রাখাইনের ওই সেনা অভিযান পরিচালনা করা হয়। সেনাবাহিনী তাদের বইয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে অভিহিত করে তাদের অতীত ইতিহাস বর্ণনা করেছে। এতে লেখক হিসেবে সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল ক্যাও ক্যাও ও’র নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, বইটি বাঙালিদের ইতিহাস উন্মোচনের লক্ষ্যে প্রামাণ্য আলোকচিত্রের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে। দেখা গেছে, মিয়ানমারে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন বা জাতিগত সংঘাতের ঘটনাগুলোকে বাঙালিরা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে। মুসলিমরা মিয়ানমারের নতুন গণতান্ত্রিক পালাবদলের অনিশ্চয়তাকে ধর্মীয় সংঘাত উস্কে দেয়ার সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। এ বিষয়ে রয়টার্সের পক্ষ থেকে ক্যাও ক্যাও ও’র সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.