খালেদার নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্তের এখতিয়ার ইসিরই

বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ সম্পর্কে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা যা বলেছেন তা রীতিমতো বিস্ময়কর। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ইইউ প্রতিনিধি দল বুধবার বিকালে নির্বাচন ভবনে আয়োজিত এক বৈঠকে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না সিইসি’র কাছে জানতে চান। জবাবে সিইসি তাদের বলেন, এটি আদালতের বিষয়। আদালত যদি অ্যালাও করেন, তাহলে ইসির কিছু করার নেই। আর যদি অ্যালাও না-ও করেন, তাহলেও ইসির কোনো ভূমিকা থাকবে না।
আইনবিদরা বলছেন, সিইসি নূরুল হুদার এ বক্তব্য আইন সমর্থন করে না।
কারণ, খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন কি পারবেন না সে সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের। কারণ, কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করতে চাইলে তিনি রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র দাখিল করবেন। রিটার্নিং কর্মকর্তাই ঠিক করবেন ওই মনোনয়নপত্র বৈধ না অবৈধ। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তে কেউ ক্ষুব্ধ হলে তিনি নির্বাচন কমিশনে আপিল করবেন। নির্বাচন কমিশন আপিল নিষ্পত্তির পরই কেবল উচ্চ আদালতের প্রশ্ন আসবে। বিশিষ্ট আইনবিদ ড. শাহদীন মালিক এ প্রসঙ্গে বলেন, কে নির্বাচন করতে পারবে আর কে পারবে না- আইন অনুযায়ী এটা নির্ধারণের এখতিয়ার এবং দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। তিনি বলেন, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং আবদুর রহমান বদি দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তাদের সাজার ওপর এখন কোনো ধরনের স্থগিতাদেশ নেই। তাদের দায়ের করা আপিল উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন তাদের সংসদ সদস্য পদ বাতিল করেনি। এতে প্রতীয়মান হয় যে, দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি আপিল বিচারাধীন অবস্থায় নির্বাচন করবে পারবেন- এটাই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মনোভাব।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া এখন যে অবস্থায় আছেন তাতে হয়তো ইসির কিছু করণীয় নেই, কিন্তু খালেদা জিয়া যদি নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন তখন ইসির করণীয় থাকবে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া যদি মনোনয়নপত্র দাখিল করেন তাহলে ইসিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সেই মনোনয়নপত্র বৈধ কি না। এ বিষয়ে প্রথমে সিদ্ধান্ত নেবেন রিটার্নিং অফিসার। রিটার্নিং অফিসার যদি খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করেন, তাহলে খালেদা জিয়া ইসিতে আপিল করতে পারবেন। তখন ইসিও যদি তার মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করে তাহলে খালেদা জিয়া আদালতে যেতে পারেন। আর এই প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত খালেদা জিয়া মনোনয়নের বিষয়ে আদালতে যেতে পারবেন না।
সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ইসির এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যদি আদালতের মাধ্যমে দণ্ডপ্রাপ্তের দণ্ড স্থগিত হয়ে যায়, তাহলে ইসি কারো মনোনয়নপত্র বাতিল করতে পারবে না।
দুদকের মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডের পর থেকেই তিনি নির্বাচন করতে পারবেন কি না সে প্রশ্ন জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে। রায়ের দিনই আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন এবং আদালতই সিদ্ধান্ত দেবে খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন কি না? পর্যবেক্ষকরা বলছেন, তাত্ত্বিক দিক থেকে আইনমন্ত্রীর কথাই সঠিক। কারণ, নির্বাচন কমিশন কোনো সিদ্ধান্ত দিলে কেবল উচ্চ আদালতই তা রিভিউ করতে পারবে।
কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন গঠনের এক বছর পার হলো। এ সময়ের মধ্যে বড় কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি এ কমিশনকে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচন হতে পারতো একটি বড় পরীক্ষা। কিন্তু আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে ওই নির্বাচন হয়নি। এ নির্বাচন নিয়ে সরকারের অনিহার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিল। তবে পর্যবেক্ষকরা এ ব্যাপারে একমত যে, আগামী সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে হুদা কমিশনের জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। এ নির্বাচন নিয়ে কেএম নূরুল হুদার অবস্থান এখনও পুরো খোলাসা হয়নি। প্রধান দুই জোটের মধ্যে বিরোধপূর্ণ বিষয়ে মীমাংসার ইচ্ছা নেই বলে তার মনোভাব একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে। তবে তিনি এটা খোলাসা করেই বলেছেন যে, বিএনপি অংশ না নিলে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে পদক্ষেপ নেয়া। সব রাজনৈতিক দলই যেন তাদের ওপর আস্থা স্থাপন করে, সে ব্যাপারে কাজ করা। বাংলাদেশের ইতিহাস প্রধানত দুই ধরনের ভোট দেখেছে। যদিও কোনো নির্বাচনই একেবারে অভিযোগের বাইরে থাকেনি। কিন্তু মোটাদাগে কোনো কোনো নির্বাচন ছিল অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু। আবার কোনো কোনো নির্বাচন ছিল গায়েবি। জনগণের ভোটের কোনো প্রয়োজন হয়নি। ব্যালট পেপার খোলার আগেই বিজয়ী দলের নাম আমরা জেনে গেছি। হুদা কমিশনের নসিবে কেমন নির্বাচন আছে, তা চলতি বছরই জানা যাবে।

No comments

Powered by Blogger.