ধূমপানে স্থান-কাল নেই!

শারমিন সুলতানা ফুটপাতে নাক চেপে হাঁটছেন। তাঁর সামনের পথচারী হাঁটতে হাঁটতে ধূমপান করছেন। পেছনের পথচারীদের মুখে সে ধোঁয়ার ঝাপটা লাগছে। খারাপ লাগলেও কেউ কিছু বলছেন না। শারমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফুটপাতে হাঁটার সময় বা রাস্তায় বাসের জন্য দাঁড়ালে অনেক সময় সিগারেটের ধোঁয়া খেতে হয়! ক্ষতি হলেও করার কিছু থাকে না।’ সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে উন্মুক্ত স্থানে ধূমপানের আধিক্য চোখে পড়েছে। ফুটপাতে, পার্কে, মার্কেটের সামনে—যেখানে জনসমাগম সেখানেই দেখা গেছে কেউ না কেউ ধূমপান করছে। অনেক সময় ফুটপাতে হাঁটার সময় ধূমপায়ীর হাতে থাকা সিগারেটের আগুন অন্য পথচারীদের হাতে, গায়ে লাগছে। চোখ শক্ত করে একবার তাকানো ছাড়া আর কিছু করার থাকে না বলে জানালেন একাধিক ভুক্তভোগী। আইন অনুযায়ী, জনপরিসরে বা উন্মুক্ত স্থানে ধূমপান নিষিদ্ধ। কেউ এমন স্থানে ধূমপান করলে অনধিক ৩০০ টাকা জরিমানা করার বিধান আছে। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে তিনি দ্বিগুণ হারে দণ্ডিত হবেন। আইনে সিগারেটের দোকান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ২০ গজ দূরে থাকতে হবে বলে বলা হয়েছে। সম্প্রতি এই আইন না মানার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫–এর ২(চ) ধারা অনুসারে পাবলিক প্লেস বলতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস; গ্রন্থাগার, লিফট, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, আদালত, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, নৌবন্দর, রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনাল, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণিবিতান, রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেট, শিশুপার্ক, মেলা বা পাবলিক পরিবহনে আরোহণের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সারি, জনসাধারণের সম্মিলিত ব্যবহারের স্থান বোঝায়। অন্তত ১০ জন পথচারী নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা ধূমপান নিয়ন্ত্রণে আইন আছে শুনেছেন, কিন্তু প্রয়োগ হতে দেখেননি। তাঁরা বলেন, ধূমপায়ীরা স্থান-কাল মানেন না। অনেক সময় হাতে সিগারেট লেগে পুড়ে যায়। শহরের যেখানে–সেখানে লোকসমাগমের জায়গায় সিগারেটের দোকান, ভ্রাম্যমাণ দোকানে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য পাওয়া যায়। তাঁরা মনে করেন, মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়ে গেছে বলে ধূমপানের হার বাড়ছে। ধূমপায়ীরা যে ধোঁয়া ছাড়েন, তা নিশ্বাসের সঙ্গে অন্যের শরীরে ঢুকে পড়ে। এটা পরোক্ষ ধূমপান। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত নিকোটিন অ্যান্ড টোব্যাকো রিসার্চ সাময়িকীতে ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার: ঢাকা, বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়েছে, ৮৭ শতাংশ শিশু বলেছে, তারা সম্প্রতি জনপরিসরে (পাবলিক প্লেস) তথা দোকানে, রাস্তায় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়েছে। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ৪০ শতাংশ শিশু পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, যিনি বা যাঁরা পেশাদার ধূমপায়ীদের সঙ্গে বসবাস করেন, তাঁদের হৃদ্‌রোগ এবং ফুসফুস ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা অন্যদের তুলনায় অন্তত ৩০ গুণ বেড়ে যায়। চিকিৎসকেরা বলেন, পরোক্ষ ধূমপান শিশুদের শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানির অন্যতম প্রধান কারণ। এ বিপদ থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য ব্যাপক জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। তবে ধূমপান করার ফলে অধূমপায়ী ব্যক্তির অসুবিধা হলেও ভুক্তভোগীর এ নিয়ে অভিযোগ জানানোর সুযোগ নেই। অবশ্য মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয় বলে জানিয়েছেন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী মো. রুহুল কুদ্দুস। তামাকবিরোধী সংগঠন প্রত্যাশার সাধারণ সম্পাদক হেলাল আহমেদ বলেন, ‘যাত্রীছাউনিসহ সব জায়গাই পাবলিক প্লেস। এ নিয়ে আমরা কিছু বলি না। মনে করি, এটা কোনো সমস্যা না। অথবা বললে ওই ব্যক্তি কী মনে করেন বা বলতে গিয়ে কী বিপদে পড়ি—এসব সাতপাঁচ ভেবে চুপ করে থাকি।’ হেলাল আহমেদ বলেন, একজন পুলিশকে অভিযোগ জানাতে পারবেন। কিন্তু দেখা যায়, পুলিশ নিজেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধূমপান করছে। আইন বাস্তবায়ন করতে গেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতকেও অনেক বাধাবিপত্তি পেরোতে হয়। সরকারের যুগ্ম সচিব ও জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী মো. রুহুল কুদ্দুস প্রথম আলোকে বলেন, ধূমপান নিয়ন্ত্রণে ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়।
তবে বর্তমানের আইনে এমন কোনো বিধান নেই, যার আওতায় কোনো ব্যক্তি অভিযোগ জানাতে পারেন বা জরিমানা চাইতে পারেন। রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আইন আরও কঠোর করতে তামাক ও জর্দাজাতীয় দ্রব্য বিক্রির বিষয়টি লাইসেন্সের আওতায় আনা যেতে পারে। তাতে যেখানে–সেখানে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি কমতে পারে। এখন আইনের যেসব দুর্বলতা আছে, সেগুলো সংশোধন করে আরও কঠোর করার ব্যবস্থা করা হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার সৈয়দ মাহফুজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী ‘পাবলিক প্লেস’–এর সংজ্ঞা নিয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে। আইন অনুযায়ী, প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ নয়। একজন ব্যক্তি খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে ধূমপান করতে পারেন। সুতরাং যখন খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে কেউ ধূমপান করেন এবং তা কারও ক্ষতি না করে, তা আইন অনুযায়ী অপরাধ বলা যাবে না। তবে যদি দেখা যায় ফুটপাতে লোকজন আছে, সেখানে একজন ধূমপান করলে তিনি আইন অনুযায়ী অন্যের ক্ষতি করছেন। মাহফুজুল হক বলেন, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মাঝামাঝি অবস্থায় আছে বলা যায়। অর্থাৎ খুব ভালোও নয়, আবার খারাপও নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে আগের চেয়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ও পাবলিক প্লেসে ধূমপানের হার কমেছে। দু-একজন চালক বাসে ধূমপান করলেও বাসে ধূমপান তুলনামূলক কমেছে। বাংলাদেশের যে কেউ যেকোনো দোকানে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করতে পারে। ধূমপানের সামগ্রী বিক্রি করতে গেলে কোনো অনুমোদন লাগে না। এ জন্য আলাদা লাইসেন্স নিতে হবে আইনে এমন কোনো ধারা নেই। এটিও ধূমপান নিয়ন্ত্রণে পরোক্ষভাবে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তবে ইদানীং আলাপ হচ্ছে, আইনে এই ধারা সংযুক্ত করা হতে পারে। তখন হয়তো জনসমক্ষে ধূমপান কমে যাওয়া এবং তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি কিছুটা কমতে পারে বলে মনে করেন মাহফুজুল হক।

No comments

Powered by Blogger.