নতুন কমিশন কতটা নতুন?

নির্ধারিত সময়ের আগেই অনুসন্ধান কমিটি নির্বাচন কমিশনের জন্য ১০টি নাম রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিয়েছে এবং রাষ্ট্রপতি তাঁদের মধ্য থেকে পাঁচজনকে নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এই প্রথমবারের মতো কমিশনার পদে একজন নারী নিয়োগ পেয়েছেন। এটাই অনুসন্ধান কমিটির একমাত্র কৃতিত্ব নয়। তারা আমাদের রাজনীতিতে যে বিদ্বেষ-বৈরিতা ও অসুস্থ বাদানুবাদ চলে আসছিল, তাকে আপাতত আলোচনার সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে পেরেছে। যদিও রাষ্ট্রপতির উদ্যোগেই এই আলোচনার সূচনা হয়। অনুসন্ধান কমিটি নির্বাচন কমিশনের ৫টি পদের বিপরীতে যে ১০ জন নাগরিকের নাম প্রস্তাব করেছে; তাঁরাই শ্রেষ্ঠ—সে কথা বলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কেউ কেউ নিক্তি মেপে তাঁদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নাগরিক খুঁজেও পেতে পারেন। তবে একটি আস্থাভাজন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ তথা সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন জরুরি, সেই বিষয়টি অনুসন্ধান কমিটি যে উপলব্ধি করেছিল, সে জন্য তারা ধন্যবাদ পেতে পারে। প্রথমে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কমিটি সম্পর্কে বিরাগভাজন থাকলেও পরে সীমিত আস্থা রাখার কথা বলেছে। অনুসন্ধান কমিটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নাম চাওয়ার পাশাপাশি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেছে। ব্যক্তিগতভাবেও অনেকের মতামত নিয়েছে। শুরু থেকে অনুসন্ধান কমিটি তাদের প্রতিটি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রমাণের চেষ্টা করলেও শেষ মুহূর্তে কিছুটা তড়িঘড়ি করেছে বলেই অনেকের ধারণা।
অনুসন্ধান কমিটি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত আলোচনা চালাতে পারত এবং রাষ্ট্রপতির কাছে নাম জমা দেওয়ার আগে গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে পারত। কিন্তু এ ব্যাপারে অনুসন্ধান কমিটির যুক্তি হলো, যত বিলম্ব হতো, বিতর্ক বাড়ত। আর যেহেতু রাষ্ট্রপতির কাছে নাম জমা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাদের প্রস্তাবিত এবং রাষ্ট্রপতির গৃহীত নাম প্রকাশ করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে আগেভাগে না জানানোর মধ্যে দোষের কিছু দেখছে না। তাদের আরেকটি যুক্তি হলো, আগেভাগে নাম প্রকাশ করা হলে শত তদবিরের দেশে কোনো না কোনো পক্ষ থেকে যে তদবির চালানো হতো না, তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। পক্ষে-বিপক্ষে দুই যুক্তিই আছে। অনুসন্ধান কমিটির পুরো প্রক্রিয়ায় সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মন্ত্রিপরিষদ সচিব গণমাধ্যমকে বলেছেন, কমিটি রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া তালিকা থেকেই ১০টি নাম বাছাই করেছে। সেটি ভালো হয়েছে না মন্দ হয়েছে, সেই বিচার না করেও এর পক্ষে যুক্তি হলো, যেহেতু রাজনৈতিক দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই আলোচনার উদ্যোগ এবং আইনের বিকল্প হিসেবে অনুসন্ধান কমিটি গঠন, সেহেতু দলগুলোর আস্থা অর্জন ছিল জরুরি। এমনকি যেসব রাজনৈতিক দল নাম দিয়েছে, তারাও নিজ নিজ জোটে কথাবার্তা বলে সমতা বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের তালিকা থেকে একজন ও বিএনপির তালিকা থেকে একজন করে কমিশনার নেওয়া হয়েছে। সিইসি পদে বড় দুই দলের কারও নাম না নেওয়াটা সার্চ কমিটির জন্য খুবই বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে। তারা যদি দুই প্রধান দলের দেওয়া দুটি নামই রাষ্ট্রপতির কাছে দাখিল করত এবং রাষ্ট্রপতি যেকোনো একটি গ্রহণ করতেন, তখন আরও বেশি বিতর্ক হতো।  অনুসন্ধান কমিটির কাজ নিয়ে আমরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারি। কঠিন সমালোচনাও তুলতে পারি। কিন্তু দেখার বিষয় তারা যা করেছে, এর বাইরে কী করত পারত? অনেকেই বলেছিলেন, অনুসন্ধান বা যে কমিটিই গঠন করা হোক না কেন, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শেই রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নেবেন এবং সরকার যাঁদের পছন্দ করে, তাঁরাই নিয়োগ পাবেন। তর্কের খাতিরে যদি তাঁদের যুক্তি সঠিক ধরে নিই এবং সার্চ কমিটির সদস্যদের প্রতি ন্যূনতম আস্থা থাকে, তাহলে মেনে নিতে হবে যে সার্চ কমিটি সরকারের সেই ইচ্ছেকে ১০টি নামের মধ্যে সীমিত করতে পেরেছে। বিএনপির দেওয়া তালিকা থেকে একজন কমিশনার নেওয়াও প্রমাণ করে না যে সবকিছু সরকারের ইচ্ছেমাফিক হয়েছে। অনেকেই সংবিধানের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নেই বলে সবক দিচ্ছেন। ক্ষমতা না থাকার পরও কিন্তু তিনি অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমেই নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন, সার্চ কমিটির পরামর্শ নিয়েই নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। অনুসন্ধান কমিটির দায়িত্ব ছিল নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য ১০টি নাম পাঠানো। সেই কাজ তারা করেছে। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ছিল নির্বাচন কমিশন গঠন করার। তিনিও তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন সরকারের যে দায়িত্ব সেই কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কর্তব্য আইনের সীমারেখা মেনে চলা।  সে ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। না করলে পাঁচজন ‘দেবদূত’  দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করলেও তারা একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারবে না।
একই নির্বাচন কমিশনের অধীনে কিন্তু নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হয়েছে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ওপর সব দায় না চাপিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে একবার আয়নায় নিজেদের মুখ দেখতে বলব। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে গত পাঁচ বছরে রকিব কমিশন যত অন্যায় ও অপকর্ম করেছে, তা অগ্রাহ্য করব। তাদের ভুল ও অন্যায় থেকে নতুন নির্বাচন কমিশনকে শিক্ষা নিতে হবে। একটি নির্বাচন কমিশন যতই সৎ ও শক্তিশালী হোক না কেন, রাজনৈতিক দল ও সরকার না চাইলে তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না। অতীতে পারেনি। ভবিষ্যতেও না। দুই অনুসন্ধান কমিটির গঠন প্রক্রিয়া এক হলেও দ্বিতীয়টি অনেকটা স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করেছে। তাদের প্রতিটি বৈঠক ও পদক্ষেপের কথা জনগণকে জানানো হয়েছে। জনগণের কাছ থেকেও তারা মতামত নিয়েছে। আগের মতো বিরোধী দল অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশে গঠিত নির্বাচন কমিশনকে সরাসরি নাকচ করেনি। আশা করি, তারা এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না, যাতে এই কমিশনের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার পথটিই রুদ্ধ হয়ে যায়। একইভাবে সরকারি দলকেও নিজের দায়িত্বের কথা ভুললে চলবে না। নির্বাচন কমিশন নিজে বিতর্কিত হয় না, তাকে বিতর্কিত করে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল। অতীতে একটি মাগুরা উপনির্বাচন যদি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অনিবার্য করে তুলতে পারে,
ভবিষ্যতে এক বা একাধিক মাগুরা করে পার পেয়ে যাওয়া সম্ভব না–ও হতে পারে। এবারে যাঁদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন হলো তাঁদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আগামী নির্বাচন। সেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে বলে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব জানিয়েছেন। কিন্তু অংশগ্রহণমূলক হলেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় না। আর ৫ জানুয়ারির কিংবা ১৫ ফেব্রুয়ারির মতো একতরফা নির্বাচন হলে তো নির্বাচন কমিশনেরই প্রয়োজন হবে না। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে হলে সরকার, প্রশাসন, সেই নৈতিক দল ও প্রার্থীদের নিজ নিজ সীমারেখার মধ্য থেকে কাজ করতে হবে, যেমনটি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হয়েছে। তার আগে উপজেলা পরিষদ কিংবা পৌরসভা নির্বাচনগুলোও অংশগ্রহণমূলক ছিল। কিন্তু শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু ছিল না। নির্বাচনের প্রধান নিয়ামক জনগণ, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল বা প্রার্থী নন। প্রশ্ন হলো সেই জনগণকে তার অধিকার প্রয়োগ করতে দেওয়া হবে কি না। দেওয়া হলে কী হয়, তা আমরা ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে দেখেছি। রাজনৈতিক নেতারা সভামঞ্চে জোরগলায় বলেও থাকেন, জনগণই ক্ষমতার মালিক। কিন্তু তাঁরা সেটি মানেন না। তাঁদের কথা ও কাজে প্রায়ই মিল পাওয়া যায়নি। বিরোধী দলে থাকতে যাঁরা নিরপেক্ষ ও স্বাধীন কমিশনের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত, ক্ষমতায় গেলে তাঁরাই সেই কমিশনকে ‘গৃহপালিত’ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। আইনকে নিজের স্বার্থে ও সুবিধায় ব্যবহার করেন।
৪৫ বছর ধরেই গণতন্ত্রের নামে এই অপসংস্কৃতি চলে আসছে। অনুসন্ধান কমিটির দেওয়া ১০টি নামের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি ৫টি নাম বাছাই করেছেন। তাঁদের মধ্যে দু-একজনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ও জানাশোনা সূত্রে বলতে পারি, অনুসন্ধান কমিটি তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছে। আর রাষ্ট্রপতিও এ তালিকার বাইরে যাননি। তাঁদের অতীত ভূমিকা নিয়ে কেউ কেউ ইতিমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন, তবে সেই বিতর্ক বাদ দিয়ে আমাদের কর্তব্য হবে, তাঁরা কী করেন, সেটি দেখা। এখনই চূড়ান্ত রায় না দেওয়া। রাজনৈতিক দলগুলো এক-দেড় মাস ধরে যেভাবে ধৈর্য ও বিচক্ষণতার প্রমাণ দিয়েছে, সমালোচনা করলেও মাত্রা ছাড়ায়নি; ভবিষ্যতেও সেই ধারা বজায় রাখবে আশা করি। তারা এত দিন রাষ্ট্রপতির ওপর যে আস্থা রেখেছে, এখন থেকে নির্বাচন কমিশনের ওপরও অনুরূপ আস্থা রাখবে আশা করি। আর নির্বাচন কমিশন যাতে সেই আস্থা ও বিশ্বাসের আমানত খেয়ানত করতে না পারে, সে বিষয়ে সবাইকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো সজাগ থাকতে হবে। বিদায়ী নির্বাচন কমিশন আলোচনাকে ভয় পেত বলেই তাদের ওপর রাজনৈতিক দল ও জনগণের আস্থা শূন্যে নেমে এসেছিল। নতুন নির্বাচন কমিশন আলোচনার দরজাটি বন্ধ করবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.