ডিএনডি এখন মরণ বাঁধ

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরার ডিএনডি বাঁধের ভেতরের মানুষ বছরজুড়েই নানা ভোগান্তির মধ্যে বসবাস করে আসছে। ১৯৬৫ সালের আগে এ এলাকায় শুকনো মৌসুমে থাকত সবুজ ফসলের মাঠ, আর বর্ষায় থাকত কানায় কানায় পূর্ণ পানি। পাকিস্তান আমলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমলে মাতুয়াইল, মুসলিম নগর, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, কদমতলী, ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, ফতুল্লা থানাসহ ৫৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বন্যামুক্ত এলাকা গড়তে প্রতিষ্ঠা করা হয় ডিএনডি বাঁধ। ডিএনডি প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল এ এলাকার মানুষ যাতে খালের পানি সেচের মাধ্যমে ইরি ধানসহ যাবতীয় ফসল নির্বিঘ্নে ফলাতে পারে। এলাকাটি ঢাকা শহরের অতি সন্নিকটে বন্যামুক্ত বিধায় ক্রমান্বয়ে গড়ে উঠতে শুরু করে বসতবাড়ি। বর্তমানে ফসলের ক্ষেত বিলীন হয়ে এখানে বহুতল অট্টালিকার সমাহার। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তা, ঘরবাড়ি সবই যেন জলাশয়ে পরিণত হয়। ডিএনডি যেন এখন মরণ বাঁধ।
ডিএনডি বাঁধ এলাকায় অসহায় দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন বাসিন্দারা। অন্যদিকে কয়েক দশকের পুরনো পাম্প দিয়ে উপরোক্ত এলাকাগুলো সারাদিন সেচ করেও জলাবদ্ধতা কমানো যাচ্ছে না। জানা গেছে, ১৯৬৮ সালের যন্ত্রাংশ দিয়ে এখনও সেচ কার্যক্রম চলে। ডিএনডি বাঁধ এলাকায় পানি নিষ্কাশনের জন্য চারটি পাম্প রয়েছে, যা দিয়ে সেকেন্ডে ১৫ কিউসেক পানি নিষ্কাশন করা যাচ্ছে; কিন্তু প্রতি সেকেন্ডে ৭৮ কিউসেক পানি নিষ্কাশনের প্রয়োজন। পাউবো ঢাকা মহানগর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আবু সাইদ জানিয়েছেন, পাম্পের ক্ষমতা কমে গেছে। দ্রুত নতুন ৪টি পাম্প স্থাপন জরুরি। পাশাপাশি বাঁধ এলাকার ৯৪ কিলোমিটার খাল সংস্কার ও দখলমুক্ত করতে হবে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে হবে। তিনি জানান, ২০১০ সালে একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়। সেই প্রতিবেদনে ২৯৪ কোটি টাকা ব্যয়ে পাম্প স্থাপন, খাল সংস্কার ও দক্ষ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো উঠে আসে। প্রকল্পটি ২০১১ সালে একনেকে অনুমোদন পেলেও টাকার অভাবে কাজ শুরু করা যায়নি। পাউবোর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (পাম্প হাউজ) জীবন কুমার সাহা জানান, বহুদিনের পুরনো পাম্পগুলো আর সর্বোচ্চ ৩ বছর চালানো সম্ভব। এখনই প্রস্তুতি না নিলে ডিএনডি এলাকাসহ ঢাকার একটি বড় অংশে বর্ষা মৌসুমে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতে পারে। ডিএনডি পাম্প হাউসে একযুগ ধরে কর্মরত প্রকৌশলী লিয়াকত আলী খান বলেন, ‘আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি, দুই বছরের মধ্যে বাঁধ এলাকার পানি নিষ্কাশনের সব উৎস অকেজো হয়ে যাবে। এখান থেকে কোনো পানিই নিষ্কাশন হবে না। বিকল্প ব্যবস্থা করতে না পারলে বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যাবে। কিছু করতে হলে এখনই শুরু করতে হবে। কারণ একটি পাম্প বসাতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই বছর।’
ডিএনডি বাঁধের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বছরের পর বছর ফাইল বন্দি। ডিএনডি বাঁধ সূত্রমতে, ডিএনডির বর্তমান মোট আয়তন ৩২ দশমিক ৮ বর্গকিলোমিটার। ১৯৬৫ সালে সেচ প্রকল্প ছিল ৫ হাজার ৬৪ হেক্টর। অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে ২৩৩ দশমিক ২৭ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা হয় ডিএনডি প্রকল্পের অবস্থান। ১৯৬৫ সালে শুরু করে ১৯৬৮ সালে ডিএনডি প্রকল্পের কাজ শেষ করা হয়েছিল। বাঁধের ভেতরে কংস নদ নামে একটি বড় ও প্রশস্ত খাল ছিল। এছাড়া ছিল পাগলার খাল ও মালখালী খালের মতো ৯টি খাল। ১৯৯২ সালে জাপানি সাহায্য সংস্থা জাইকা সমীক্ষা চালিয়ে ডিএনডিতে জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমান পাম্প হাউজের মতো ৫টি নতুন পাম্প হাউজ স্থাপন ছাড়াও একাধিক প্রস্তাব রাখে। ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্তৃপক্ষ এ প্রস্তাব বাস্তবায়নে নামলেও পাঁচটি পাম্প অদ্যাবধি নির্মাণ করা হয়নি। ডিএনডি এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনে ২৩৮ কোটি ৩৮ লাখ ১৬ হাজার টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ডিএনডির জলাবদ্ধতা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী সমাধানের জন্য আইনের মাধ্যমে একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পাদন করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে, যা ড্রেনেজ ইম্প্রুভমেন্ট অব ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা প্রজেক্ট নামে পরিচিত। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ডিএনডির অভ্যন্তরে অল্প বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান সম্ভব হতো বলে মনে করা হয়।
সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে মাতুয়াইল দক্ষিণপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ২০ লাখেরও বেশি মানুষ ডিএনডি বাঁধের ভেতরে জলাবদ্ধতায় আটকে গেছে। গত ২৭ জুলাই যমুনা টিভিসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিস্তারিতভাবে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন সম্প্রচারিত হয়েছে। পানি জমে থাকার কারণে প্রতিবছর পাকা করার পরও ভালো ভালো রাস্তা ভেঙে গিয়ে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। ডিএনডি বাঁধের ভেতরের কারখানার বর্জ্য পানি বিভিন্ন খাল, বিশেষ করে পাগলার খাল দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ পাম্প মেশিন দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে গিয়ে মিশে নদীর পানিও ব্যবহারের অনুপযোগী করে ফেলে। প্রতিবছর বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধতায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা ডিএনডি বাঁধের ভেতর বন্যা সৃষ্টি হয়। লাখ লাখ শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার অপূরণীয় ক্ষতি হয়। বর্ষাকালে এলাকার শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারে না। মেরামতকৃত এবং নতুন পাকা রাস্তা ভেঙে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়। ১৯৯৮ সালে ডিএনডি বাঁধের ভেতর ভয়াবহ বন্যার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতুয়াইলসহ ডেমরা এলাকার বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। পাশে ছিলেন মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও ডেমরা থানার স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ হাবিবুর রহমান মোল্লা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও ত্রাণ বিতরণ করেছেন। আমরা ডিএনডি বাঁধের ভেতর এই ভয়াবহ বন্যার কবল থেকে বাঁচতে চাই। ডিএনডি বাঁধের ভেতরে বসবাসকারী মানুষ এখন বিপদগ্রস্ত। তাদের এলাকায় বসবাসসহ সন্তানদের লেখাপড়া অনেকটাই হুমকির মুখে। এলাকার ২০ লাখ মানুষ প্রধানমন্ত্রীর মুখপানে তাকিয়ে আছে।
মো. সিদ্দিকুর রহমান ও এমএ ছিদ্দিক মিয়া : যথাক্রমে আহ্বায়ক ও সদস্য, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম

No comments

Powered by Blogger.