বুশরার মা কেন ন্যায়বিচার পাবেন না? by কামাল আহমেদ

বিচারপ্রার্থী বুশরার মায়ের আহাজারির
কোনো জবাব কারও কাছে নেই
‘আমার মেয়েটা খুন হয়ে ঘরে পড়ে রইল, মামলা হলো। আমি ১৬ বছর ধরে আদালতে আদালতে ঘুরলাম। জজকোর্ট, হাইকোর্ট সাজা দিলেন। আজ জানলাম, সর্বোচ্চ আদালতে তারা খালাস পেয়েছে। তাহলে বুশরাকে খুন করল কে? আমি কী বলব? বুশরা কি কখনো ছিল? আমার তো মনে হয়, বুশরা নামে কখনো কেউ ছিলই না।’ কথাগুলো রুশদানিয়া ইসলাম বুশরার মা লায়লা ইসলামের। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান বুশরা ২০০০ সালের ১ জুলাই খুন হন। খুনের আগে তিনি ধর্ষণেরও শিকার হয়েছিলেন বলে পুলিশের মামলায় বলা আছে। বিচারপ্রার্থী সন্তানহারা এই মায়ের আহাজারির কোনো জবাব নেই। মেয়ে হত্যার বিচার না পাওয়াই তাঁর আহাজারির কারণ। বিচারিক আদালতে চারজনের সাজা হয়েছিল। হাইকোর্ট বিভাগ দুজনেরটা বহাল রেখে দুজনকে খালাস দেন। আর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সবাইকেই খালাস দিয়েছেন। পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সবাই ছাড়া পেয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত দিন যাঁদের দোষী বলে ভাবা হলো, তাঁরা যেহেতু আর দোষী নন, তাহলে অপরাধী কে বা কারা? সেই আসল অপরাধী কি তাহলে এত দিন মুক্ত অবস্থায় আমাদের মধ্যেই চলাফেরা করেছে? এবং এখনো করছে? তাহলে তো বিষয়টি ভয়ংকর। এক বা একাধিক গুরুতর ধর্ষণকারী ও খুনি অবাধে বিচরণ করাকালে গত ১৬ বছরে আরও কটি অপরাধ করেছে বা এখনো করতে পারে, তা আমরা জানি না। আমাদের পুলিশ আসল অপরাধী ধরতে পারেনি এবং বিচারব্যবস্থাও একজন সন্তানহারা মায়ের জন্য ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করতে পারেনি। এই অবস্থায় মামলাটির কি নতুন করে তদন্ত এবং বিচার হবে? ফৌজদারি অপরাধ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে এর কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তাঁদের সবার ভরসা আপিল বিভাগের রায়ের রিভিউয়ে যদি কিছু হয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে কি না, তা পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে বোঝা যাবে। তাঁর মতে, আপিল বিভাগের রায়ের পর এই মামলায় পুনর্বিচার ও পুনঃ তদন্তের কোনো সুযোগ নেই। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের মতেও এই মামলায় পুনরায় তদন্ত বা পুনর্বিচারের সুযোগ নেই। আরেকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, খালাসও বিচারের আওতায়, সাজাও বিচারের আওতায়। তবে এখন রাষ্ট্রপক্ষ এ ব্যাপারে রিভিউ করতে পারে।
ফৌজদারি আইনের বিশেষজ্ঞদের কথায় যেটুকু বোঝা যায়, তাতে বিচারে অপরাধী চিহ্নিত না হওয়াও একটি বিচার এবং সে কারণে বুশরা হত্যা মামলায় নতুন করে তদন্ত বা পুনর্বিচারের কোনো সম্ভাবনা নেই। যদি আপিল বিভাগের বিচারপতিরা তাঁদের রায়ে স্পষ্ট করে পুনঃ তদন্ত ও পুনর্বিচারের আদেশ দেন, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। বুশরার মামলার মতো অনেক মামলাতেই নানা কারণে অপরাধী সাজা পান না। সাক্ষীর অভাবে শহীদ ডা. শামসুল আলম মিলন হত্যা মামলায় কোনো অপরাধীর সাজা হয়নি। পুলিশি তদন্তে গাফিলতি, ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত, সাক্ষী হাজির করাতে না পারা, আসামিপক্ষের ভীতিপ্রদর্শনের মতো ঘটনাতেও অনেক গুরুতর অপরাধের বিচার হয় না এবং অপরাধীরা পার পেয়ে যান। তদন্তে ঘাপলা এবং সাক্ষীদের ভয় দেখানোর মতো ঘটনায় রাজনৈতিক প্রভাব এবং অপরাধীচক্রের প্রতাপ-প্রতিপত্তির বিষয়গুলোও গুরুতর।
বাংলাদেশে আমরা প্রায়ই শুনে থাকি যে দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলে আসছে। এই বিচারহীনতার অবসান ঘটানোর অঙ্গীকার করা রাজনীতিকদের খুব প্রিয় একটি অভ্যাস। কিন্তু বিচারহীনতা দূর করার উদ্যোগ ততটা দৃশ্যমান নয়। বিচারহীনতা দূর করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকারে তারতম্য আছে। বিচার পাওয়ার অধিকার সবারই যে সমান, সেটি সব সময় খুব একটা বিবেচনায় আসে না। ফলে বুশরার পরিবার বিচার না পেলেও তা নিয়ে খুব বেশি কেউ মাথা ঘামাবেন বলে মনে হয় না। সে কারণেই আমাদের নীতিনির্ধারকদের বোধ হয় স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে বিচারব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের আস্থা ধরে রাখতে হলে সবার ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। গুরুতর অপরাধের মামলায় সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা না গেলে পুনরায় তদন্ত এবং পুনর্বিচারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এখন পর্যন্ত বিষয়টি শুধু আদালতের এখতিয়ার বলেই জানা যায়। আদালত নির্দেশ দিলেই পুনর্বিচার সম্ভব। যেমনটি হয়েছে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মামলায়। তবে সেটি ছিল বিচারিক আদালতের আদেশ। এবং তাতে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্যোগ ছিল। রাষ্ট্রপক্ষ উদ্যোগী হয়ে নতুন সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়ে বিচারিক আদালতে আবেদন করার কারণেই তার পুনঃ তদন্ত ও পুনর্বিচার সম্ভব হচ্ছে।
বুশরার মামলার ক্ষেত্রে তেমনটি হবে না কেন? এই প্রশ্নের জবাবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে একই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বিতীয়বার বিচার করা যায় না। আইনের ভাষায় ডাবল জিওপার্ডি নামে পরিচিত নীতির কারণে একই অপরাধের জন্য দুই বা একাধিকবার কাউকে সাজা দেওয়া যায় না অথবা ঝক্কিতে ফেলা যায় না। বুশরার হত্যাকাণ্ডের জন্য যদি অন্য কেউ দায়ী হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর বিচারে তো কোনো বাধা থাকার কথা নয়। সুতরাং, প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্র কেন মামলাটি আবারও তদন্ত করবে না?
ব্রিটেনে ডাবল জিওপার্ডির নীতিমালা অনুসৃত হয়েছে প্রায় আট শ বছর। কিন্তু ২০০৫ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে ওই নীতি বাতিল হয়ে যায়। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের আপিল আদালত বুশরার মতোই এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে আগে একবার খালাস পাওয়া প্রেমিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ পুনঃ তদন্ত এবং পুনর্বিচারের আদেশ দেন। ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে ২২ বছর বয়সী জুলি হগকে তাঁর টিসাইডে বিলিংহামের বাড়িতে বন্ধু বিলি ডানলপ যৌন আক্রমণের পর হত্যা করেন। বিচারের সময় জুরি সদস্যরা একমত হতে না পারায় বিলি ডানলপ ছাড়া পেয়ে যান। কিন্তু পরে বিলির বিরুদ্ধে পুলিশ অকাট্য প্রমাণ পেয়ে গেলে আপিল আদালত বিলিকে খালাস দেওয়ার রায় বাতিল করে পুনর্বিচারের সিদ্ধান্ত দেন। আপিল আদালত তাঁর আদেশে বলেন যে ডিএনএ, নতুন সাক্ষী কিংবা কারও স্বীকারোক্তির কথা জানা গেলে বা প্রকাশ পেলে অতীতের যেকোনো মামলায় পুনঃ তদন্ত এবং নতুন করে বিচারের ব্যবস্থা করা যাবে (ডাবল জিওপার্ডি ল আর্শাড আউট, বিবিসি জানুয়ারি ৩, ২০০৫)।
ডাবল জিওপার্ডি নীতি বাতিল করে ব্রিটেনে আইন সংশোধনের প্রস্তাব প্রথম উত্থাপিত হয় লর্ড ম্যাকফারসন কমিশনের রিপোর্টে। ১৯৯৬ সালে লন্ডনের রাস্তায় একদল বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ তরুণের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ স্কুলছাত্র স্টিফেন লরেন্স নিহত হওয়ার পর তার বাবা-মা যে মামলা করেছিলেন, তাতে অপরাধীরা সবাই ছাড়া পেয়ে গেলে ব্রিটেনজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বিষয়টি নিয়ে তখন সরকার একটি বিশেষ কমিশন গঠন করে। সেই ম্যাকফারসন কমিশন ১৯৯৯ সালে ডাবল জিওপার্ডি আইন বিলোপের সুপারিশ করে। ২০০৫ সালের পর সেই স্টিফেন লরেন্স হত্যা মামলায় খালাস পাওয়া তিনজনের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা হয় এবং তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয় (দ্য টেলিগ্রাফ, ৩ জানুয়ারি ২০১২)।
ব্রিটেনে যেকোনো অপরাধের বিষয়ে তদন্ত করার নির্দেশ এবং আদালতে মামলা পরিচালনার কাজটি করে থাকে ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিস, সংক্ষেপে সিপিএস। কোন কোন ক্ষেত্রে নতুন করে বিচার (রিট্রায়াল) করা যাবে, তার এক নির্দেশিকা সিপিএস তার অধীন আইনকর্তাদের উদ্দেশে প্রকাশ করেছে, যা তাদের ওয়েবসাইটেও পাওয়া যায়। তাতে দেখা যাচ্ছে, জুরি সদস্যরা একমত হতে ব্যর্থ হওয়া, আপিল আদালতের আদেশ, দুর্নীতির কারণে খালাস পাওয়া এবং গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে নতুন এবং অকাট্য (কমেপেলিং) প্রমাণ হাতে আসার মতো পরিস্থিতিগুলোর কথা বলা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জনস্বার্থের বিবেচনা।
চলতি বছরের মে মাসে অস্ট্রেলিয়াতেও আইন সংশোধন করে নতুন অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেলে পুনর্বিচারের বিধান আনা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল সায়মন করবেল বলেছেন যে আইনে যা ছিল তাতে অপরাধী মামলায় খালাস পাওয়ার পর প্রকাশ্যে অপরাধ স্বীকার করলেও তার পুনর্বিচারের কোনো সুযোগ ছিল না। এটি বড় অবিচার। তাই নতুন সংশোধনীতে খালাস দেওয়া চ্যালেঞ্জ করে আবারও বিচার করা সম্ভব হচ্ছে। (সূত্র: এবিসি নিউজ)। ব্রিটেনের মতো একই ধরনের পরিস্থিতিতে এই পুনর্বিচারের ব্যবস্থা করেছে অস্ট্রেলিয়া।
আগেই বলেছি, বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটানোর কথা বলাটা এখন অনেকটাই ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। রাজনীতিকেরা এ বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন, সেই আলামতও নেই। সে ক্ষেত্রে ভরসা হচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট। ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের বিষয়ে তাঁরা এক যুগান্তকারী রায় দিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে আশার সঞ্চার করেছেন। বিচারপ্রার্থীর ন্যায়বিচার পাওয়া নিশ্চিত করতে ত্রুটিপূর্ণ বিচারের বদলে পুনর্বিচারের নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষমতাও তাঁদের আছে। আর আছে ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার মেতা কমনওয়েলথভুক্ত দেশের দৃষ্টান্ত।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.