গভীর রাজনৈতিক সংকটে প্রোথিত বাংলাদেশের সহিংসতা

বাংলাদেশে ধর্মীয় সহিংসতার সাম্প্রতিক পর্বে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় দেশটির চ্যালেঞ্জগুলো ফুটে উঠছে। এসব ঘটনা এ দেশটির সবচেয়ে গভীরতম রাজনৈতিক সংকটের প্রতিনিধিত্ব করে। মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনবিসি’র এক বিশ্লেষণে এসব বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে লেখক, অ্যাক্টিভিস্ট, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, এলজিবিটি সমপ্রদায়ের ওপর নৃশংস হামলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। গত সপ্তাহেও খ্রিষ্টান এক দোকানি, এক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী ও এক হিন্দু পুরোহিতকে আলাদাভাবে হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছে ছুরি, বন্দুক ও চাপাতি। মে মাসের শুরুর দিকে নিহতদের মধ্যে একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও দুই সমকামী ব্যক্তি রয়েছেন। এর আগের মাসে যাদের টার্গেট করা হয়, তারা হলেন এক উদারপন্থি ব্লগার ও স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির এক অধ্যাপক। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারির পর থেকে ৩০শে জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
ইসলামিক স্টেট (আইএস) ও আল-কায়েদা ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট (একিউআইএস) কিছু হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসক দল আওয়ামী লীগ এ ধরনের আন্তদেশীয় জঙ্গিগোষ্ঠীর উপস্থিতি বাংলাদেশে থাকার কথা অস্বীকার করে আসছে। বরং, সরকার বিরোধী দল বিএনপি ও স্থানীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) ও জামায়াত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশকে (জেএমবি) দায়ী করে আসছে।
বিশ্লেষণীতে বলা হয়, আওয়ামী লীগ একটি সেক্যুলার রাজনৈতিক দল। দলটিকে ব্যবসাপন্থি বলে ভাবা হয়। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রেখে চলে দলটি। অপরদিকে বিএনপির মূল অনেকটা প্রোথিত ইসলামে। এ ছাড়া সবচেয়ে বড় ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামীকে (বিজেআই) নিজেদের জোটমিত্র ভাবে দলটি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ডের দায়ে জামায়াতের বেশ ক’জন শীর্ষ নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
কর্মকর্তারা এখনও নিশ্চিত করতে পারছেন না, কারা এ হামলা ঘটাচ্ছে। বুধবার, নিউ ইয়র্ক টাইমস জানায়, কর্তৃপক্ষ এসব হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন দুটি গোষ্ঠীর নেতৃত্বকে চিহ্নিত করতে পেরেছে। দেশটির জটিল সন্ত্রাসবাদী চিত্র হলো একটি চ্যালেঞ্জ। প্রতিষ্ঠিত দেশীয় নেটওয়ার্ক সম্ভবত ছোট ছোট ইউনিটে বিকেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। ফলে কর্তৃপক্ষ এ ধরনের সংগঠনকে চিহ্নিত করতে পারছে না। এ ব্যাখ্যা দিলেন রাজনৈতিক পরামর্শদাতা সংস্থা কন্ট্রোল রিস্কের দক্ষিণ এশিয়া অ্যানালিস্ট রমিতা দাস।
দেশের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর ভিত্তি করে প্রণীত। কিন্তু ইসলাম হলো রাষ্ট্রীয় ধর্ম। এ স্ববিরোধিতার কারণে কমিটি অ্যাগেইন্সট অটোক্রেসি অ্যান্ড কমিউনালিজম নামে বুদ্ধিজীবীদের একটি দল ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সংবিধান থেকে প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়ে পিটিশন করেন। এ বছরের মার্চে কোনো শুনানি ব্যতিরেকেই ওই আবেদন প্রত্যাহার করে উচ্চ আদালত।
তোপের মুখে সরকার
চলমান সন্ত্রাসবাদের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে সরকারের অব্যবস্থাপনা কাজ করছে- এমন উপসংহারে বেশি করে পৌঁছতে শুরু করেছেন বিশ্লেষকরা। সামপ্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে সরকার। ফলে নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যা উগ্রপন্থি দলগুলো ভরাট করতে চায়, বললেন রমিতা দাস।
এ সপ্তাহের এক প্রতিবেদনে বেসরকারি গোয়েন্দা ফার্ম স্ট্রাটফোর বলেছে, ‘দেশে ইসলামিক স্টেটের কোনো ধরনের উপস্থিতির কথা দৃঢ়চিত্তে অস্বীকার করেছেন শেখ হাসিনা। এর অন্যতম কারণ হয়তো এই যে, তিনি বিদেশি বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে চান। বিশেষ করে গার্মেন্ট উৎপাদন খাতে, যেটি চীনের পরে বিশ্বের মধ্যে সর্ববৃহৎ। এ খাত থেকেই দেশটির রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ অর্জিত হয়।’
স্ট্রাটফোর আরো লিখেছে, হত্যাকাণ্ডের জন্য বিএনপি ও বিজেআইকে দায়ী করে, ৬৮ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তা বৃদ্ধির অজুহাতে এ দুটি দলকে আরো বিচ্ছিন্ন করার অজুহাত পেয়ে যাবেন। আওয়ামী লীগের শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রগতি হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি, ঋণ ও দারিদ্র্য মাত্রা কমেছে। তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো দীর্ঘদিন ধরে তার সরকারের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম ও সামগ্রিক মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর চড়াও হওয়ার অভিযোগ তুলে সমালোচনা করে আসছে। এ বছরের গোড়ার দিকে এক প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেন, ‘ব্লগাররা যখন খুন হচ্ছে, তখন সরকার সেলফ সেন্সরশিপের দীক্ষা দিচ্ছে কেবল! এটা হতাশাজনক।’ তিনি বর্তমান প্রশাসনকে কর্তৃত্ববাদী বলেও আখ্যা দেন।
এ বছর দেশের বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির অভিযোগ আনা হয়েছে। অপরদিকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন আছে বলায় বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়েছে।
স্ট্রাটফোর ও কন্ট্রোল রিস্ক- উভয়েই একটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছে। তারা বলছে, বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে এতটাই বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে যে, তারা সরকারের কঠোর শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজপথে বা হরতালের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতে পারছে না।
স্ট্রাটফোর মন্তব্য করেছে, ‘হাসিনা রাজনৈতিক হিসাব কষেছেন যে, যদি তিনি কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি দারিদ্র্য হ্রাস, স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধি ও দেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ ধরে রাখতে পারেন, তাহলে মানুষ তার একদলীয় শাসনের দিকে অত ভ্রূক্ষেপ করবে না এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করবে।’
প্রভাব পড়বে আরো বেশি
মুডি’স ইনভেস্টর সার্ভিস জানিয়েছে, এখন চলমান সহিংস পর্ব বিচ্ছিন্ন থাকবে। কিন্তু এসব যদি মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ে, তবে দেশটির ‘বিএ৩’ ক্রেডিট রেটিংয়ে এসবের প্রভাব পড়তে পারে। সংস্থাটির স্বাধীন রিস্ক অ্যানালিস্ট আনুশকা শাহ বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে দেশটির জন্য উচ্চমাত্রার রাজনৈতিক ঝুঁকির বিষয়টি উল্লেখ করেছি। কারণ, দেশটির স্থানীয় রাজনীতিতে মেরুকরণ খুবই বেশি।’
সন্ত্রাসবাদ-সম্পর্কিত সহিংসতা ছাড়াও, আরো কিছু নিম্নগামী ঝুঁকিও যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের রেটিংয়ের পাশে। যেমন, রেমিট্যান্স বা রপ্তানি ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া ও ব্যাংকিং সিস্টেমে শর্তসাপেক্ষ দায়বদ্ধতা।
ফিচ রেটিংসের সভেরেইন্স অ্যান্ড সুপারন্যাশনালসের পরিচালক থমাস রুকমাকের বলেন, ‘বাংলাদেশের সহিংসতা সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি যদি রেটিংয়ের দিক থেকে বিবেচনা করা হয়, তবে তা হলো, সেখানকার নিরাপত্তা ইস্যু বিদেশিদের দেশটিতে ব্যবসা করতে নিরুৎসাহিত করবে। বিশেষ করে, যদি বিনিয়োগকারী ও ক্রেতারা তৈরি পোশাক খাতে তাদের ব্যবসা এই অঞ্চলের অন্য দেশে সরিয়ে নিয়ে যায়, তবে তা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বয়ে আনবে। তবে এ ঝুঁকি এখনও দানা বেঁধেছে বলে আমরা দেখিনি।’

No comments

Powered by Blogger.