জনপ্রতিক্রিয়া: ছোটরা পথ দেখিয়েছে by মরিয়ম চম্পা

ছোটরা পথ দেখিয়েছে। ওরা দেখিয়েছে শৃঙ্খলা আনা কঠিন কোনো কাজ নয়। সদিচ্ছাই যথেষ্ট। নিরাপদ সড়কের দাবি নিয়ে রাজপথে নেমে আসা শিশু শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অহিংস আন্দোলন নিয়ে সাধারণ মানুষের ভাবনা এরকমই। তাইতো গত ক’দিনের আন্দোলনে দেশবাসীর সমর্থন পেয়েছে তারা। দেশজুড়ে আলোচনায়ও এখন এসব স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এর আগে দেশে এমন আন্দোলন দেখা যায় নি। গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে অব্যাহত মৃত্যুর একটি বিহিত হওয়া উচিত বলে মনে করছেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ।
ওদিকে পরিবহন শ্রমিকরা হঠাৎ করেই ধর্মঘট ডেকে সকল প্রকার দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। এ অবস্থায় রাজধানী ছিল মূলত গণপরিবহনশূন্য। দু-একটি গাড়ি রাস্তায় বেরুলেও তাতে ছিল উপচেপড়া ভিড়। পান্থপথের চায়ের দোকানি দেলোয়ার, ডাব বিক্রেতা আব্দুল আজিজ, পান বিক্রেতা নূর মোহাম্মদ, রিকশাচালক শাহ আলম, ফয়সাল ও শওকত বলেন, যেটা সরকার বা পুলিশ প্রশাসন পারেনি সেটা ছোটরা করে দেখিয়েছে। তারা বলেন, যার সন্তান গেছে সেই বুঝে সন্তান হারানোর কষ্ট। আজ আমার সন্তান গেছে। কাল আপনার সন্তান যে যাবে না এমনটা কেউ বলতে পারে না। কাজেই ছাত্ররা যেটা করছে একদম ঠিক কাজ করেছে। আমরা চাই সব কিছু একটা সিস্টেমের মধ্যে আসুক। পুলিশ এতদিনে ঢাকার শহরের রিকশাকে একটা লাইনে আনতে পারেনি। যানজট লেগেই থাকতো। আজ ছাত্র সমাজ রিকশাকে একটা লাইনে নিয়ে এসেছে।
কাওরান বাজার আম্বরশাহ মাদরাসার ছাত্র রাজীব, কামরুজ্জামান, সাদিকুর, মুসফিক, তৌহিদুল ও সোহেল বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাস্তায় আন্দোলনে না থাকতে পারলেও তাদের এই আন্দোলনকে সমর্থন করছি। এটা তারা নিঃসন্দেহে ভালো কাজ করছে। আমরা চাই রাস্তার সকল অরাজকতা ও মানুষ খুন বন্ধ হোক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মিথুন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইলাহি, ইমু, হোসেইন, রাব্বি, বাবু ও সুলতানা বলেন, যে কাজগুলো সরকারের করার কথা, সেগুলো স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা করছে। লাইসেন্স না থাকায় ছাত্ররা পুলিশের গাড়িকেও মামলা দিয়েছে। মন্ত্রী-এমপিদের গাড়ি আটকে দিয়ে হেঁটে যেতে বাধ্য করেছে। ইমার্জেন্সি লেন, রিকশার জন্য আলাদ লেন তৈরি করেছে। তারা যেন ৫২, ৬৯ এর উত্তরসূরি। এর মধ্য দিয়ে সরকার তথা গোটা সমাজকে একটাই ম্যাসেজ দিয়েছে। আর তা হলো ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। একই সঙ্গে আরেকটি ম্যাসেজ হলো চাইলেই সংঘবদ্ধভাবে সামাজিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। এ থেকে প্রশাসনের শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু আছে।
ব্যাংকার, রোডর্স অ্যান্ড হাইওয়ে কর্মকর্তা, পরিবহন মালিক, বেসরকারি চাকরিজীবী, আইনজীবী নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ বলেন, এই ক্ষোভ সড়ক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। দেখা গেছে যে মা সন্তানকে নিজে স্কুলে দিয়ে আসতো তারাও আজ সন্তানকে রাজপথে পাঠাচ্ছে। তারা বলেন, কঠিন আইন করতে হবে। মানুষকে বাঁচাতে হবে। বাস মালিকদের শাস্তি দিতে হবে। পুরাতন সব গাড়ি রাস্তা থেকে তুলে নতুন ফিটনেস সম্পন্ন গাড়ি ও সকল চালকদের লাইসেন্স নিশ্চিত করতে হবে। যে আইন আছে তার যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। ঢাকা সিটির সব গাড়িগুলোকে একটি কোম্পানির আন্ডারে নিয়ে আসতে হবে। লাইসেন্সের সহজলভ্যতা বন্ধ করতে হবে। বাসের পাল্টাপাল্টি প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া বাস চালকদের বাসের মালিকরা যে দৈনিক টার্গেট দিয়ে থাকে এটা বন্ধ করতে হবে।
সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চালক আব্দুল আউয়াল, মুন্সি, নিয়াজি, মোতাহের, সঞ্চয়, রমিজ বলেন, গত ১০-১২ বছর ধরে গাড়ি চালাই। অনেক অন্যায় অনিয়ম চোখের সামনে দেখেছি। কিন্তু চাকরি ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কারণে মুখ খুলে প্রতিবাদ করতে পারিনি। সম্প্রতি যে বাস দুর্ঘটনা ঘটেছে তাতে আমাদের এক সহকর্মী বাস চালকের মেয়েও রয়েছে। কিন্তু কাকে কি দোষ দিবো। আমরা নিজেরাইতো দোষী। যখন কোনো ব্যক্তি আমাদের এই পেশা তুলে গালি দেয় তখন কষ্টে বুকটা ফেটে যায়। তাদের কিছু বলতে পারি না। কারণ এই পেশায় আমরা পড়ালেখা করে একাধিকবার বিআরটিএ পরীক্ষা দিয়ে একটি হেবিচুয়াল লাইসেন্স নিতে হয়েছে। অথচ মুষ্টিমেয় কিছু অপেশাদার চালক যাদের নাই কোনো প্রশিক্ষণ, নাই কোনো লাইসেন্স। তারা এসে পেশাটাকে একেবারে তছনছ করে দিয়েছে। কারণ এই পেশায় আসা খুবই সহজ। যে কেউ চাইলে দুই দিন স্টিয়ারিং ধরে তিন দিনের দিন চালক হয়ে যেতে পারে। এর পর সামান্য কিছু ঘুষ দিলেই মিলবে একটা লাইসেন্স। ছাত্ররা যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটাকে সরকার যদি বাস্তবতায় রূপ দেয় তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য চালকদের জন্য আলাদা একটি ইনস্টিটিউট করতে হবে। এবং প্রত্যেক চালককেই শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। এতে করে অনেক শিক্ষিত লোক এই পেশায় আসতে আগ্রহী হবে। আর শিক্ষিত ও আদব কায়দা জানা চালকের হাতে দুর্ঘটনা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এ ছাড়া সকল গাড়ি কাউন্টার ও কোম্পানি সিস্টেমে চলতে হবে। মালিক ও পুলিশের খাই খাই স্বভাবটা বন্ধ করতে হবে। চালকদের কোনো টার্গেট দেয়া যাবে না। রোড খরচ বা পুলিশকে দৈনিক ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। ফলে মালিকরা গাড়ির ফিটনেস, লাইট, রং কোনোটাই ঠিক করছে না। এ ছাড়া মাঝারি সাইজের বাসগুলোর যাত্রী ধারণক্ষমতা ২৫-২৬ জন। সেখানে ৩০-৩৫টা পর্যন্ত সিট বাড়ায়। এটা বন্ধ করতে হবে।
আচার বিক্রেতা টিটোন, ঝালমুড়িওয়ালা সগীর, সিএনজি চালক রহমতউল্লাহ বলেন, যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে মালিক সমিতি অনেক বাড়াবাড়ি ও খারাপ কাজ করছে। ছাত্ররা যেটা করছে সেটা খুব ভালো একটি উদ্যোগ। ওদের আন্দোলনে আমাদের সপ্তাহখানিক ধরে যাতায়াতে সমস্যা হলেও আমরা চাই এটা চলুক। সকালে গাবতলী থেকে অনেক কষ্ট করে একটু বেশি ভাড়া দিয়ে কাজে আসছি। তাতে কোনো দুঃখ নেই। আমরা চাই আইনের সঠিক প্রয়োগ হোক। মালিক-শ্রমিক, পুলিশ সিন্ডিকেট ভেঙ্গে সব সমান করা হোক।
আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীর মা, শিক্ষিকা, গৃহিণী, চাকরিজীবী ৪ নারী বলেন, আমার মেয়ে আন্দোলনে আছে। গত কয়েকদিন ধরে আমি নিজেই তাকে আন্দোলনে দিয়ে আসছি। ওকে আমি একা কখনো কলেজে পাঠাইনি। ও একা কোথাও যেতে পারে না। কিন্তু গত কয়েক দিনে আমার মেয়েটা অনেক বড় হয়ে উঠেছে। আন্দোলনের তৃতীয় দিন দুপুরে মেয়ে ফোন করে বলে মা খুব ক্ষুধা লাগছে কিছু খাবার নিয়া আসো। আমি মেয়ের ক্ষুধার কথা শুনে ওর জন্য সামান্য পানি, কেক ও মুড়ি নিয়ে যাই। কিন্তু নেয়ার পর মনে হলো আমার এতগুলো সন্তানের মধ্যে কাকে রেখে কাকে খাওয়াই। পরে মেয়ের সামনে আর খাবার বের করিনি। মেয়ে বললো মা কিছু আননি। আমি অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে বললাম না মা বাসায় গিয়ে খেয়। গৃহিণী লিপি বলেন, গত ১৭ দিন আগে আমার কলিজার টুকরাকে ঘাতক বাস চাপা দিয়েছে। বাইক এক্সিডেন্ট করে টানা ৪ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে আমার ছেলেটা চলে যায়। আমার যদি সুযোগ থাকতো আমিও ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলন করতাম। বাচ্চাদের সঙ্গে লাইসেন্স চেক করতাম। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হাফসা বেগম বলেন, ওরা ক্ষমার অযোগ্য। গত ৭ মাস আগে আমাকে একটা বাস ধাক্কা দিয়ে ফেলে চলে যায়। কেউ আমাকে হাসপাতালে নেয়নি। সবাই চেয়ে চেয়ে দেখেছে। পরে নিজেই কোনোভাবে উঠে স্থানীয় একটি হাসপাতালে গিয়ে বাড়ির ঠিকানা বলার পর আমাকে চিকিৎসা দেয়া হয়। আমার অনেকগুলো দাঁত ভেঙ্গে যায়। আমি তাদের সঙ্গে আন্দোলনে যেতে পারছি না। কিন্তু আন্দোলনরত ছেলে মেয়ের জন্য আমি দোয়া করছি।

No comments

Powered by Blogger.