কেন গুগলের রেকর্ড জরিমানা?

যেকোনো কিছু সার্চ বা অনুসন্ধান করতে মানুষ এখন গুগলে যায়। জনপ্রিয় এ সেবাটিকে অনৈতিক ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে গুগলের বিরুদ্ধে।
আজ মঙ্গলবার ইউরোপে গুগলের সার্চ ফলাফলের অপব্যবহার করার অভিযোগে রেকর্ড পরিমাণ জরিমানা করা হয়েছে গুগলকে। অনলাইন শপিং সেবার ক্ষেত্রে নিজেদের পণ্যকে আগে দেখিয়ে অনৈতিক সুবিধা আনার অভিযোগ করা হয়েছে গুগলের বিরুদ্ধে।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রতিযোগিতা বিষয়ক কমিশন গুগল কর্তৃপক্ষকে মোট ২৪২ কোটি ইউরো বা ২৭২ কোটি মার্কিন ডলার জরিমানা করেছেন। গুগলের বিরুদ্ধে তাদের সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে গুগলের অন্য পণ্য বিশেষ করে শপিং ব৵বসায় ট্রাফিক টেনে নেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে।
দ্য ইনডিপেন্ডেন্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্রুতবর্ধনশীল ও প্রচণ্ড প্রতিযোগিতামূলক অনলাইন শপিংয়ের দুনিয়ায় নিজেদের প্রভাবশালী অবস্থানের অপব্যবহার কারনে এই রেকর্ড পরিমান জরিমানার মুখোমুখি গুগল।
ইউরোপীয় কমিশন বলেছে, অসদাচরণ শোধরানোর জন্য গুগলের হাতে ৯০ দিন আছে। এর মধ্যে ঠিক না হলে গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেটের বিশ্বজুড়ে দৈনিক গড় আয়ের ৫ শতাংশ জরিমানা আকারে শোধ করতে হবে।
প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে এই জরিমানা হতে পারে দৈনিক প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ ডলার। প্রতিযোগিতাবিমুখ এই আচরণ গুগল কীভাবে সংশোধন করবে, রায়ে তা ঠিক করার ভার গুগলের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
গুগল এই রায়ের বিরুদ্ধে ‘আপিল করার কথা বিবেচনা করছে’ বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি। গুগল কর্তৃপক্ষ বলেছে, জরিমানার বিষয়টি তারা পর্যালোচনা করে আপিল করার কথা ভাবছে। এ ছাড়া অনলাইন শপিং ব্যবসাকে পরিচালনা করার বিষয়টির পক্ষে যুক্তি দিয়েছে গুগল। তারা বলছে, এটা ব্যবহারকারী ও বিজ্ঞাপনদাতাদের মধ্যে এমনভাবে সম্পর্ক তৈরি করে যা উভয়ের জন্যই দরকারি।
গুগলের জেনারেল কাউন্সেল কেন্ট ওয়াকার বলেন, আমরা এই রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই দ্বিমত পোষণ করছি। আপিল করার লক্ষে আমরা রায়ের পূর্ণ বিশ্লেষণ করব।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) অ্যান্টিট্রাস্ট কমিশনার মার্গারেট ভেস্টাজার বলেছেন, গুগলের বিরুদ্ধে জরিমানা করা হয়েছে। শপিং সেবাগুলোকে যেভাবে সার্চ ফলাফলে র‍্যাংকিং হিসেবে দেখায় সে বিবেচনায় এ জরিমানা করা হয়েছে। গুগলকে মোট ২৪২ কোটি ইউরো জরিমানা গুণতে হবে।
ভেস্টাজার বলেন, গুগল যেটা করেছে তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অ্যান্টিট্রাস্ট আইন অনুযায়ী অবৈধ। প্রতিষ্ঠানটি বাজারে অন্য প্রতিযোগীদের মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার এবং উদ্ভাবনের সুযোগ নষ্ট করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ইউরোপের ভোক্তাদের প্রতিযোগিতামূলক বাজারের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছে।
ইউরোপীয় কমিশন জরিমানার পরিমাণ সম্পর্কে বলেছে, গুগলের কার্যক্রমের স্থায়ীত্ব ও গুরুত্ব বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। গুগলকে তাদের একচেটিয়া চর্চা পরিবর্তন ও প্রতিদ্বন্দ্বী সেবগুলাকে নিজের সেবার মতোই গুরুত্ব দিয়ে প্রদর্শনের জন্য তিন মাসের সময় পাবে।
মূলত শপিং সেবাগুলোর মধ্যেকার তুলনা বিষয়টিকে কেন্দ্র করে গুগলকে এ জরিমানা করা হচ্ছে। এটি ফ্রুগল, গুগল প্রোডাক্ট সার্চ বা গুগল শপিং নামেও পরিচিত।
ভেস্টাজার বলেন, ‘গুগল মূলত তাদের বাজার আধিপত্যকে অনৈতিক ব্যবহার করেছে। নিজের সার্চ রেজাল্টে অন্যদের তুলনায় নিজের শপিং সেবাকে বেশি প্রচার করেছে। পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিচে নামিয়ে দিয়েছে। গুগলের এ আচরণ অনেকদূর পর্যন্ত গেছে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে এমনভাবে আচরণ করা হয়েছে যাতে তাদের বেড়ে ওঠার সুযোগ নেই।
গুগল ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে ১৩টি দেশে তাদের শপিং সেবা চালু করেছে সবখানেই এ আচরণ করেছে। ২০০৮ সালে জার্মানি ও যুক্তরাজ্য, ২০১৩ সালে অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নরওয়ে, পোল্যান্ড ও সুইডেনে এ আচরণ করে গুগল। গুগলের পরিকল্পনার প্রভাবে গুগলের তুলনামূলক শপিং সেবার ব্যববহারকারী বেড়েছে। গুগলের প্রতিদ্বন্দ্বীরা অভিযোগ করেছে গুগলের ট্রাফিক বাড়লেও তাদের ব্যবসা টেকাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
প্রতিদ্বন্দ্বীতার নীতিমালা বিষয়টির প্রধান মার্গারেট ভেস্টাজার বলেন, শপিং সেবাগুলোর তুলনার ক্ষেত্রে গুগলের পরিকল্পনা শুধু অন্যদের চেয়ে ভালো পণ্য তৈরি করে গ্রাহক আকৃষ্ট করার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং গুগল তাদের অনুসন্ধান আধিপত্য অপব্যবহার করে নিজেদের সেরা হিসেবে জাহির করেছে। গুগল যা করেছে তা অবৈধ।
বেশ কয়েক বছর ধরেই ইইউয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে গুগলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছে গুগলের প্রতিদ্বন্দ্বীরা। বর্তমানে আমাজন ও ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টেক্কা দিতে শপিংকে গুরুত্ব দিচ্ছে গুগল। এটি গুগলের আয় বাড়ানোর একটি অন্যতম জায়গা।
অ্যান্টিট্রাস্ট আইনে ইইউ অসাদাচরণ ঠেকানোর ক্ষেত্রে শুন্য সহনশীলতা দেখায়। তাই অ্যান্টিট্রাস্টের ক্ষেত্রে কোনো একক প্রতিষ্ঠানকে এবারই সবচেয়ে বড় জরিমানা করল অ্যান্টট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ। এর আগে ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চিপ নির্মাতা ইনটেলকে ১১০ কোটি মার্কিন ডলার জরিমানা করেছিল ইইউ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
লুইস সিলকিন নামের আইনি প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ অলিভার ফেয়ারহারস্ট বলেন, এ সিদ্ধান্ত গুগলের প্রতি সত্যিকারের আঘাত। এর আগে এই কমিশন যে জরিমানা করেছিল এটি তার দ্বিগুন। গুগল যেভাবে তাদের সেবা পরিচালনা করছে তা পুনরায় ভেবে দেখার সময় এসেছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তে গুগল আপিল করবে এবং পুরো আপিল প্রক্রিয়া শেষ করতে ২০২০ সাল পর্যন্ত গড়াবে।
গুগলের একচেটিয়া আচরণ নিয়ে ইউরোপীয় কমিশন গত সাত বছর ধরে তদন্ত করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছ থেকে এক ডজনের বেশি অভিযোগ পাওয়ার পর অনুসন্ধানে নামে ইইউ। তথ্যসূত্র: এনপিআর, ইনডিপেন্ডেন্ট, বিবিসি, রয়টার্স।

No comments

Powered by Blogger.