মহিলাবাসের সাহসিকা by মরিয়ম চম্পা

ভোলার মেয়ে সুমি। সাহস যেন তার আষ্টেপৃষ্ঠে। যেমন কথায়, তেমনি চলনবলনে। জীবনযুদ্ধ শুরু হয় জন্মের পরপরই। তিন বোন চার ভাইয়ের মধ্যে সুমি সবার বড়। সুমির আসল যুদ্ধটা শুরু হয় ।
২০১৪ সালে ভালোবেসে জাভেদ আহমেদকে বিয়ে করার পর থেকে। কী কাজ করেনি সুমি! সোয়েটার ফ্যাক্টরি, গার্মেন্ট সর্বত্রই। বিআরটিসিতে মহিলাবাসে নারী কন্ডাক্টর হিসেবে সুমির যোগদানটা ছিল অনেকটা নাটকীয়। ২০১০ সালে গাজীপুরের একটি সোয়েটার ফ্যাক্টরি থেকে কাজ শেষে চৌরাস্তা থেকে সালনা যাচ্ছিলেন। এসময় ডাবল ডেকার বাসের কন্ডাক্টরকে ভাড়ার জন্য ১শ টাকার একটি নোট দেন সুমি। কন্ডাক্টরের ভাড়া কাটা পছন্দ হয়নি সুমির। সে বাসভর্তি লোকের সামনে বলে ফেললো কেমন কন্ডাক্টর আপনে। ঠিকভাবে ভাড়াটাও কাটতে পারেন না। আপনে না পারলে আমাকে দেন, আমি কাটি। এসময় বাসে বসা বিআরটিসির এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, আপনে কি সত্যিই এই বাসের সব যাত্রীদের ভাড়া কাটতে পারবেন। জবাবে দৃঢ়চেতা সুমি সাহস নিয়ে বললো কেন পারবো না। এটা কোনো বিষয় হলো। এসময় সুমিকে নিয়ে ওই কর্মকর্তা উত্তরা বিআরটিসির বাস ডিপোতে যান। ডিপো ম্যানেজার তাকে গাজীপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত কয়টি বাসস্ট্যান্ড এবং প্রত্যেক স্ট্যান্ডে কত টাকা ভাড়া জানতে চাইলেন। সুমি অনেকটা মুখস্থ বলে দিলেন। এভাবেই মুখে মুখে চাকরি হয়েছে সুমির।
সুমি যে শুধু বিআরটিসি বাসে জীবিকার তাগিদে কাজ করছেন এমনটি নয়। গত আট বছর ধরে বিআরটিসিতে চাকরির সুবাদে প্রত্যেক নারী যাত্রী তার কাছে সন্তানতুল্য। আর সে যেন মস্ত বড় অভিভাবক। প্রতি পদে পদে সাহসিকতা ও দায়িত্বের পরিচয় দিয়েছেন সুমি। কয়েক মাস আগে কাওরানবাজার সিগনালে এক বয়স্ক নারী যাত্রীকে নামাতে গেলে পেছন থেকে তাকে একটি পুরুষ বাইকার ধাক্কা দেয়। এসময় সুমি তার যাত্রীকে রক্ষা করতে গাড়িতে থাকা অবস্থায়ই মটরসাইকেলটিকে লাথি মেরে ফেলে দেন। সাহসী সুমি একদিকে যেমন কঠোরভাবে দায়িত্বশীল। তেমনি স্নেহময়ীও। কোনো পুরুষ যাত্রী যদি ভুল করে তার বাসে উঠে যায় তখন সুমি উত্তেজিত না হয়ে বরং অনেক সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেন বাবা এটা শুধুমাত্র মহিলা যাত্রীদের জন্য। গত কয়েক বছর আগে বনানীতে এক সিএনজি চালক ও তার যাত্রীকে ছিনতাইকারীদের হাত থেকে রক্ষা করে বাহবা কুড়াতে ভোলেননি সুমি। ২০১৪ সালে বিয়ের পরপরই এফডিসির ক্যামেরা সহযোগী জাভেদের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তিন বছর বয়সী এক ছেলেই এখন তার একমাত্র ভরসা। সুমির ইচ্ছা ভবিষ্যতে সে বিআরটিসির বাস ড্রাইভার হবে। ইতিমধ্যে সুমি প্রাইভেট কার চালানো শিখে গেছেন। এখন বিআরটিসি ডাবলডেকার বাসটির স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখার অপেক্ষা। সুমি বলেন, একজন নারী হিসেবে কোনো কাজকেই আমি ছোট করে দেখি না। আমি কাজের মাঝে অনেক আনন্দ খুঁজে পাই। সকাল-বিকাল দুই টাইম ডিউটি- বাকিটা সময় বাসায়। তাছাড়া বাসে যতক্ষণ থাকি ততক্ষণ মন খারাপ হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। বাসে সকল যাত্রীই যেন আমার আত্মীয়। আমার আপনজন। এমনকি বাসের ভাড়া নিয়েও বাড়াবাড়ির ধারেকাছে নেই সুমি।
রাজধানীতে সব ধরনের কর্মসংস্থানে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। এর ফলে পরিবহনের ভেতরেও নারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিষয়ে বিআরটিসির ডিজিএম অপারেশন মি. আলমাস বলেন, ঢাকা সিটিতে বর্তমানে ১৫টি রুটে মোট ১৮টি বিআরটিসির মহিলা বাস সার্ভিস চালু আছে। এগুলো মিরপুর-১২ থেকে মতিঝিল, শাহবাগ থেকে আব্দুল্লাহপুর, আব্দুল্লাহপুর থেকে মতিঝিল, খিলক্ষেত থেকে গুলিস্তান। নতুনবাজার, মধ্যবাড্ডা থেকে মতিঝিল, বনশ্রী থেকে মতিঝিল, নারায়ণগঞ্জ থেকে মতিঝিল, মিরপুর-১০ থেকে মতিঝিল, মিরপুর-১৪ থেকে মতিঝিল। মিরপুর-১ থেকে শাহবাগ ভায়া টেকনিক্যাল, মিরপুর-১ থেকে শাহবাগ ভায়া বাংলামোটর, সাভার টু মতিঝিল, শিববাড়ী টু মতিঝিল, শ্যামলী সূচনা কমিউনিটি সেন্টার টু মতিঝিল, মোহাম্মাদপুর টু মতিঝিল ভায়া ঝিগাতলা বাসস্ট্যান্ড। এগুলো খিলক্ষেত, মতিঝিল, কল্যাণপুর, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর ডিপো থেকে সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে ছেড়ে যায় এবং বিকাল ৫-৬টার সময় চলে আসে। এগুলো সবই টু টাইম সার্ভিস অর্থাৎ সকাল ও সন্ধ্যা। এসব বাসের অধিকাংশ যাত্রীই ব্যাংক কর্মকর্তা ও বেসরকারি চাকরিজীবী।
এতগুলো বাস চালু থাকা সত্ত্বেও গত দুই মাস আগে দোলনাচাপা নামে মহিলাদের জন্য নতুন একটি বাস সার্ভিস চালু হয়। যদিও এসব বাসের খবর জানেন না অধিকাংশ নারী। বিকাল ৪টা। ফার্মগেট মোড়ে শত শত যাত্রীর সঙ্গে পরিবহনের অপেক্ষায় কর্মজীবী নারী সানজিদা। গন্তব্য উত্তরা এয়ারপোর্ট টু আব্দুল্লাহপুর। নাকের ডগার সামনে দিয়ে একের পর এক বাস যাচ্ছে। কিন্তু সানজিদা বারবার চেষ্টা করেও উঠতে ব্যর্থ। আধ ঘণ্টার চেষ্টায় ৩ নাম্বার একটি বাসে উঠতে সমর্থ হলেও ততক্ষণে হজম করতে হয়েছে পরিবহন কর্মচারীদের নানা হয়রানিমূলক আচরণ। প্রায় দুই কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস রাজধানী ঢাকায়। ঘন বসতিপূর্ণ এই নগরীতে নানা দুর্ভোগ নিয়ে বসবাস মানুষের। তার মধ্যে প্রতিদিনের একটি দুর্ভোগ পরিবহন সংকট। এর সঙ্গে যানজট ঠেলে রাজধানীর জীবনযাপন দুঃস্বপ্ন হিসেবে ধরা দিয়েছে নগরবাসীর কাছে। দুর্ভোগের এই শহরে পরিবহনে পুরুষেরা বাদুড় ঝোলা হয়ে চলাচল করলেও ভোগান্তির শেষ নেই নারীদের। রাজধানীর বিভিন্ন রুটে বিআরটিসি মহিলা বাস সার্ভিস চালু থাকলেও পর্যাপ্ত না হওয়ায় গণপরিবহনে নানাভাবে নিগ্রহের শিকার হয় কর্মজীবী নারীরা। মহিলা বাস সার্ভিস শুধু সকাল-বিকাল দুই সময় নারীদের নিয়ে যাতায়াত করে। বাকি সময় নারীদেরও গণপরিবহনে ভোগান্তির যাতায়াত করতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, পুরুষ যাত্রী তোলাসহ পুলিশি হয়রানির। মোহাম্মদপুর ডিপোর মহিলা বাস সার্ভিসের বাসচালক আসলাম শেখ বলেন, গত তিন বছর ধরে মহিলা বাস সার্ভিসে কাজ করছি। এটা সম্পূর্ণ ঝামেলামুক্ত একটি সার্ভিস। নারী যাত্রীরা সবাই অনেক আন্তরিক। আমার বাসে কোনো হেল্পার নেই। বাসের ৪-৫ জন নিয়মিত যাত্রী মিলেমিসে বাসের সবার ভাড়া কাটার কাজটি করে থাকেন। তবে বিড়ম্বনার বিষয় হচ্ছে প্রায় সময়ই পুলিশ বাস থামতে দেয় না। মহিলাদের বাস থেকে নামতে ৩০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট পর্যন্ত সময় লাগে। এই সময়টায় প্রায়ই পুলিশ ঝামেলা করে মামলা দিয়ে দেয়। ফলে অধিকাংশ নারীকে অনেক ঝুঁকি নিয়ে বাস থেকে নামতে হয়। যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা।
মিরপুর-১০ থেকে প্রতিদিন সকাল ৮টায় মহিলা বাসে করে কর্মস্থলে যান মতিঝিল জনতা ব্যাংকে কর্মরত সুলতানা রহমান। মহিলা বাসে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, মহিলা বাস আমার কাছে স্বস্তির নাম। প্রতিদিন ভিড় ঠেলে নারীদের জন্য গণপরিবহনে যাতায়াত করা কঠিন। মতিঝিল থেকে সন্ধ্যায় মহিলা বাস ফিরতি ট্রিপ ছাড়ে। অফিস থেকে বের হতে একটু দেরি হলেই বাস মিস। তখন আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর যুদ্ধ করে পাবলিক বাসে ওঠা। এজন্য আরও কিছু মহিলা বাস চালু করলে নারীদের জন্য সুবিধা হয়।

No comments

Powered by Blogger.