আল জাজিরার পাশে মানবজমিন

খুব সম্ভবত, ইতিহাসের এক নজিরবিহীন অধ্যায়ের সাক্ষী হচ্ছি আমরা। তার আগে একটু পেছনে তাকিয়ে দেখা যাক। চিন্তা আর বিবেকের স্বাধীনতার লড়াইয়ের ইতিহাস বহু পুরনো। সপ্তদশ শতকে ইংরেজ কবি জন মিল্টন বৃটিশ রাজার সঙ্গে এ নিয়ে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছিলেন। অ্যারিওজিটিকায় তার দৃপ্ত উচ্চারণ ছিল- ‘দাও আমায়, জ্ঞানের স্বাধীনতা দাও, কথা কইবার স্বাধীনতা দাও, মুক্তভাবে বিতর্ক করার স্বাধীনতা দাও। সবার উপরে আমাকে দাও মুক্তি।’
কিন্তু সেই মুক্তি যে কতদূর- মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি তা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। কাতার ইস্যুতে মুসলিম দুনিয়া এখন কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত। সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সৌদি আরবের পক্ষে। সৌদি জোটের অবরোধের কারণে কাতার এখন অনেকটাই কোণঠাসা। এ পরিস্থিতিতে দেশটির প্রতি ১৩ দফা দাবি জানিয়েছে সৌদি জোট। যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে- আল জাজিরা টিভি নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়ার শর্ত। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সংকটের সুরাহায় এমন দাবি আর উত্থাপিত হয়েছে কি-না কে জানে।
আল জাজিরার শুরুর ইতিহাস ছিল চমকপ্রদ। দুই দশক আগে কাতারের রাষ্ট্রীয় মালিকানায় যাত্রা শুরুর সময়ই এই চ্যানেল ঘোষণা করেছিলো, সম্পাদকীয় নীতির ক্ষেত্রে তারা থাকবে স্বাধীন। বহু ক্ষেত্রেই হয়তো তাদের ঘোষণা বাস্তবে সত্য হয়নি। তবে যাদের কোনো কণ্ঠ ছিল না এমন অনেকের পক্ষেই সোচ্চার হয়ে সংবাদ মাধ্যমের ইতিহাসে নিজের জায়গা নিশ্চিত করে আল জাজিরা। নিপীড়িত ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর পক্ষে দাঁড়িয়ে প্রশংসা কুড়ায় সাধারণ মানুষের। আল জাজিরাই প্রথম ফিলিস্তিনের ওপর নিপীড়নের লাইভ সম্প্রচার শুরু করে। তবে ওসামা বিন লাদেনের টেপ প্রচার করে সমালোচনার মুখেও পড়ে টিভি নেটওয়ার্কটি।
আল জাজিরার ওপর সৌদি জোটের রাগ অবশ্য বহু পুরনো। এখন জানা যাচ্ছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান মার্কিন সামরিক বাহিনীকে আল জাজিরা চ্যানেলের অফিসে বোমা মারার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণ চলার সময় ও ইরাক যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে মার্কিন কূটনীতিকদের কাছে এ আহ্বান জানান তিনি। উইকিলিকসের ফাঁস করা একটি মার্কিন কূটনীতিক তারবার্তায় এমন ইঙ্গিত মিলেছে। ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় আল জাজিরা রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত। এ আন্দোলনে সবচেয়ে বড় উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করেছে চ্যানেলটি। অনেক আরব শাসকই এ ব্যাপারে ভীত ছিলেন। মুসলিম ব্রাদার হুডের মতো সংগঠনের প্রতি আল জাজিরার এক ধরনের সমর্থন রয়েছে। যে সংগঠনটির ব্যাপারে আবার ভীতি রয়েছে পুরো আরব বিশ্বেই।
অবশ্য আল জাজিরা যখন চাপে রয়েছে তখন ‘মুক্তবিশ্ব’ প্রতিষ্ঠানটির পাশে দাঁড়িয়েছে। ৮০টির মতো সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও এ নিয়ে মুখ খুলেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের মত প্রকাশ ও বাকস্বাধীনতা বিষয়ক দূত ডেভিড কায়ি বলেছেন, কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটি বন্ধের শর্ত মিডিয়ার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ভয়াবহ হুমকি। ওয়াশিংটন পোস্টের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সৌদি নেতৃত্বাধীন আরব জগতে সংবাদমাধ্যমে যে একমুখী কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হতো, আল-জাজিরা সেই অচলায়তন ভেঙে নিয়ে ভিন্নধারায় খবর পরিবেশনের মধ্য দিয়ে জনপ্রিয় হতে থাকে। ইসলামী শরীয়াকে আলোচনায় নিয়ে আসে সংবাদমাধ্যমটি। যেটা আরব দুনিয়ার অন্যান্য মিডিয়ায় আগে কখনও আলোচিত হয়নি। আল জাজিরার পক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করেছে সংবাদমাধ্যমগুলোর জোট ডিজিটাল কনটেন্ট নেক্সট। বিবিসি, গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো শীর্ষ সংবাদমাধ্যম এ জোটের অন্তর্ভুক্ত। ডিজিটাল কনটেন্ট নেক্সটের এক বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকের স্বাধীনতাকে সমর্থন করি। সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরুদ্ধ করা এর পরিপন্থি। বৃটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক সম্পাদকীয় ভাষ্যে বলা হয়েছে, পুরনো ধারার একমুখী আরবীয় স্বরের বিপরীতে আল জাজিরা ভিন্ন স্বর নিয়ে হাজির হওয়া এক মিডিয়া। আর নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সম্পাদনা পরিষদের মতামতে বলা হয়েছে, আল জাজিরা বন্ধের পাঁয়তারা একটি জোরালো কণ্ঠস্বরকে দমন করার প্রচেষ্টা। এই পরিস্থিতিতে মানবজমিন তার সুস্পষ্ট সমর্থন ঘোষণা করছে আল জাজিরার প্রতি। আসুন আমরা আল জাজিরার পাশে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তুলি, মুক্ত দুনিয়া রুখে দাঁড়াও।
এটা খোলাসা করা প্রয়োজন, আল জাজিরার সম্পাদকীয় নীতির বহু কিছুই আমরা সমর্থন করি না। কিন্তু কোনো সংবাদমাধ্যমকে হত্যা করার নীতিও আমরা সমর্থন করি না। বরং আমরা স্মরণ করি ভলতেয়ারের উক্তি বলে পরিচিতি পাওয়া সেই বিখ্যাত উক্তিটি- ‘আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের অধিকার রক্ষায় আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত।’ সবার উপরে বলি, ‘সাংবাদিকতা পাপ নয়।’

No comments

Powered by Blogger.