আত্মমর্যাদা ও মানবাধিকারের স্বপক্ষে একক কণ্ঠস্বর -নিউ ইয়র্ক টাইমসে নিবন্ধ by জেমস এস্ট্রিন

আগস্টের ৬ তারিখ শহিদুল আলমকে যখন ঢাকার একটি আদালত কক্ষে নেয়া হচ্ছিল, তিনি তখন কাতরাচ্ছিলেন। হাতকড়া পরা শহীদুলের চারপাশে তখন পুলিশ। হঠাৎ তিনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন যে, তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। ঠিক আগের রাতেই তাকে ৩০ জনেরও বেশি সাদা পোশাকধারী কর্মকর্তা বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়।
আন্তর্জাতিকভাবে প্রখ্যাত এই আলোকচিত্রী, শিক্ষক ও মানবাধিকার কর্মী আল জাজিরায় একটি সাক্ষাৎকার ও বেশকিছু ফেসবুক লাইভ ভিডিওতে বক্তব্য রাখার পরপর গ্রেপ্তার হন। সেখানে সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের প্রতি সরকারের সহিংস প্রতিক্রিয়ার কড়া সমালোচনা করেন তিনি। শহীদুল আলমসহ ওই প্রতিবাদ কাভার করতে যাওয়া অনেক ফটোসাংবাদিককে পুলিশ ও শাসক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন সশস্ত্র গোষ্ঠী আক্রমণ করে।
তার বিরুদ্ধে এখন বাংলাদেশের আইসিটি আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে। এই আইনানুযায়ী কেউ অনলাইনে সরকারের সমালোচনা করলে কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারে। অন্তত ১১ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাকে কারাগারে থাকতে হবে। এই সপ্তাহে তার জামিন আবেদন দাখিল করা হলেও শুনানি হবে ওই দিন।
বহু মানবাধিকার সংস্থা এবং সাংবাদিকতা ও ফটোগ্রাফি বিষয়ক বিভিন্ন সংস্থা বেশ জোরালোভাবে তার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়েছে। কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের প্রতি অনতিবিলম্বে সাংবাদিকদের ওপর হামলা বন্ধ ও শহীদুল আলমকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ডেপুটি পরিচালক ওমর ওয়ারাইখও তার নিঃশর্ত মুক্তি চেয়েছে। তিনি বলেন, ‘কাউকে শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণভাবে নিজের মতপ্রকাশের কারণে আটক করার মধ্যে কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না।’
বাংলাদেশে ৩ দশকেরও বেশি সময় ধরে ফটোগ্রাফির সঙ্গে জড়িত শহীদুল আলম। তিনি বড় ঘটনাবলী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ক্ষমতার পালাবদল, গার্মেন্ট শ্রমিকদের মৃত্যু এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াই নিয়ে কাজ করেছেন। নিজের ছবির মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের সরকার ও সামরিক বাহিনীকে বাকস্বাধীনতা ও রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের গুম নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন।
একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিনি অসংখ্য তথ্যচিত্রনির্মাতা তৈরিতে সহায়তা করেছেন। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করেছেন। ৩০ বছর ধরে তার পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইন্সটিটিউট বহু প্রতিভাবান আলোকচিত্রীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। বাংলাদেশে একটি চমৎকার আলোকচিত্রী সম্প্রদায় থাকার সুনাম তৈরিতে সহায়তা করেছেন তিনি। ১৯৯৯ সালে তিনি যেই ছবি মেলা উৎসব চালু করেছেন, তাতে যোগ দিতে বিশ্বের বহু জায়গা থেকে আলোকচিত্রীরা আসেন ঢাকায়। ১৯৮৯ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন দৃক ফটো এজেন্সি। এর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশি আলোকচিত্রীদের কর্ম বিশ্বব্যাপী বিক্রির ব্যবস্থা করেছেন।
পশ্চিমা গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতেও দ্বিধা করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশের মতো দেশ কীভাবে চিত্রিত হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে একচ্ছত্র ক্ষমতা কেবল পশ্চিমাদেরই। ২০১৩ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘দরদী গল্পমালা বাংলাদেশের মনন ও অর্থনীতির অনেক ক্ষতি করেছে। বাংলাদেশের ছবি ব্যবহার করে এক ধরনের উপনিবেশিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশকে সবাই শুধু দারিদ্র্য ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে চেনে।’
শহীদুল আলম মানেন যে, দারিদ্র্যও বাংলাদেশের গল্পের অংশ। তবে রিপোর্টিং যখন শুধু দারিদ্র্যকে কেন্দ্র করে হয়, তখন এর মাধ্যমে এক ধরনের ক্ষতিকর সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিই উপস্থাপিত হয়। পশ্চিমা মিডিয়া বা তাদের নিয়োগ দেয়া বিদেশি সাংবাদিকরা বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছে, এমনটা হয়েছে খুবই কম।
তার ভাষ্য, ‘একটি আফ্রিকান প্রবাদ আছে, যেটাকে আমি প্রাসঙ্গিক মনে করি। সেটি হলো, ‘যতদিন পর্যন্ত সিংহ নিজের গল্প বলার মতো কাউকে খুঁজে না পাবে, ততদিন শিকার নিয়ে হওয়া গল্পে শুধু শিকারিরই গুণগান গাওয়া হবে।’ আমাদের গল্প আমাদেরকেই বলতে হবে। আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে যে আমাদের বিষয়বস্তুর প্রতি আমরা সংবেদনশীল ও শ্রদ্ধাশীল হবো। পাশাপাশি, মানুষকে যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তাতে যেন তার আত্মমর্যাদা ঠিক থাকে।’
পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গ আলোকচিত্রী বা অন্য কেউ বাংলাদেশের গল্প বলুক, তাতে তার আপত্তি নেই। কারণ, বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গিকেও চ্যালেঞ্জ করার লোক থাকতে হবে। তবে বাংলাদেশের গল্প বলার ক্ষেত্রে পশ্চিমা আলোকচিত্রীরাই একচ্ছত্র এখতিয়ার পাবে, তা নিয়ে শহীদুলের ভীষণ আপত্তি।
আজ থেকে ২৫ বছর আগে শহীদুল আলম ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর মতো বৈশ্বিক ফটোগ্রাফি বিষয়ক সংস্থাকে বলতে থাকেন যে, বিশ্বের সব দেশের আলোকচিত্রীকেই সহায়তা দিতে হবে। প্রতিযোগিতার বিচারকদের মধ্যে বৈচিত্র্য থাকতে হবে। তখন শহীদুলের সঙ্গে তাল মেলানোর কেউ ছিল না। অথচ, আজ অনেকেই পূর্বধারণাবশত উপস্থাপনার বিরুদ্ধে তার লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন।
এই বছর নিউ ইয়র্ক পোর্টফোলিও রিভিউতে যেসব ফটোসাংবাদিক ও সম্পাদক অংশ নিয়েছেন তারা কাছ থেকে দেখেছেন ফটোগ্রাফি নিয়ে তার অনুরাগের কিয়দাংশ। তিনি বেশ দারুণ এক আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন নিউ ইয়র্ক টাইমসের লেন্স ব্লগের অন্যতম সম্পাদক ডেভিড গঞ্জালেজের সঙ্গে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্গানিক কেমিস্ট্রিটে পিএইচডিধারী শহীদুল একটি কথা প্রায়ই বলে থাকেন, সেটি ওই অনুষ্ঠানেও তিনি বলেছেন। সেটি হলো, তিনি ‘তৃতীয় বিশ্বে’র মতো শব্দগুচ্ছ পরিহার করেন। তার মতে, বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষই এই তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বে বসবাস করেন। সুতরাং, তিনি একে বলেন ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের বিশ্ব’ (মেজরিটি ওয়ার্ল্ড)।
২০০৭ সালে তিনি মেজরিটি ওয়ার্ল্ড ফটো এজেন্সি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি আফ্রিকান, লাতিন আমেরিকান ও এশিয়ান আলোকচিত্রীদের জন্য সুযোগ ছড়িয়ে দিয়েছেন। গত বছর তিনি উইমেন ফটোগ্রাফি, ডাইভারসিফাই, এভরিডে প্রজেক্ট ও নেটিভ এজেন্সির সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রিক্লেইম।’ এই সংস্থাটির উদ্দেশ্য হলো নারী ও বৈচিত্র্যময় ব্যাকগ্রাউন্ডের অধিকারী মানুষের জন্য ফটোগ্রাফির সুযোগ বিস্তৃত করা।
নিজের ক্যারিয়ারে শহীদুল আলম বহুবার বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের মুখোমুখি হয়েছেন। ২০১৩ সালে ভিন্নমতাবলম্বীদের বলপূর্বক অন্তর্ধান নিয়ে তার আলোকচিত্র প্রদর্শনী শুরুর কয়েক মিনিট আগে পুলিশ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু দমে না গিয়ে, শহীদুল আলম ও তার সহযোগীরা গ্যালারির বাইরে সড়কের ধারে ওই প্রদর্শনী চালিয়ে যান। ২০০৯ সালে দৃক গ্যালারিতে তিব্বতের ওপর ছবির প্রদর্শনী আয়োজন করেন। কিন্তু চীন সরকার বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিয়ে দাঙ্গা পুলিশের মাধ্যমে ওই প্রদর্শনী বন্ধ করায়। ১৮ বছর আগে তার দৃক গ্যালারি ছিল সরকারবিরোধী কর্মীদের বৈঠকস্থল। তখন একদিন রাতে শহীদুল আলমকে রিকশায় একদল লোক আটকায়। তার কম্পিউটার নিয়ে যায়। আর তাকে ৮ বার ছুরিকাঘাত করে।
হুমকি ও আক্রমণ সত্ত্বেও, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র, সাম্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে ফটোগ্রাফির শক্তি ব্যবহারে শহীদুল আলমের অঙ্গীকারে এতটুকু চিড় ধরেনি। ২০০৭ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কী পদচ্ছাপ ফেলে গেলাম সেটা আমার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আমি কীভাবে বিশ্বকে প্রভাবিত করলাম বা করলাম না। আমি কিছু পন্থায় চেয়েছি হস্তক্ষেপ করতে, যাতে করে যেই পৃথিবীতে আমার বসবাস, সেটিকে আমি যেভাবে পেয়েছি, তার চেয়ে ভিন্ন অবস্থায়-মঙ্গলের পথে-রেখে যেতে পারি।’
(জেমস এস্ট্রিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার লেন্স ব্লগের অন্যতম সম্পাদক। তার এই নিবন্ধ নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত।)

No comments

Powered by Blogger.