৩৫ লাখ টাকার মোবাইল by রোকনুজ্জামান পিয়াস

চারপাশ স্বর্ণে মোড়ানো। স্ক্রিনটি নীলকান্তমণির। কিপ্যাডে রয়েছে ৪ দশমিক ৭৫ ক্যারটের রুবি পাথর। পুরো কাঠামো উত্তর ইউরোপের বিশেষ হার্ডকাট চামড়া ও প্ল্যাটিনাম ধাতুর মিশেল। এটি একটি মোবাইল ফোন সেট। দাম প্রায় ৩৫ লাখ টাকা।
এতো দামি উপাদানে তৈরি যেই মোবাইল ফোন সেট, তাতে নেই কোনো ক্যামেরা। মাইক্রো এসডি মেমোরি কার্ড ব্যবহার করে বাড়ানো যায় না ইন্টারনাল স্টোরেজ। নকিয়া ব্র্যান্ডের ‘ভারটু’ নামের এই মোবাইল ফোন সেটটির দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ১২ ইঞ্চি, প্রস্থ ১ দশমিক ৬৫ ইঞ্চি এবং পুরু শূন্য দশমিক ৫১ ইঞ্চি। বিলাসবহুল এই মোবাইল ফোনের বিক্রেতা কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান নয়। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীই এর বিক্রেতা। আনা হয়েছে দেশের গ্রাহকের জন্যই। এ মোবাইল ফোন সেটকে ঘিরে চলছে তদন্ত। তদন্ত চালাচ্ছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। গোয়েন্দারা বলছেন, মোবাইলটির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান গুলশান মার্কেটের ‘ফোন এক্সচেঞ্জ’। প্রতিষ্ঠানটি এ ধরনের একাধিক বিলাসবহুল মোবাইল ফোন সেট বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। মোটা অঙ্কের শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাইপথে আনা এসব মোবাইল নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করছেন তারা। আগামী বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটির মালিক সারোয়ার হায়দারকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে তলব করা হয়েছে। এর আগে গত সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে অভিযান চালিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বিলাসবহুল নকিয়া ব্র্যান্ডের এই ‘ভারটু’সহ প্রায় ২০০ মোবাইল ফোন সেট জব্দ করে। ওই অভিযানে অবৈধভাবে আনা একটি ড্রোনও আটক করা হয়।
শুল্ক ও গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, গত সোমবার শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর একযোগে গুলশান, বসুন্ধরা সিটি মার্কেট ও ধানমন্ডি এলাকায় অবৈধভাবে আমদানিকৃত মোবাইল ফোন সেট আটকে বিশেষ অভিযান চালায়। অভিযানে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ছাড়াও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ফোর্স এবং বিটিআরসি কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বসুন্ধরা মার্কেটের ৯টি দোকান, গুলশান এভিনিউর ১টি ও ধানমন্ডির অরচার্ড পয়েন্টে ১টি সহ মোট ১১টি দোকানে এই অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানে চোরাইপথে আনা আইফোন-১০ সহ অন্যান্য বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের প্রায় ২ শতাধিক মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। জব্দকৃত এসব ব্র্যান্ডের মধ্যে ছিল আইফোন, স্যামসাং গ্যালাক্সি এস৮, নকিয়া এক্স ৩, ব্ল্যাকবেরি। আটককৃত মোবাইল সেটগুলোর মধ্যে আইফোন ১০-১৫টি, অন্যান্য মডেলের আইফোন ১১৮টি, অ্যাপল আইপ্যাড ৮টি, স্যামসাং ৫৮টি, নকিয়া ২টি, ব্ল্যাকবেরি ২টি এবং নকিয়া ‘ভারটু’ ব্র্যান্ড। যার মোট বাজারমূল্য ১ কোটি টাকারও অধিক। অভিযানকালে গুলশান মার্কেটের ‘ফোন এক্সচেঞ্জ’ প্রতিষ্ঠানের শোরুম থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক চোরাই মোবাইল ফোনসেট উদ্ধার করা হয়। গুলশান ও বসুন্ধরা মার্কেটের ফোন এক্সেচেঞ্জের দু’টো শোরুম থেকে মোট ৮৮টি দামি সেট উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ‘ফোন এক্সচেঞ্জ’-এর গুলশানের শোরুম থেকে একটি ড্রোনও জব্দ করা হয়। ডিজেআই ব্র্যান্ডের আমদানি নিষিদ্ধ এই ড্রোনটির মডেল জিএল২০০এ।
তবে আটক এসব মোবাইল পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে আলোড়ন তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটির একই শোরুম থেকে জব্দ করা ‘ভারটু’ ব্র্যান্ডের এক্সক্লুসিভ মোবাইল ফোনসেটটি। কৌতূহল সৃষ্টি করা এই মোবাইল সেটটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায়, নকিয়ার তৈরি ২৩৮ গ্রাম ওজনের সেটটির পার্শ্বদেহ ১৮ ক্যারেটের স্বর্ণ দিয়ে মোড়ানো। এর স্ক্রিনটি সলিড স্যাফায়ার বা নীলকান্তমণি ক্রিস্টালের তৈরি। দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান ধাতু ডায়মন্ডের পরেই অবস্থান এই স্যাফায়ার ক্রিস্টাল বা নীলকান্তমণির। ফলে এতে কোনো দাগ পড়ে না। এর কিপ্যাডে রয়েছে ৪ দশমিক ৭৫ ক্যারেটের রুবি পাথর। পুরো ফোনটি উত্তর ইউরোপের বিশেষ হার্ডকাট চামড়া ও প্লাটিনাম ধাতুর মিশেলে তৈরি। বিশেষ শ্রেণির ক্রেতাদের ফরমায়েশের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া এই ফোনসেটটি ইংল্যান্ডের সুদক্ষ হস্তশিল্প কারিগর দ্বারা সম্পূর্ণভাবে হাতে তৈরি করা। সেটটির দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ১২ ইঞ্চি, প্রস্থ ১ দশমিক ৬৫ ইঞ্চি এবং শূন্য দশমিক ৫১ ইঞ্চি পুরু। ক্রেতারা চাইলে নিজেদের পছন্দমতো রঙ এবং সেলাইয়ের নকশার ফরমায়েশও করতে পারেন। এই মোবাইল ফোন সেট সম্পর্কে আরো জানা গেছে, একাডেমি অ্যাওয়ার্ড জয়ী সুরশিল্পী দারিও মারিয়ানেলি এই ফোনের জন্য আলাদাভাবে এক্সক্লুসিভ রিংটোন ও অ্যালার্ট টোন সুর করেছেন যা পরে বিখ্যাত লন্ডন সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার যন্ত্রশিল্পীদের দ্বারা রেকর্ড করা হয়। তবে আশ্চর্য্যের বিষয় হলো এতো মূল্যবান উপাদান যে সেটে রয়েছে, তাতে নেই কোনো ক্যামেরা এবং ইন্টারনাল স্টোরেজ বাড়ানোর জন্য কোনো মাইক্রো এসডি মেমোরি কার্ড ব্যবহার করার অপশন। শুল্ক গোয়েন্দারা বলছেন, সেটটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে জানা গেছে, এটির মূল্য ২৬ হাজার ইউরো। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩৫ লাখ।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আটককৃত এসব পণ্য ক্রয়ে কাগজপত্র দেখাতে না পারায় ধারণা করা হচ্ছে অবৈধপথে এবং শুল্ক না দিয়ে আনা হয়েছে। বিটিআরসি আইএমইআই পরীক্ষায় জানা গেছে, এগুলো নিবন্ধিত নয়। আর এই নিবন্ধন না থাকার কারণে নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। বিটিআরসি’র নিবন্ধন না থাকার কারণে এগুলো কোনো সরকারি সংস্থা আইনগতভাবে ট্র্যাক করতে পারে না। গোয়েন্দাদের ধারণা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি এড়িয়ে এই সেটগুলো ব্যবহার করে যেকোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হতে পারে। এদিকে বিলাসবহুল ‘ভারটু’ মোবাইল সেটের ব্যাপারে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করতে ‘ফোন এক্সচেঞ্জ’-এর মালিক সরোয়ার হায়দারকে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে তলব করা হয়েছে। সংস্থাটির মহাপরিচালক (ডিজি) ড. মইনুল খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বিপুল পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এসব পণ্য চোরাই পথে আমদানি করা হয়েছে। মোবাইল এক্সেসরিজের ওপর ২৬ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য। সে হিসেবে শুল্ক ফাঁকি হয়েছে প্রায় ৯ লাখ ১০ হাজার টাকার। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয়, এগুলো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তদন্তে নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মইনুল খান জানান, ইতিপূর্বেও প্রতিষ্ঠানটি এ ধরনের একাধিক উচ্চমূল্যের মোবাইল এক্সেসরিজ অবৈধপথে আমদানি করেছেন বলে তারা জানতে পেরেছেন।

No comments

Powered by Blogger.