রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যেসব সুপারিশ করলো জাতিসংঘ

মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অভিযানের ঘটনায় প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের স্বাধীন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন। ঘটনার এক বছর পর প্রকাশিত তদন্তে মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে সংঘটিত অপরাধে প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নসহ মারাত্মক অপরাধের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনারও সুপারিশ করা হয়েছে। এজন্য নির্যাতনের শিকার মানুষগুলোকে দেশে ফিরিয়ে আনা, তাদের পুনর্বাসন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংস্কার নিশ্চিত করাসহ আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও কিছু নির্দিষ্ট সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। মানবাধিকার কাউন্সিলের আওতায় ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন মিয়ানমারের ২০১১ সাল থেকে জাতিসংঘের ভূমিকার বিষয়টিও তদন্ত করে দেখার কথা বলেছে। এছাড়া এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করার জন্য সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
গত বছরের ২৫ আগস্ট নিরাপত্তা চৌকিতে আরসার হামলাকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের কারণ বলা হলেও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিতে এবং তাদের ফেরার সব পথ বন্ধ করতে আরসার হামলার আগে থেকেই পরিকল্পিত সেনা-অভিযান শুরু হয়েছিল। চলমান জাতিগত নিধনে হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মানুষ। এক বছরেও মিয়ানমারের এই পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। এখনও আশার আলো দেখার মতো, নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হওয়ার মতো অবস্থায় নেই বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লাখ লাখ মানুষ। এসব মানুষকে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে ও ভবিষ্যতে এমন ঘটনার শিকার হওয়া থেকে বাঁচাতে তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশগুলো করা হয়েছে।
জাতিসংঘ তদন্ত প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য করা সুপারিশগুলো নিম্নরুপ: 
ক. গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ থেকে নিজেদের জনগণকে সুরক্ষার দায়িত্বপালনে মিয়ানমারকে সহায়তা করতে জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সব ধরনের কূটনৈতিক, মানবিক ও অন্যান্য শান্তিপূর্ণ উপায়ের ব্যবহার করা উচিত। তাদের জাতিসংঘ বিধান অনুসারে ব্যাপক পদক্ষেপ নিতে হবে।

খ. নিরাপত্তা পরিষদের উচিত আন্তর্জাতিক আইনে মিয়ানমারে সংঘটিত অপরাধগুলোর বিচার নিশ্চিত করা। বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা তার বিকল্প সাময়িক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা যেতে পারে। এছাড়া নিরাপত্তা পরিষদকে আন্তর্জাতিক আইনে মারাত্মক অপরাধের ঘটনায় মূল দায়ী ব্যক্তিদের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাসহ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার মতো নিষেধাজ্ঞা আরোপও করতে হবে। আর মিয়ানমারের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।

গ. নিরাপত্তা পরিষদে কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত সাধারণ অধিবেশন বা মানবাধিকার কাউন্সিলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নির্যাতনের প্রমাণ সংগ্রহ, একত্রিকরণ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের জন্য একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ উপায় বের করতে হবে যেন জাতীয়, আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক আদালত বা ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য নথিপত্র প্রস্তুত করা যায়।

ঘ. মানবাধিকার কমিশনকে মিয়ানমারে বিশেষ দূত ও মানবাধিকার কমিশনের হাই কমিশনারের কাজে সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। মিয়ানমারে মানবাধিকার সংকটের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখার জন্য তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ থাকার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।

ঙ. মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের বিচার নিশ্চিত করার জন্য মানবাধিকার কাউন্সিলকে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনকে বিশেষভাবে অনুরোধ করতে হবে। এজন্য মানবাধিকার পরিস্থিতিতে নজরদারি বাড়ানো, নথিভুক্তকরণ, বিশ্লেষণ ও প্রকাশ্য প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত নাগরিক সমাজ ও অন্যান্য পক্ষগুলোর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং ভুক্তভোগী সম্প্রদায়গুলোকে বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন করতে কাউন্সিলকে কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মোতাবেক আইন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংস্কারের জন্যও মিয়ানমারকে সহায়তা করতে হবে। এজন্য দেশটিকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।

চ. যদি উপরের (খ) ও (গ) এ বর্ণিত সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা না হয় অথবা (ঙ) অনুসারে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনকে উজ্জীবিত করার প্রয়োজন পড়ে, তাহলে মানবাধিকার কাউন্সিলকে স্বল্প সময়ের জন্য আরেকটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গঠন করতে হবে।

ছ. ‘হিউম্যান রাইটস অব ফ্রন্ট অ্যাকশন প্ল্যান’ অনুসারে মানবাধিকার বিষয়ে মিয়ানমারের সংশ্লিষ্ট সবকিছুকে বিচারের আওতায় আনার জন্য জাতিসংঘকে দ্রুত একটি সাধারণ কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। এই কৌশলে মিয়ানামারে বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘের কৌশল ও প্রকাশ্য প্রচারণা অবস্থানসহ সব কার্যক্রমের নির্দেশনা থাকবে। পূর্ণ মানবাধিকার বাস্তবায়নের নিরন্তর বিশ্লেষণের মাধ্যমে মিয়ানমারকে জাতিসংঘের সব সহায়তা প্রদান করতে হবে।

জ. ২০১১ সাল থেকে মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের সম্পৃক্ততার বিষয়ে অবশ্যই জরুরি ভিত্তিতে বিস্তারিত ও স্বাধীন তদন্ত করতে হবে। কারণ সেখানকার বিদ্যমান সংকটের সবকিছু ঠেকানো বা প্রশমিত করা যেত কিনা তা জানা প্রয়োজন। এছাড়া সেখান থেকে পাওয়া শিক্ষণীয় বিষয়গুলো চিহ্নিত করা ও জবাবদিহিতাসহ যথার্থ সুপারিশ করা এবং ভবিষ্যতে আরও কার্যকর কাজের সক্ষমতার জন্য এই তদন্ত জরুরি।

ঝ. জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন ও আন্তর্জাতিকভাবে বিতাড়িত মানুষকে শুধুমাত্র তখনই ফেরত আনা হবে, যখন নাগরিকত্বসহ সুস্পষ্ট মানবাধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে তা নিরাপদ, স্বেচ্ছামূলক ও মর্যাদাপূর্ণ হবে। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের ফেরত আনা সম্ভব না।

ঞ. সব সদস্য দেশকে মানবাধিকার দৃষ্টিকোণ এবং সুস্পষ্টভাবে বৈষম্যহীনতা ও সমতার নীতি মেনে মিয়ানমারের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক রাখাসহ ত্রাণ সহায়তা, উন্নয়ন ও সংস্কার প্রকল্পগুলোতে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। মিয়ানমারে কর্মরত ত্রাণ সংস্থাগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলও সদস্য দেশগুলোকেই নিশ্চিত করতে হবে। মিয়ানমারে সত্যিকারের সংস্কারের ব্যাপারে স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি না দেওয়া পর্যন্ত দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কারণ দেশটিকে এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ও অপরাধীদের বিচারে আন্তর্জাতিক কৌশলকে মেনে নেওয়ার পাশাপাশি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।  

ট. নিরাপত্তা পরিষদে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা না হলেও সদস্য দেশগুলোর উচিত হবে মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা বন্ধ করা। কারণ দেশটিতে আন্তর্জাতিক আইনে মারাত্মক অপরাধ করার মাধ্যমে শান্তি ও নিরাপত্তাকে হেয় করার ঝুঁকি রয়েছে।

ঠ. সংঘটিত অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত করতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আসিয়ানসহ সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক সংগঠনগুলোকে কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে টেকসই সম্পর্কের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা করতে এই কৌশল প্রয়োজন।

ড. মিয়ানমারে সংঘটিত মারাত্মক অপরাধের ঘটনায় অভিযুক্তদের ব্যাপারে তদন্ত ও বিচার করার জন্য বিচার ব্যবস্থার ওপর সদস্য দেশগুলোকে আস্থা রাখতে হবে।

ঢ. জাতিসংঘকে ভুক্তভোগীদের মানসিক স্বাস্থ্য, আইনি সহায়তা, জীবিকায় সহায়তাসহ অন্যান্য উপায়ে সহায়তা করার জন্য ভিকটিম সাপোর্ট ফান্ড গঠন করতে হবে। এই ফান্ডের সব প্রকল্পই ভুক্তভোগীদের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.