শুভবুদ্ধির জাগরণ ঘটলে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ থাকবে না

প্রথম আলো: ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার এক বছর পূর্ণ হতে চলল। হত্যাকাণ্ডের আগের ও পরের ঘটনাগুলো কীভাবে দেখছেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: অভিজিৎ রায়ের হত্যার পর দীপনের নিরাপত্তার অভাব সম্পর্কে আমার কিংবা দীপনের মায়ের কোনো সচেতনতা ছিল না। দীপন নিজে কিছুই জানায়নি। এ জন্য আক্ষেপ হয়। দীপনের ৪৩ বছরের জীবনের নানা ঘটনা স্মরণ হয়। স্মৃতি কষ্ট দেয়। নীরবে অশ্রুপাত হয়। মনকে শান্ত করার চেষ্টা করি।
প্রথম আলো: দীপন কোনো চাকরি না করে জ্ঞানচর্চাকে এগিয়ে নিতে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। বাবা হিসেবে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: আমাদের পরিবারের যে ক্ষতি হলো, তা তো কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়। দীপনের ছেলের ও মেয়ের জন্যই সবচেয়ে বেশি কষ্ট। জাগৃতি প্রকাশনীর ‘জাগৃতি’ কথাটা ‘রেনেসাঁ’ অর্থে গ্রহণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশে নতুন রেনেসাঁ সৃষ্টি আমার ও দীপনের কাম্য ছিল। রেনেসাঁর লক্ষ্য যুগের অনাচার ও নির্যাতন থেকে মুক্তি ও নতুন সৃষ্টি। রেনেসাঁর ধারায় গণজাগরণও সৃষ্টি হয়। এসব নিয়ে দীপনেরও উপলব্ধি ছিল। মন-মানসিকতা ও চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে বাংলাদেশ সামনে না গিয়ে পেছন দিকে ফিরে যাচ্ছে। ইতিহাসের এই পশ্চাৎগতি দেখে আমার সঙ্গে দীপনও উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হতো। বাংলাদেশের লেখকসমাজে, কোনো কোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও নতুন রেনেসাঁর চেতনা দেখা দিলে আবার সম্মুখগতি শুরু হবে।
প্রথম আলো: দীপন হত্যাকাণ্ড তো মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নৃশংস আঘাত। এই আঘাতের বিরুদ্ধে সমাজ কতটা জাগ্রত হয়েছে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: কোনো সন্দেহ নেই, মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নৃশংসতম আঘাত। এ সম্পর্কে সমাজে স্থূল উপলব্ধি আছে। কিন্তু আত্মরক্ষামূলক মনোভাবই প্রবল। কথা বলতে, লিখতে সবাই ভয় পাচ্ছেন। সরকার পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা বাহিনীকে সক্রিয় করেছে, ক্রমাগত বন্দুকযুদ্ধ ঘটানো হচ্ছে। কিন্তু বিচারপ্রক্রিয়ার গতি মন্থর। যে সমাজে বৌদ্ধিক চরিত্র দুর্লভ, সে সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপলব্ধিও দুর্বল থাকে। মত থাকলে এবং মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা থাকলে মত প্রকাশের স্বাধীনতার তাগিদ থাকে। প্রগতিশীল ভবিষ্যৎ সৃষ্টির তাগিদ দেয় এমন মত প্রকাশের চেষ্টা দখি না।
প্রথম আলো: দীপন হত্যার বিচারের ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা ও তদন্তকাজে কি আপনি সন্তুষ্ট?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: সমাজে, রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইনের শাসনের জন্য বিচার ও অপরাধীদের শাস্তি অপরিহার্য। যারা হত্যাকারী, জল্লাদ, অপরাধী কি কেবল তারা? হত্যাকারীদের যারা সৃষ্টি করেছে, তারা তো তদন্তের আওতায় আসছে না। পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমকে বুঝতে হবে। ওয়াশিংটন থেকে ঢাকা পর্যন্ত চলমান রাজনীতিকে বোঝার চেষ্টা করলে অনেক কিছু উপলব্ধি করা যায়। আবার বোঝাটাই শেষ কথা নয়, কাজের দ্বারা অপশক্তিকে পরাজিত করে শুভশক্তির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক হাতে তালি বাজে না। দেশে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার দরকার। রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার দরকার। নতুন রেনেসাঁ ও গণজাগরণ লাগবে। সরকার চেষ্টা করছে কেবল পুলিশ, র‌্যাব, বন্দুকযুদ্ধ আর আইন-আদালত দিয়েসমস্যার সমাধান করতে।যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন ন্যাটোকে দিয়ে ১৫ বছর ধরে সশস্ত্র ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিস্টদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর লাখো মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ আছে এই যুদ্ধে থাকার জন্য। বাংলাদেশ তো মনে হয় কালচারাল অবক্ষয় থেকে এথনিক অবক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে।
প্রথম আলো: দীপন হত্যার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আপনি যা বলেছিলেন, তা কেবল একজন শোকাহত বাবার বক্তব্য ছিল না, ছিল বিবেকের কণ্ঠস্বর। কিন্তু হত্যার বিচারও তো হতে হবে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: হত্যার বিচার করা সরকারের দায়িত্ব। তাতে আমাদের পরিবারের পূর্ণ সহযোগিতা আছে। দীপনের স্ত্রী একটি মামলাও করেছে। সমাজেরও এ ব্যাপারে দায়িত্ব আছে। দীপন ছাড়াও যারা প্রাণ হারিয়েছে, সব হত্যারই বিচার হওয়া উচিত। সমাজ, সরকার যদি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ওপর তদবিরের দায়িত্ব চাপায়, তাহলে সেটা অন্যায়। রাজীব, অভিজিৎ, অনন্ত, দীপন, নাজিম—মানুষ হিসেবে এরা প্রত্যেকেই অসাধারণ ভালো ছিল। যোগ্য ছিল। ভুল করে থাকলে ভুলের সংশোধন ছিল। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে সহায়তা দেওয়া সরকারের ও সমাজের কর্তব্য। সমাজ দায়িত্বশীল হলেই সমাজে শান্তি থাকে। আমি হিংসা-প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করি না। যে বিচার দ্বারা হিংসা-প্রতিহিংসা সৃষ্টি হয়, সেই বিচার ত্রুটিপূর্ণ। তাতে আইনের শাসন বিপর্যস্ত হয়। বাংলাদেশে আইন ও বিচারব্যবস্থা দুর্বল, ত্রুটিপূর্ণ। এ দিয়ে কল্যাণ অল্পই আশা করা যায়। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থাকে আমূল পুনর্গঠিত করতে হবে। এ কারণেই আমি শুভবুদ্ধির জাগরণের কথা বলে থাকি। সেটাও হঠাৎ হয় না। সমাজে অশুভ বুদ্ধির সঙ্গে শুভবুদ্ধির, অশুভ শক্তির সঙ্গে শুভশক্তির নিরন্তর সংগ্রাম দরকার। চিত্তশুদ্ধি, চিত্তোৎকর্ষ আকস্মিকভাবে হয়ে যাওয়ার ব্যাপার নয়; জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে চেষ্টার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়।
প্রথম আলো: আপনি সমাজকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও ধর্মপন্থী—এ দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন এবং বলেছেন, উভয় পক্ষকেই সহিষ্ণু আচরণ করতে হবে। কিন্তু ধর্মবাদী বা জঙ্গিবাদীরা তো সরাসরি মানুষ হত্যা করছে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: যারা মানুষ হত্যা করছে, তারা মানুষের কাতারে নেই। তাদের জন্য কঠোরতাই দরকার। মানুষের সমাজে বাঘ-সিংহ ঢুকে গেলে যা করতে হয়, তা-ই করতে হবে। কিন্তু বৃহত্তর সমাজের দিকেও তাকাতে হবে। মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনের ফল কী হচ্ছে? নারীবাদী আন্দোলনের ফলে নারী নির্যাতন কমেছে? গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদকে ব্যর্থ করে, দুর্নীতি ও জুলুম-জবরদস্তি সম্পর্কে নীরবতা অবলম্বন করে, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ অনুসারী হয়ে, আমরা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা যেসব কাজ করে চলছি, সেগুলোর ফল কী হচ্ছে! তাবলিগ জামাত, সুফি সম্মেলন, মসজিদ, মাদ্রাসা, দরগা, খানকা ইত্যাদির দিকেও তাকাতে হবে। গণতন্ত্রের অবস্থা কী? ৩৫ বছর ধরে যাঁরা ক্রমাগত ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছেন, তাঁদের প্রচারের ফল কী হয়েছে? সভ্যতার বিকাশে ধর্মের ঐতিহাসিক ভূমিকা বুঝতে হবে। ওয়াশিংটন ও লন্ডন থেকে ঢাকা পর্যন্ত আমরা যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, তাঁদের ভূমিকা সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখা ভুল। কেবল মৌলবাদীদের, জঙ্গিবাদীদের ও যুদ্ধাপরাধীদের পরাজিত করে, শাস্তি দিয়ে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। নিজেদের চরিত্রও উন্নত করতে হবে।
প্রথম আলো: আপনি একসময় সক্রিয় বাম রাজনীতি করতেন। বাংলাদেশে বামদের ব্যর্থতার কারণ কী?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে আমি মার্ক্সবাদের প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলাম। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা চাইতাম। কিন্তু কখনো আমি মার্ক্সবাদকে অন্ধভাবে গ্রহণ করিনি। সব সময় মূল্যবোধ ও স্বাধীন বিচার-বিবেচনাকে মূল্য দিয়েছি। মার্ক্স, অ্যাঙ্গেলস, লেনিন, মাও সে-তুংয়ের লেখা আমি যেমন মনোযোগ দিয়ে পড়েছি, তেমনি পড়েছি অক্ষয়কুমার দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, ত্রিবেদী, জগদীশচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র, জসীমউদ্‌দীন, নজরুল, রবীন্দ্রনাথের লেখা। বার্ট্রান্ড রাসেল, তলস্তয়, এরিখ ফ্রোম ও আবু সয়ীদ আইয়ুবের লেখা মুগ্ধ বিস্ময়ে পড়েছি। নীহার রায়ের বাঙালির ইতিহাস সব সময় আমার প্রিয় বই। জাতীয় ঐতিহ্য ছেড়ে আমি মার্ক্সবাদ কিংবা অন্য কোনো চিন্তাধারা গ্রহণ করিনি। আমার রচনাবলিতে তার পরিচয় রয়েছে। বাংলাদেশের মার্ক্সবাদী ধারায় থেকেও মার্ক্সবাদী কোনো সংগঠনের সঙ্গে আমি একাত্ম হতে পারিনি। দল ভাঙাভাঙির প্রক্রিয়ায় আমি কেবল কষ্ট পেয়েছি। নির্বুদ্ধিতা ও ভণ্ডামি দেখে ব্যথিত হয়েছি। মার্ক্স, অ্যাঙ্গেলস, লেনিন, মাও সে-তুংয়ের চিন্তাধারা দ্বারা আমি আলোকিত ও অনুপ্রাণিত। কিন্তু কোনো অযৌক্তিক চিন্তা গ্রহণ করিনি। আমি চিন্তার জগতে আছি। কাজ করতে চাই। দল চাই। ডিকটেটরশিপ অব দ্য প্রলেতারিয়েতে কখনো আমার আস্থা হয়নি।এ দেশের মার্ক্সবাদীদের শ্রেণিসংগ্রামের ধারণাকেও আমার কাছে যান্ত্রিক মনে হয়েছে। বরং শ্রেণিসংগ্রাম সম্পর্কে মাও সে-তুংয়ের ধারণাকে আমার কাছে কিছুটা অন্য রকম মনে হয়েছে। মার্ক্স, অ্যাঙ্গেলস, লেনিন, মাও সে-তুং—কারও চিন্তা ও কর্মেই গুপ্তহত্যার রাজনীতির প্রতি সমর্থন কিংবা অনুমোদন আছে বলে মনে হয়নি।গুপ্তহত্যার প্রতি ইসলামেরও কোনো সমর্থন বা অনুমোদন আছে বলে আমি মনে করি না। আমার চলায় ভুলত্রুটি থাকতে পারে, অস্বীকার করি না। ভুল হলে ভুল সংশোধন করি। ভুলটাই ধরে থাকি না।
প্রথম আলো: মুক্তিযুদ্ধের যে অঙ্গীকার ছিল গণতন্ত্র, সমতা, ন্যায় ও মানবতা; আজকের বাংলাদেশ সেসব থেকে কত দূরে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: ছয় দফা আন্দোলন মহান আবেগ দ্বারা পরিচালিত ছিল। কিন্তু তাতে ভবিষ্যৎ দৃষ্টি পর্যাপ্ত ছিল না। দল গঠন ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র সম্পর্কে গভীর ধারণা, রাষ্ট্র গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনার সমস্যা ইত্যাদি বিবেচনা পায়নি। সেই আবেগ-উত্তেজনার কালে দলীয় আত্মগঠনের কিছুই ছিল না। ফলে নতুন রাষ্ট্র নতুন সংবিধান নিয়ে ভালো চলছে না ১৯৭২ সাল থেকেই। তারপর সামরিক শাসন, এনজিও, সিভিল সোসাইটি, সংস্থা ইত্যাদি নিয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি। আট বছর ধরে আওয়ামী লীগ একটানা ক্ষমতায় আছে। প্রকৃতপক্ষে এখন বাংলাদেশে কার্যকর আর কোনো দলই নেই। বাংলাদেশ এখন চলছে মুক্তবাজার অর্থনীতি, অবাধ প্রতিযোগিতাবাদ, বন্ধুত্ববাদ ইত্যাদি নিয়ে। গণতন্ত্রকে পর্যবসিত করা হয়েছে নির্বাচনতন্ত্রে। গণজাগরণ আর হুজুগ এক নয়।
প্রথম আলো: দীপন হত্যার বিচার হবে, অপরাধীরা শাস্তি পাবে বলে সরকার থেকে বলা হচ্ছে। আপনি কতটা আশাবাদী?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: এ প্রশ্ন অনেকেই করেন। প্রচারমাধ্যমেও বারবার প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়। হয়তো আশার কারণ যথেষ্ট পাওয়া যায় না বলেই প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়।
প্রথম আলো: দীপন হত্যার পরে সমাজে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল, আমরা কি সেটি ধরে রাখতে পেরেছি?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: কোনো ঘটনার প্রতিক্রিয়াই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কালস্রোতে সবই ভেসে যায়। সমস্যাবলির সমাধানের জন্য সদর্থক আন্দোলন আমাদের কর্তব্য। এর জন্য চিন্তাভাবনার ও কার্যধারার আমূল সংস্কার দরকার। দীপনের আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত নতুন রেনেসাঁকামী কোনো কোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আত্মপ্রকাশ করলে তার আরদ্ধ কাজ চলমান থাকবে।
প্রথম আলো: জাগৃতি প্রকাশনী কীভাবে চলছে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: জাগৃতি প্রকাশনীকে রক্ষা করার ও উন্নত করার প্রচেষ্টা আছে। দীপনের স্ত্রী দেখাশোনা করে। প্রয়োজনে আমার পরামর্শ নেয়। এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিতে লেখক-পাঠকদের সচেতনতা ও সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন।
প্রথম আলো: যে দর্শন বা রাজনীতি মানুষ হত্যাকে প্ররোচিত করে, সেই দর্শনকে পরাস্ত করতে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র এমনকি বুদ্ধিজীবীরা কি যথেষ্ট সক্রিয়?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: আমি মনে করি, ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় থেকে আমাদের রাজনীতি ও বিশিষ্ট নাগরিকদের কর্মকাণ্ড ভুলপথগামী। সময়ের দাবি ছিল গণতন্ত্রকে সফল করা। তা না করে আরম্ভ করা হলো মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলন। সাধারণ মানুষের ধর্মবোধকে ক্রমাগত আঘাত করা হলো। রাজনীতি পরিচালিত হলো বিবিসি রেডিওর উসকানিমূলক প্রচার দ্বারা। নাগরিক কমিটি (১৯৮১), ৩১ বুদ্ধিজীবী গ্রুপ (১৯৮২), দ্বিতীয় নাগরিক কমিটি (এরশাদ আমল), নাগরিক কমিটি ২০০৬ (যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন) ইত্যাদির মধ্যে বাংলাদেশের ডানপন্থী, বামপন্থী সব দল খড়কুটোর মতো ভেসে গেল। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের নির্দেশনার বাইরে কোনো চিন্তাভাবনা দেখা গেল না। লেখক-শিল্পীরা নিজেদের সত্তা হারিয়ে দলাদলিতে বিভক্ত হয়ে গেলেন।
প্রথম আলো: মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদীদের উত্থানের কারণ কী?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: আদর্শগত কারণ হচ্ছে গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের ব্যর্থতা ও ভুলপথগামিতা। কেবল মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদীদের পরাজিত ও নির্মূল করার আয়োজন দিয়ে আমরা অবস্থার উন্নতি করতে পারব না। আমাদের আদর্শসন্ধিৎসা, আদর্শনিষ্ঠা, সততা ও চরিত্রবল লাগবে। আমাদের মধ্যে শুভবুদ্ধির জাগরণ ও সক্রিয়তা লাগবে। আমাদের আদর্শবোধ ও আদর্শনিষ্ঠা সুদৃঢ় হলে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ টিকবে না। গোটা জাতির মধ্যে যে মনোবলহারা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তার গভীরতাও বুঝতে হবে। চিন্তা লাগবে, চিন্তার সঙ্গে কাজ লাগবে, কাজের জন্য দল লাগবে। যেসব দল আছে, সেগুলোর কোনো কোনোটি নবায়িত হতে পারে, নতুন দলও গঠিত হতে পারে। সংগঠনগত ও আদর্শগত পুনর্গঠনের বিকল্প নেই।
প্রথম আলো: বই প্রকাশের কারণে জীবন দেওয়ার ঘটনা বিরল। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা সমাজের পক্ষ থেকে দীপনের যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে কি?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: আমার বিবেচনায় জনসাধারণ ঘুমন্ত। ফেসবুক,ব্লগ ও অনলাইন অ্যাক্টিভিজমের প্রভাব আছে। জনমনে তাতে গভীর চিন্তাভাবনা নেই। প্রগতিতে আস্থার প্রকাশ নেই। বইপত্রে গভীর চিন্তা কিছু আছে; কিন্তু সেগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা নেই। রাজনীতি দারুণভাবে অবক্ষয়ক্লিষ্ট। পশ্চিমা সভ্যতায় সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই অবক্ষয় আছে। নতুন সভ্যতা সৃষ্টিতে মার্ক্সবাদ বেশি দূর এগোতে পারেনি। এই বাস্তবতায় সাধারণ মানুষ কী করবে? সরকার তাদের চরিত্র অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে। দীপনের মতো একজন সামান্য মানুষের জীবনের মূল্য স্বীকার করার মানসিকতা সরকারের কাছ থেকে আশা করা যায় না। তবে আমার প্রতি, আমাদের পরিবার-পরিজনের প্রতি সমবেদনা জানাতে আমার পরিচিত ও অপরিচিত বহুজন—সাধারণ মানুষ, অসাধারণ মানুষও—কয়েকজন মন্ত্রী, এমপি, সচিব, বিচারপতি, ছাত্র-শিক্ষক, সম্পাদক, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা এগিয়ে এসেছেন। তাঁদের সংখ্যা বিশাল। দীপনের অনেক বন্ধু পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে সহানুভূতি জানিয়েছে। সবার প্রতি আমি ও আমার পরিবার আজীবন কৃতজ্ঞ। দুঃসময়ে যাঁরা সমবেদনা জানান, তাঁরা মহান। তাঁদের কথা মনে এলে চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। মনে বল-ভরসাও হয়। মনে হয় আমি একা নই। আমরা নিঃসঙ্গ নই। মনুষ্যত্ব হারিয়ে যায়নি। জাতিসংঘের মহাসচিব ফয়সল আরেফিন দীপন নামটি শুদ্ধ করে লিখে শোক প্রকাশ করেছেন। প্রকাশক হত্যায় শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের সাংবাদিকেরা ছুটে এসেছেন আমার কাছে। টেলিভিশন চ্যানেলে ও সংবাদপত্রে তাঁরা আমারও সাক্ষাৎকার প্রচার করেছেন। শুভবুদ্ধির জাগরণ চাই—আমার এ কথাটা দেশে-বিদেশে বারবার প্রচারিত হয়েছে। অনেক রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রকাশক দীপন হত্যার বিচার দাবি করেছেন। জাতিসংঘের মহাসচিবও ভিন্ন বিবৃতিতে তা করেছেন। মনে হয়েছিল যেন গোটা দুনিয়া নড়ে উঠেছে।
প্রথম আলো: দীপন হত্যার পর হলি আর্টিজানের ঘটনা ঘটল। দুই ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র আছে কি?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: আমার মনে হয়েছে ব্লগারদের হত্যা ও দীপন হত্যা গণজাগরণ মঞ্চের প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া। যুদ্ধাপরাধীদের প্রাণদণ্ডেরও প্রতিক্রিয়া। আন্তর্জাতিক কোনো পরিকল্পনা না-ও হতে পারে। হলি আর্টিজানের অপারেশন অবশ্যই কোনো বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ। জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ, হিযবুত তাহ্‌রীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম, তালেবান, আল-কায়েদা, আইএস—এগুলোকে বৈশ্বিক পরিকল্পনার অংশ বলে মনে হয়। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ন্যাটো যে যুদ্ধ চালাচ্ছে, তার প্রতিক্রিয়ায় দুনিয়াব্যাপী অনেক কিছু ঘটে যাচ্ছে। মানবজাতির নৈতিক চেতনার অভাবে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক আক্রমণ, সৈন্য সমাবেশ ও হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নেই।
প্রথম আলো: জঙ্গিবাদীদের মোকাবিলায় সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা কি যথেষ্ট মনে করেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: সরকার কেবল উপরিতলটা দেখছে, গভীরে দৃষ্টি দিচ্ছে না। সরকার অবলম্বন করছে কঠোর দমননীতি। আদর্শগত প্রশ্নে, মনোজগতের দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। সভ্যতার সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য দরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। সভ্যতার বিকাশে ধর্মের অবদান স্বীকার করতে হবে। আদর্শগত চিন্তার মৌলিক পুনর্গঠন লাগবে।
প্রথম আলো: যুক্তির সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র কায়েমের কোনো লক্ষণ দেখছেন কি?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: সরকারি, বেসরকারি ও সরকারবিরোধী কোনো মহলেই তা এখন দেখা যাচ্ছে না। বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের মধ্যে সৃষ্টিশক্তির কোনো লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায় না। কেবল সৃজনশীল পরীক্ষাপদ্ধতি চালু করে আর পরীক্ষার সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে শিশু-কিশোরদের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে। যাঁরা সাম্রাজ্যবাদের অনুসরণে সৃজনশীল পরীক্ষাপদ্ধতির পক্ষে ওকালতি করছেন, তাঁরা কেউ কি অক্সফোর্ড হ্যান্ডবুক ও কেব্রিজ হ্যান্ডবুক অব ক্রিয়েটিভিটি-জাতীয় কোনো বই ছুঁয়ে দেখেছেন? সারা দেশে সব ছেলেমেয়েকে ক্রিয়েটিভ বানানো যাবে?
প্রথম আলো: এই মুহূর্তে রাজনীতির প্রধান সংকট কী? সব ক্ষেত্রেই তো অবক্ষয় ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: কোনো সন্দেহ নেই, দীর্ঘস্থায়ী অবক্ষয়ের মধ্যে আমরা পড়ে গেছি। অশুভ প্রতিযোগিতা সর্বত্র। সর্বজনীন কল্যাণের চিন্তা দুর্লভ। গোটা মানবজাতিই অবক্ষয়ে আছে। দীর্ঘস্থায়ী সভ্যতার সংকট চলছে। স্পেংলার ডিক্লাইন অব দ্য ওয়েস্ট গ্রন্থে, সুইটজার দ্য ডিকে অ্যান্ড রেস্টোরেশন অব সিভিলাইজেশন গ্রন্থে,ক্লাইভ বেল সিভিলাইজেশন গ্রন্থে, রবীন্দ্রনাথ ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে মানবজাতির যে দুর্দশার কথা বলেছিলেন, তা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মার্ক্স, অ্যাঙ্গেলস ১৮৪৮ সালে কমিউনিস্ট ইশতেহার প্রকাশ করে যে প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন, নানা কর্মকাণ্ডের পর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর তা-ও বন্ধ হয়ে গেছে।সংকট ও অবক্ষয় দ্রুতগতিতে চলছে।
বাংলা ভাষার দেশে বুদ্ধদেব বসুদের অবক্ষয়বাদী সাহিত্যান্দোলনের মধ্য দিয়ে যে চিন্তা-চেতনার সূচনা ও বিকাশ, মাস্টার ডিসকোর্স ও গ্র্যান্ড ন্যারেটিভস বাতিল করে দিয়ে চলার মধ্য দিয়ে সেই চিন্তা-চেতনারই আরওপ্রবল গতি চলছে। নজরুল, জসীম, সুকান্ত, সুভাষ, সিকানদার আবু জাফরদের ধারা তো বিকাশহীন। চিন্তা-চেতনায়, দর্শন-বিজ্ঞানে রেনেসাঁর ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। ফজলুল হক, ভাসানী, শেখ মুজিবেরকালের রাজনৈতিক চেতনা থেকে আমরা বিচ্যুত। তবে সম্ভাবনা আছে। সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করতে হবে। শুভবুদ্ধির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
প্রথম আলো: আপনার বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে কিছু বলুন।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: রাজনীতির বিপথগামিতা দেখে ২০০৪ সালে আমি ‘২৮ দফা’ লিখেছিলাম। ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে স্বদেশ চিন্তা সংঘ এবং আরও দু-একটি সংগঠন সেটি প্রচার করে চলেছে। এতে বাংলাদেশকে শতভাগ মানুষের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার প্রস্তাব ও পরিকল্পনা আছে। আন্তর্জাতিক ফেডারেল বিশ্বসরকার গঠনের দ্বারা বিশ্বব্যবস্থা পুনর্গঠনেরও প্রস্তাব আছে। আমাদের জাতির জন্য এবং দুনিয়ার প্রতিটি জাতির জন্য প্রগতির সুষ্ঠু ধারায় উত্তীর্ণ হওয়ার পথনির্দেশ তাতে আছে। ২৮ দফা আমাদের মুক্তি ও উন্নতির কর্মসূচি। বিশিষ্ট নাগরিক, প্রতিপত্তিশালী বুদ্ধিজীবী, শক্তিশালী রাজনীতিবিদ আর কায়েমি স্বার্থবাদীরা আমার বক্তব্যকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখেছেন। কিন্তু তাঁদের বাইরে ‘২৮ দফা আমাদের মুক্তি ও উন্নতির কর্মসূচি’ যিনিই পড়েছেন, তিনিই আশান্বিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছেন। আমি লিখি অন্তরের তাগিদে। মনে হয় আমার লেখা আমাদের জাতীয় জীবনে একদিন না একদিন কার্যকারিতা পাবে। নতুন রেনেসাঁ ও নতুন জাগরণ দেখা দেবে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: ধন্যবাদ। শুভবুদ্ধির জয় হোক।

No comments

Powered by Blogger.