সন্তানের বিপথগামিতা রোধে পরিবারের ভূমিকাই মুখ্য

গুলশান ও শোলাকিয়া হত্যাযজ্ঞের পর সন্তানের বিপথগামিতা রোধে পরিবারের ভূমিকা নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এ বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, সন্তানের বিপথগামিতা রুখতে পরিবারের ভূমিকাই মুখ্য। একটি শিশু পৃথিবীতে আসে অমিত সম্ভাবনা নিয়ে। তবে এ সম্ভাবনার বিকাশ কতটুকু ঘটবে, তা নির্ভর করে তাকে কীভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে তার ওপর। মূলত শিশুর পরিবার, সমাজ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপরই নির্ভর করে তার বিকাশ। সুস্বাস্থ্য, সুশিক্ষা, নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও ভালোবাসার দাবি পূরণ করে প্রতিটি শিশুকে শারীরিক ও মানসিকভাবে পূর্ণ বিকশিত করে তোলা সম্ভব। প্রত্যেক মা-বাবাই তার শিশুকে হাসি-খুশি, স্বাস্থ্যবান, বুদ্ধিদীপ্ত ও পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে দেখতে চায়। সন্তানকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পরিবার যদি সঠিক ভূমিকা পালন করে, তাহলে একটি সুন্দর-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র ও জাতি পাওয়া সম্ভব।
দুশ্চিন্তার বিষয় হল- পরিবার ও সমাজ জীবনে আমরা ক্রমেই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। বর্তমানে পারিবারিক-সামাজিক মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য লুপ্ত হওয়ার পথে। অতীতের সামাজিকতা এবং সামাজিক সংহতি এখন আর তেমন অবশিষ্ট নেই; যার প্রভাব আমাদের পারিবারিক পরিমণ্ডলে ভর করেছে। অপ্রিয় হলেও সত্য, এ বিচ্ছিন্নতা বিদ্যমান ব্যবস্থারই সৃষ্টি, যা প্রত্যেককে প্রত্যেকের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, একই সমাজে বসবাস করেও আজ কেউ কারও নয়। পরিবারগুলোর ক্ষেত্রেও অভিন্ন অবস্থা বিরাজমান। একসময় আমাদের প্রায় প্রতিটি পরিবার একান্নবর্তী ছিল। যৌথ পরিবারের অস্তিত্ব এখন বিলীন হওয়ার পথে। বিচ্ছিন্নতা যেমন গ্রাস করেছে সমাজ জীবনকে; একইভাবে গ্রাস করেছে পরিবারকেও। একটি শিশুর সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হল তার পরিবার। সুস্থ ও সুন্দর জাতি গঠন করতে হলে সবার আগে পরিবারকে সচেতন হতে হবে। পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেও খেয়াল রাখতে হবে কোনো শিক্ষার্থী বিপথগামী হচ্ছে কিনা। বর্তমানে শিশুরা ক্রমেই প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। প্রকৃতির সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়ছে দিন দিন। সভ্যতার অগ্রগতি এবং মানুষের শহরকেন্দ্রিকতা এ জন্য অনেকাংশে দায়ী। এসব বাস্তবতা মেনে নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। ব্যস্ততা ও বাস্তবতার নাগপাশ ছিন্ন করে অভিভাবকরা মাঝে মধ্যে তাদের প্রিয় সন্তানকে যথাসম্ভব প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারেন। শিশুরা নগরে বেড়ে উঠুক, তবে তার পরিচয় ও সম্পর্ক থাকুক প্রকৃতির সঙ্গেও। একই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিও থাকা প্রয়োজন।
রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতিশ্রুতি শিশু-কিশোরদের সঠিক পথ দেখাতে সাহায্য করে। রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে যেন যথাযথ পরিবেশে শিশু-কিশোররা সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করে বেড়ে উঠতে পারে। দেশে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা অন্যূন ২ কোটি ৮০ লাখ। আজকাল মাদক ছাড়াও মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও আকাশ সংস্কৃতির থাবায় অনেক কিশোর-কিশোরী বেপথু হচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকেই জঙ্গিবাদসহ এমন সব ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যা ভাবলেও গা শিউরে ওঠে। বর্তমানে এটি একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আশার কথা, সংবেদনশীল আচরণ, সহমর্মিতা ও মূল্যবোধ জাগ্রত করার লক্ষ্যে সরকার দেশে কিশোর-কিশোরী ক্লাব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের সাতটি জেলায় ৩৭৯টি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সমাজে বিদ্যমান নানা অসঙ্গতির ওপর বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন ও সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি ক্লাবের সদস্যরা হরেক রকম খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি জেলায় এ ধরনের ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হলে তা শিশু-কিশোরদের মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে- এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। মৃত্যু অবধারিত ও অমোঘ। স্বাভাবিক নিয়মে কোনো মানুষের মৃত্যুর ঘটনা আমাদের ব্যথিত করলেও তা নিয়ে কোনো অভিযোগ থাকে না। কিন্তু মৃত্যু যদি অস্বাভাবিকতা নিয়ে কারও জীবনে হানা দেয়, তাহলে মর্মযাতনার সীমা থাকে না। গুলশান ও শোলাকিয়ার মৃত্যুগুলো এমনই। এ মৃত্যু আমাদের সন্তান তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সম্পর্কে আরও সচেতন, সজাগ ও সংবেদনশীল হওয়ার শিক্ষা দেবে- এটাই প্রত্যাশা।
ইফতেখার আহমেদ টিপু : একটি ব্যবসায় গ্রুপের চেয়ারম্যান
chairman@ifadgroup.com

No comments

Powered by Blogger.