রফতানি বাজার হারাচ্ছে আলু

গুণগত মানের অভাবে কমছে আলু রফতানি। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে গত বছরের তুলনায় প্রায় সাড়ে তিনশ’ শতাংশ কমেছে রফতানি। দীর্ঘ সময়ে হিমাগারে সংরক্ষণে কালচে ধরন হচ্ছে আলুর রং। এতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে বিদেশীরা। রফতানি কমে যাওয়ার সঙ্গে নতুন বাজার সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়ে রফতানিকারকরা চিঠি দিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য। সূত্র মতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রফতানি আয় কমেছে ৩৪৭ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিশ্ব বাজারে আলু রফতানি আয় কমেছে ৫ শতাংশ। ওই বছর রফতানি আয় হয় ৩ কোটি ২২ লাখ মার্কিন ডলার। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, আলু রফতানি বাড়ানোর লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করছে। কৃষি পণ্যের বাণিজ্যকরণে আলু রফতানি খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে দেয়া হচ্ছে বিশেষ প্রণোদনাসহ নানাবিধ সুবিধাদি। এ প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারাও সম্পৃক্ত হয়েছেন।
তারা ব্যক্তি প্রচেষ্টায় বাজার খোঁজার পাশাপাশি বাণিজ্যিক মিশনের মাধ্যমেও আলুর বাজার সম্প্রসারণের চেষ্টা করছেন। জানা গেছে, প্রতি বছর গড়ে আলু উৎপাদন হচ্ছে ৮৭ লাখ টন। দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েও গড়ে ১৭ লাখ টন উদ্বৃত্ত থাকছে। কিন্তু বিদেশে রফতানির পরিমাণ এক লাখ টনের কোটা অতিক্রম করতে পারছে না। বাংলাদেশ পটেটো এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিপিইএ) উদ্বেগ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। সেখানে বলা হয়, দেশে রফতানি উপযোগী জাতের আলু উৎপাদন ও প্রাপ্যতা হ্রাস পেয়েছে। রফতানি বাজারে বাংলাদেশী আলুর চাহিদা ও মূল্য কমেছে। এর থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে দ্রুত রফতানি পরিস্থিতি গতিশীল করতে সংগঠনটি প্রতিযোগী বিদেশী জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য এবং গুণাবলীর নিরিখে বাংলাদেশী আলু নিরূপনের উদ্যোগ নিতে হবে। এতে আরও বলা হয়, আলু রফতানিতে দেশ পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে জাতের অনুপযোগিতা। অন্যদিকে রফতানিকারকরা বলছেন, বিশ্ব বাজারে আলুর ব্যাপক চাহিদা থাকলেও সেখানে বাংলাদেশের মার্কেট শেয়ার ৩ শতাংশেরও কম।
সংশ্লিষ্টরা এর নেপথ্য কারণ হিসেবে জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশী আলুর চাহিদা খুব কম। উৎপাদনের পর হিমাগারে সংরক্ষণ অবস্থাতেই এ দেশীয় আলুর গায়ে চামড়ার উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে যায়। ধারণ করে কালচে রূপ। অমসৃণ ও বিবর্ণ রঙের এ আলু বিদেশী ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। যারা নিচ্ছে, তারা দরও দিচ্ছে কম। ফলে প্রতিযোগী দেশের রফতানি হওয়া আলুর চেয়ে পরিমাণে এক হওয়া সত্ত্বেও আমরা মূল্য পাচ্ছি কম। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পটেটো এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিপিইএ) উদ্বেগ জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশ থেকে আলু রফতানি হয়েছিল ৩৩.১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ওই রফতানি অবস্থান থেকে ৫ শতাংশ কমে ৩২.২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। সদ্য বিদায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রফতানির এ হার আগের বছরের তুলনায় ৩৪৭ শতাংশ কমে তা আশংকাজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে। চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, দেশে রফতানি উপযোগী জাতের আলু উৎপাদন ও প্রাপ্যতা হ্রাস পেয়েছে।
রফতানি বাজারে বাংলাদেশী আলুর চাহিদা ও মূল্য কমেছে। এর থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে দ্রুত রফতানি পরিস্থিতি গতিশীল করতে সংগঠনটি প্রতিযোগী বিদেশী জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য এবং গুণাবলীর নিরিখে বাংলাদেশী আলু নিরূপনের উদ্যোগ নেয়ার কথাও জানায়। এতে বলা হয়, আলু রফতানিতে দেশ পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে জাতের অনুপযোগিতা। এদিকে রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে জাতীয় কর্মসূচি অব্যাহত আছে। কিন্তু আশানুরূপভাবে রফতানি বাড়ছে না। এর কারণ হিসেবে রফতানিকারকরা বলেন, আলু জাতের এই পণ্যটির এককজাত নির্ভরশীলতা রয়েছে। এটিই মূলত সমস্যা। প্রায় দুই দশক ধরে ‘গ্রানোলা’ নামের একটি জাত থেকে উৎপাদিত আলুর ওপর ভর করে রফতানি বাজারের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। তবে সম্প্রতি রফতানি উপযোগী জাতের আলুবীজ ছাড় করা হচ্ছে। সেগুলো এখন পর্যন্ত প্রত্যন্ত এলাকার কৃষক পর্যায়ে পৌঁছেনি। অথচ প্রতিযোগী দেশগুলোর অনেক আগেই আলুর নতুন জাত উদ্ভাবন ও কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ করেছে। এই জাতের আলুর গুণাবলী ভালো থাকায় বিশ্ববাজারে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। মূল্যও বেশি পাচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইং সূত্রে জানা গেছে, রফতানিকারকদের এ দাবি সঠিক নয়।
গত এক যুগে দেশের বিজ্ঞানীরা ৬১টি আলুর জাত উদ্ভাবন করেছেন। গত দু’বছরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বারি) আলুর নতুন জাত উদ্ভাবনে বেশ সাফল্য দেখিয়েছে। ২০১৪ সালে বারি-৪৭ থেকে বারি-৬১ পর্যন্ত আলুর মোট ১৫টি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন বারির বিজ্ঞানীরা। উদ্ভাবিত জাতগুলো থেকে বর্তমানে দেশের ৭৫ শতাংশ আলু উৎপাদিত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পটেটো এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিইএ) সভাপতি ড. শেখ আবদুল কাদের বলেন, আলু রফতানি গতিশীল করতে আধুনিক রফতানি উপযোগী জাতের প্রবর্তন জরুরি। পাশাপাশি রফতানিকৃত আলুর উজ্জ্বল এবং চাকচিক্যময় হলুদ চামড়ার আলুর প্রয়োজন। উৎপাদিত আলু লম্বা আকৃতির হয়, যা মূল্য সংযোজনে সহায়ক হয়। তিনি আরও বলেন, আলু উৎপাদন বাড়লেই হবে না, বড় আকারের এবং বেশি পরিমাণ রফতানি উপযোগী আলু উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। জানা গেছে, দানা শস্যের তুলনায় আলু উৎপাদন দেশে সাড়ে ৪ গুণ বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। এ কারণে অনেক এলাকা এখন আলু চাষে এমনভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে, যেখানে আলুর চাষ বাদ দিলে দেশ থেকে বাৎসরিক একটি ফসলের আবাদই বাদ পড়ে যাবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ কারণে ওই এলাকার কৃষকরা আলু চাষ থেকে সরে আসতে নারাজ। ফলে দেশে প্রতি বছর আলু উৎপাদন বা পটেটো গ্যাট সৃষ্টি হচ্ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় আলু রফতানি গতি বৃদ্ধিই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমানে বিশ্বের ২৬টির বেশি দেশে কমবেশি আলু রফতানি হচ্ছে। বছর দুই হয় রাশিয়ায় আলু রফতানি শুরু হয়েছে। পাশের দেশ ভারতও সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে আলু আমদানির বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.