দর-কষাকষির ক্ষমতা বেড়েছে বাংলাদেশের

২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডিজ অব ডেভেলপিং সোসাইটিজ—সিএনএন, আইবিএন এবং দ্য হিন্দু’ যৌথভাবে একটি জরিপ পরিচালনা করে, যার প্রতিপাদ্য ছিল অন্যান্য দেশ সম্পর্কে ভারতের নাগরিকদের মনোভাব। এই জরিপের একটি প্রশ্ন ছিল ভারত কোন কোন দেশকে বিশ্বস্ত বন্ধু ভাবতে পারে? এর উত্তরে সর্বাধিক ৪৮ শতাংশ জানান, বাংলাদেশ। এর পরে ৪৬ শতাংশ পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রাশিয়া।
জরিপটি হয়েছে সারা ভারতের বিভিন্ন ভাষী মানুষের মধ্যে; তাই বাংলাদেশের প্রতি ভারতের বাংলা ভাষাভাষীরা পক্ষপাত করেছেন, এই ওজর তোলার সুযোগ নেই। এর বিপরীতে বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে ঠিক একই প্রশ্ন করলে কি সমসংখ্যক মানুষ ভারত সম্পর্কে অভিন্ন উত্তর দেবে? যদি না দেয়, তার কারণ খুঁজে বের করার দায়িত্ব ভারতের নীতিনির্ধারকদেরই। একটি দেশের মানুষ কখন অপর একটি দেশকে বিশ্বস্ত বন্ধু ভাবে? যখন মনে করে ওই দেশটি দ্বারা ক্ষতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই বরং দেশটির নীতিনির্ধারকেরা তাদেরও ভালো চান। ওই জরিপে ৫৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, ‘পাকিস্তানকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না।’ এই জরিপ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগটা খুব জরুরি। কূটনীতির ভাষায় বলে, ‘ট্রাক টু রিলেশন’। চীনের প্রেসিডেন্টের সফরের পর গত বছর ৩০ নভেম্বর ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর ঢাকায় এসেছিলেন এবং সেটি ছিল ভারতের কোনো প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রথম বাংলাদেশ সফর। সেই সফর নিয়ে কূটনৈতিক মহলে অনেক জল্পনাও আছে। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন, যিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়েরও মন্ত্রী।
তখন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যদিও সেই প্রস্তাবের বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। সে সময়ে ভারতীয় হাইকমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ‘প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষতা ও যোগ্যতা বাড়াতে বেশ কিছু নতুন উদ্যোগের প্রস্তাব দিয়েছেন। মন্ত্রী বাংলাদেশের সমুদ্ররক্ষীদের প্রশিক্ষণেরও প্রস্তাব দেন। তিনি সব ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে অব্যাহত সহযোগিতারও আশ্বাস দেন।’ কোনো কোনো নিরাপত্তা বিশ্লেষক মনে করেন, ভারত এমন কিছু প্রস্তাব দিয়েছে, যা গ্রহণ করলে এত দিন বাংলাদেশের যে সামরিক কৌশল ছিল বা আছে, তা বদলাতে হবে। সেটি করতে বাংলাদেশ প্রস্তুত আছে কি না, সেটাও বড় প্রশ্ন। বর্তমানে বাংলাদেশ যে সামরিক সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্র আমদানি করে তার ৭৮ শতাংশ জোগান দেয় চীন (সূত্র: ডিপ্লোম্যাট ২১ ডিসেম্বর ২০১৬)। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নেও দেশটির সহায়তা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। অন্যদিকে ভারত থেকে যে ৩০০ কোটি ডলার ঋণ বাংলাদেশ পেয়েছে তার বেশির ভাগই অবকাঠামো উন্নয়ন ও যোগাযোগ খাতে ব্যয় হয়েছে বা হবে, যা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রেল, সড়ক ও নৌ সংযুক্তিকে সহজতর করবে। দীর্ঘ মেয়াদে এর থেকে বাংলাদেশ সুফল পেলেও বকেয়া সমস্যাগুলো উপেক্ষা করা যায় না। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক নিয়ে যেসব সমালোচনা আছে, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হলে তা অনেকটাই বন্ধ হতো। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথম ক্ষমতায় এসে গঙ্গার পানিবণ্টনে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি করেন।
এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী মানুষগুলোকেও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কারণেই গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি সম্ভব হয়েছিল। আর ২০১১ সালে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের ঢাকা সফরের সময় তিস্তা নিয়ে দুই পক্ষ সমঝোতায় পৌঁছালেও সেটি চূড়ান্ত করা যায়নি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতার কারণে। তবে ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের পর স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন ছিল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক ঘটনা। এর মাধ্যমে ছিটমহলের বাসিন্দাদের দুর্দশার অবসান হয়েছে, ‘দেশহীন’ মানুষগুলো তাদের দেশ ফিরে পেয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক এখন অনেক ভালো। কিন্তু আরও ভালো হতে পারত। গত রোববার ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা রাজশাহীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বন্ধুত্ব একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে হয় না। আমরা স্থল ও সমুদ্রসীমান্ত, ভারতীয় বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারসহ নানা বিষয়ে কাজ করছি। এগুলোর মধ্যে তিস্তাও আছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এরই মধ্যে যত দ্রুত সম্ভব ইতি টানতে বলেছেন।’ কিন্তু মমতা সেটি করতে দেবেন কি? তিনি তো কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আগে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ককে প্রভাবিত করত, এখন ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি করছে। কোনোটিই সুস্থতার লক্ষণ নয়। দিল্লিতে হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘তিস্তা কতটা এগোল?’ তিনি বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমাদের দিক থেকে তো কিছু করণীয় নেই। বল এখন ভারতের কোর্টে।’ আলোচনায় আসে বাংলাদেশ-ভারত সামরিক কৌশলগত সম্পর্কের বিষয়টিও। সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বললেন, ‘কৌশলগত সম্পর্ক তো আছেই, আমাদের লোকজন এখানে প্রশিক্ষণ নেয়, যৌথ মহড়া হচ্ছে।
সফর বিনিময় করছেন কর্মকর্তারা।’ এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। কিন্তু ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী সব ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগ থাকবে কি না, সেটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। একাধিক সামরিক বিশ্লেষক জানিয়েছেন, যেকোনো দেশের সশস্ত্র বাহিনীর একটি কৌশলগত পরিকল্পনা থাকে। তাতে সাধারণত প্রতিবেশী দেশকে যুক্ত করা হয় না। সবকিছুর পর আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে যেভাবে আছে, সেভাবে চলবে, না নতুনভাবে শুরু করব? তাঁদের মতে, চীন থেকে সাবমেরিন কেনার বিষয়টি ভারতকে কিছুটা ভাবনায় ফেললেও বাংলাদেশের দর-কষাকষির ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সেনা-কূটনীতিক বলেছেন, ‘আমরা সাবমেরিন কিনেছি, এটি বড় ঘটনা। এখন যেকোনো দেশ আমাদের হিসাব করে চলবে।’ অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে যত বিতর্ক থাকুক না কেন, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকার মোটামুটি ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে বলেই কূটনীতিকেরা মনে করেন। এ কারণেই এশিয়ার বৃহৎ শক্তি তথা চীন, ভারত ও জাপানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। রাশিয়ার সঙ্গেও সহযোগিতা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ, তাও বলা যাবে না। ভবিষ্যতে পররাষ্ট্রনীতিতে এই ভারসাম্য বজায় রাখা গেলে আমাদের দর-কষাকষির ক্ষমতা আরও বাড়বে। সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি যেটি বেশি প্রয়োজন তা হলো গণতান্ত্রিক কাঠামো সুদৃঢ় করা। সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে পাটজাত পণ্যে অ্যান্টি–ডাম্পিং নিয়ে। আমরা যখন দিল্লি থেকে ফিরছিলাম, তখনই জানতে পারলাম বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ কলকাতা হয়ে ভুবনেশ্বর গিয়েছেন মন্ত্রী পর্যায়ের একটি বৈঠকে যোগ দিতে।
তিনি তাঁর ভারতীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে জানিয়েছেন, অচিরেই অ্যান্টি–ডাম্পিং সমস্যার সমাধান হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের রপ্তানিকারকদেরও গাফিলতি ছিল। উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে পণ্য রপ্তানির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের আমদানিকারকেরা যেসব বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন, তার জবাব দেননি অনেকেই। ফলে বাণিজ্যমন্ত্রীকে দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারত সহযোগিতা সম্মেলনে স্মৃতি ইরানিও অ্যান্টি–ডাম্পিং সম্পর্কে বললেন, ‘একসময় ব্যাটারি নিয়ে এই সমস্যা ছিল, সেটি মিটেছে, পাটের সমস্যাও মিটমাট হয়ে যাবে।’ তবে বস্ত্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী বস্ত্র-বাণিজ্য নিয়েই বেশি কথা বললেন। তাঁর মতে, ‘আমরা তো জামদানি পর্যটন শুরু করতে পারি। বাংলাদেশের জামদানির উৎস যেখানে, সেখানে যেতে পারেন আমাদের দেশের ক্রেতা, বিক্রেতা ও সংশ্লিষ্ট কর্তারা। আবার ওখানকার ব্যবসায়ীরাও এখানে এসে জামদানির বাজারকে সমৃদ্ধ করতে পারেন। ঢাকাই জামদানির জন্মস্থান। বস্ত্রশিল্পের ক্ষেত্রে আমরা হাত ধরতে পারলে গোটা বিশ্বের শাড়ির বাজারে আধিপত্য করতে পারব।’ দুই দেশে জামদানি বাণিজ্যের প্রসার ঘটুক, পদ্মার ইলিশ ভারতে যাক, এটা আমরাও চাই। কিন্তু তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন সমস্যার সমাধানও করতে হবে। ভারত যুক্তি দেখাচ্ছে, ‘উজানেই নদীতে পানি নেই। আমরা বাংলাদেশকে পানি দেব কোথা থেকে?’ এর সমাধান হলো যৌথ নদী ব্যবস্থাপনার (বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান) মাধ্যমে বর্ষা মৌসুমে পানি আটকে রেখে শুকনো মৌসুমে ভাটির দেশের চাহিদা মেটানো। এ ব্যাপারে বহু বছর ধরেই কথাবার্তা হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় ঘুরেফিরে এসেছে মৌলবাদের উত্থান ও জঙ্গি তৎপরতা, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন, ভারতের সংখ্যালঘুদের প্রতি দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির কথা। দুই দেশের প্রতিনিধিরা অনেক বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করলেও একটি বিষয়ে একমত হন যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক মজবুত ও টেকসই করতে হবে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধেও একসঙ্গে আমাদের লড়তে হবে। কিন্তু সমস্যাগুলো বকেয়া রেখে তা কতটা সম্ভব হবে, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। (শেষ)
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.