কাজান যেন শোকের বাড়ি by সামন হোসেন কাজান

আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসছে বিশ্বকাপের পরিধি। ৩২ দলের টুর্নামেন্টে দিন শেষে পরিণত হয়ে যাচ্ছে চার দলের। ১২ ভেন্যু থেকে কমে দাঁড়িয়েছে দুটিতে-সেন্ট  পিটার্সবার্গ ও মস্কোর লুঝনিকি। এই দুটি স্টেডিয়ামে দুটি সেমিফাইনাল, ফাইনাল ও স্থান নির্ধারণী ম্যাচ হবে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্ত হাতে থাকা লাতিন আমেরিকার পতাকাটাও অভিশপ্ত কাজানে নেমে গেছে। নামিয়ে দিয়েছে ইউরোপের দল বেলজিয়াম। দুই আসর পর আবার লাতিন ছাড়া বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। ২০০৬ সালে জার্মানি বিশ্বকাপে লাতিন আমেরিকার কোনো দল উঠতে পারেনি সেমিফাইনালে। ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি ও পর্তুগালের মধ্যে হয়েছিল সেমির লড়াই। শেষ পর্যন্ত ইতালির ঘরে যায় ট্রফি, রানার্সআপ ফ্রান্স। বিশ্বকাপের ৮৮ বছরের ইতিহাসে লাতিন আমেরিকার কোনো দেশ ছাড়া সেমিফাইনাল হতে যাচ্ছে পঞ্চমবারের মতো। প্রতিবারই আয়োজক ছিল ইউরোপের দেশ। পঞ্চমবারের মতো ইউরোপের ধাক্কায়ই শেষ চারের আগে বিশ্বকাপ শেষ হলো পেলে, ম্যারাডোনাদের অঞ্চলের দেশগুলোর।
লাতিনদের অন্যতম শক্তি ব্রাজিল বিশ্বকাপ শুরু করেছিল শিরোপা জয়ের স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্ন ভেঙে গেল শেষ আটে এসেই। এমনটা হওয়ার কি কথা ছিল? হয়তো রাশিয়াতেই নেইমাররা তাদের হেক্সা জয়ের স্বপ্ন ছুঁতে পারতেন। সেটা পারলেন না। প্রিয় দলকে, প্রিয় খেলোয়াড়কে সমর্থন দিতে গ্যালারিতে গলা ফাটিয়েছেন হাজারো দর্শক। তিতের শিষ্যরা তাদের হতাশই করলেন। প্রিয় দলের হার মেনে নিতে পারেননি অনেকেই। দর্শকদের কেউ ডুকরে কেঁদেছেন, কেউ বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। অনেকের কাছে ফাইনাল সেমিফাইনালের টিকিট থাকার পরও গতকালই রাশিয়া ছেড়েছেন। কাজানকে অভিশপ্ত ভেন্যু আখ্যা দিয়ে রবার্তো নামে এক ব্রাজিলিয়ান সমর্থক বলেন, কাজানে আসতে আমার অনেক ঝুঁক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। প্রথমে বিমানের টিকিট পাননি। ট্রেনের টিকিটও জোটেনি। আসতে হয়েছে ট্যাক্সি ভাড়া করে। তখনই আমার মনে সন্দেহ জেগেছিল, না জানি কী হয়। ম্যাচ শেষে এই দর্শক বলেন, দল ভালো খেলেছে। কিন্তু বড় দলগুলোর কাছে ‘অপয়া’ ভেন্যু হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া কাজান স্টেডিয়াম বলেই হয়তো বিধাতা আমাদের ভাগ্যে হার লিখেছেন। হয়েছেও তাই, কাজানে এরিনা স্টেডিয়ামেই একের পর এক জায়ান্টরা হোঁচট খেয়েছে। প্রথমে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানি, এরপর বিশ্বকাপে সবচেয়ে দর্শক নন্দিত এবং বিশ্ব সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা এবং সর্বশেষ নেইমারের ব্রাজিলকে বিদায় করলো এই কাজান এরেনা।
রাশিয়া বিশ্বকাপ ‘অঘটনে’র শুরু থেকেই। বড় দলগুলো যেভাবে একের পর এক হোঁচট খেতে শুরু করেছিল, তাতে এই বিশ্বকাপের ভাগ্যে কী লেখা, সেটা কেউ বলতে পারছিল না। গ্রুপ পর্বের শেষ দিকে এসে কোনো না কোনোভাবে ফেভারিটরা উঠে আসছিল। যে কারণে, প্রথম ম্যাচ হারলেও ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানির আশা ছিল দক্ষিণ কোরিয়াকে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠবে তারা। কিন্তু কাজান এরেনায় সব উল্টে গেলো। জার্মানি গোল বের করা তো দূরে থাক, দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে উল্টো দুটো গোল খেয়ে গেল। ৮০ বছরের ঐতিহ্য ভেঙে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দলের কাছে হেরে বিদায় নিতে হলো জার্মানদের। দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম ম্যাচটিই কাজান এরেনায়। মুখোমুখি আর্জেন্টিনা এবং ফ্রান্স। দুটিই ফেবারিট দল। নিশ্চিতভাবেই একটি দলকে বিদায় নিতে হবে। দুটিকে তো আর বিদায় করা যায় না। যে কারণে সবচেয়ে ফেভারিট আর সমর্থকপুষ্ট দল আর্জেন্টিনাকে বেছে নিল কাজান। হারিয়ে দিলো ৪-৩ গোলের ব্যবধানে।
কাজান এরেনার আশপাশে প্রতিটি বাড়ির দেয়ালে ম্যুরাল বা প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছিল বিখ্যাত ফুটবলারদের। সেখানে সবচেয়ে বেশি শোভা পাচ্ছিল জার্মানি আর আর্জেন্টিনার ফুটবলারদের ছবি। ছিলেন ব্রাজিলের নেইমার ও পর্তুগালের রোনালদোও। রোনালদোর পর্তুগালে খেলা কাজানে না পারলেও, তারাও বিদায় নিয়েছে নকআউপ পর্ব থেকে। বিশ্বসেরা তারকাদের মধ্যে মেসি-রোনালদো ব্যর্থ। বাকি ছিলেন নেইমার। তিনি ব্রাজিলকে ফাইনাল পর্যন্ত নিয়ে যাবেন। জিতবেন শিরোপা। ব্রাজিলকে উপহার দেবেন হেক্সা। কিন্তু ভেন্যু কাজান বলেই নাকি মনে খটকা লেগেছিল ব্রাজিলের সমর্থকদের। কাজানের রেল টার্মিনালে এমন আলোচনাই করতে শোনা গেছে দুই ব্রাজেলিয়ান সমর্থককে। তা না হলে কেন এত এত সুযোগ পেয়ে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হবে ব্রাজিল। শুরুতেই বলবারে লেগে ফিরে আসা, পওলিনহো ফাঁকা পোস্ট পেয়েও শট করতে না পারা, কৌতিনহো, ফিরমিনো, হেসুসরা ফাঁকা পেয়েও সঠিকভাবে শট নিতে না পারা, এগুলো সবই দুর্ভাগ্যের ফসল। হয়তো বা অভিশপ্ত কাজান এরেনারও কোনো কারসাজি! শেষ পর্যন্ত জার্মানি, আর্জেন্টিনার মতো ট্র্যাজেডির শিকার হয়েই হেক্সা মিশনের সমাপ্তি টেনে দিতে হলো তিতের ব্রাজিলকে। নেইমারকেও পথ ধরতে হলো মেসি-মুলার-আগুয়েরোদের মত। অভিশপ্ত কাজান এরেনায় এবারের বিশ্বকাপের আর কোনো ম্যাচ নেই। না হয়, এরপর কোনো জায়ান্টকে বধ করতো, সেটাই ছিল দেখার।
মস্কো থেকে ৮২৫ কিলোমিটার দূরত্বের কাজান স্টেডিয়ামে ব্রাজিল বেলজিয়ামের কোয়ার্টার ফাইনালসহ মোট ছয়টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.