অন্যায় মামলা থেকে অব্যাহতি দিন by সৈয়দ জিয়াউর রহ্‌মান

যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে একটি প্রখ্যাত দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক আমার এক বন্ধুর একটি প্রশ্নের আমি সদুত্তর দিতে পারিনি। তাঁর প্রশ্ন ছিল—বাংলাদেশে যে কেউ যে কারও বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করতে পারে কি না। আমার এই সাংবাদিক বন্ধু বেশ কয়েকবার ভারত-বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং তিনি প্রায়ই ইন্টারনেটে ভারত-বাংলাদেশের খবরাখবর পড়ে থাকেন। তিনি ঢাকার ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে দায়ের করা বেশ কিছু রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা প্রসঙ্গে এই প্রশ্ন করেন। আমি আইন বিশেষজ্ঞ নই, তবে এখানকার কয়েকজন আইনবিশারদের কাছে শুনেছি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে; সাধারণ নাগরিকেরা রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, ১০ বছর আগের কোনো সরকারের নির্দেশ পালনের দায়ে পরবর্তীকালের কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো সাংবাদিককে অভিযুক্ত করতে পারে না।
আমেরিকায় প্রায় প্রতিদিনই প্রশাসনের বিরুদ্ধে, এমনকি প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের খবরাখবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় এবং সেগুলোর কোনোটিতে কোনো ভুল তথ্য থাকলে প্রশাসনের কিংবা প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। পরে এই প্রতিবাদ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এর জন্য সম্পাদকের বিরুদ্ধে মানহানির কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয় না।
ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম ঢাকার একটি টেলিভিশনের এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, এক-এগারোর সময় দেশের অন্য সব পত্রপত্রিকার মতো তাঁর পত্রিকায়ও তিনি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া কিছু সংবাদ ছাপাতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই সংবাদ ছিল আওয়ামী লীগের নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ–সংক্রান্ত। মাহ্ফুজ আনাম ওই টেলিভিশন অনুষ্ঠানে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, রাষ্ট্রীয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া সেদিনকার সেই সংবাদ যাচাই না করে ছাপানোটা তাঁর ভুল হয়েছিল।
পরদিনই প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় মাহ্ফুজ আনামকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে কারাগারে পাঠানোর দাবি জানান। তারপরই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আওয়ামী লীগ ও তার ছাত্রসংগঠনের নেতারা উৎসাহিত হয়ে একের পর এক মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে চলেছেন। এই সংখ্যা ৭৮–এ পৌঁছেছে বলে এখন পর্যন্ত জানা যাচ্ছে। জাতীয় সংসদেও কয়েকজন সাংসদ দাবি জানিয়েছেন মাহ্ফুজ আনামকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানোর।
এক-এগারোর সময় ওই সংবাদ প্রকাশে বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশের প্রায় সব সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন। কেবল দৈনিক নিউ এজ পত্রিকায় এই সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। ডেইলি স্টার ছাড়া আর যেসব পত্রপত্রিকায় এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ওই সংবাদ প্রকাশিত হয়, তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো মামলা করেনি। তা ছাড়া, তখনকার রাষ্ট্রীয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার যেসব কর্মকর্তা সংবাদপত্রে ও টেলিভিশনে ওই সংবাদ প্রকাশে বাধ্য করেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও কোনো অভিযোগ নেই।
রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পাঠানো সংবাদ যাচাই না করে ছাপার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে মাহ্ফুজ আনাম বিরল সাংবাদিক সততার পরিচয় দিয়েছেন। যাচাই না করে সংবাদ ছাপানো ভুল হয়েছিল বলে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তাতে তাঁর অনন্য পেশাগত মূল্যবোধের পরিচয় পাওয়া গেছে। এর জন্য মাহ্ফুজ আনাম জাতির কাছে প্রশংসিত হওয়ার দাবি রাখেন, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার নয়।
মাহ্ফুজ আমার অনুজ প্রতিম। তাঁর বড় ভাই ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস-এর সম্পাদক প্রয়াত মহ্বুব আনাম ছিলেন আমার সহপাঠী ও বন্ধু। সেই সুবাদে আমি মাহ্ফুজ আনামকে দীর্ঘকাল ধরে জানি। শুধু সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও মাহ্ফুজ অত্যন্ত সজ্জন এবং পরিশীলিত। মাহ্ফুজ আমাদের কনিষ্ঠ হলেও সততা ও সাহসিকতার ক্ষেত্রে তাঁর কাছে আমাদের মতো বর্ষীয়ান সাংবাদিকদেরও শেখার আছে। মাহ্ফুজের বাবা প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও পঞ্চাশ-ষাটের দশকের আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা প্রয়াত আবুল মনসুর আহমদ তাঁর আত্মজীবনীতে একটি পারিবারিক মানবিক ঘটনার উল্লেখ করে লিখেছেন, তাঁর এই ছেলের কাছে তাঁদের অনেক কিছু শেখার আছে। মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে মানহানির আর রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় উৎসাহিত হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের উচিত হবে মাহ্ফুজের সাংবাদিক সততার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে মামলা প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে নিজেদের ভুল সংশোধন করা। তাঁদের উচিত হবে যাচাই না করে সংবাদ প্রকাশ ভুল ছিল বলে মাহ্ফুজ যে মন্তব্য করেছেন, তার জন্য তাঁকে দলের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানো। মাহ্ফুজ আনামের এই স্বীকারোক্তির অর্থ হচ্ছে এসব সংবাদের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তিনি যদি তা স্বীকার না করতেন তবে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া ওই সব তথ্য সঠিক ছিল বলেই অনেকের ধারণা হতো।
তা ছাড়া, দেশের একজন বিশিষ্ট সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অন্যায় ও নীতিবর্জিত মামলা-অভিযোগ দায়েরের ফলে গণতান্ত্রিক বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকছে। বাংলাদেশে আশির দশকে জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালে তখনকার আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ২০-২৫টি সাক্ষাৎকার আমি প্রচার করেছি ভয়েস অব আমেরিকায়। ওই সব সাক্ষাৎকারে গণমাধ্যমের ওপর এরশাদের দমননীতির বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন তাঁরা। জেনারেল এরশাদের ক্ষমতার শেষভাগে দেশব্যাপী তুমুল বিক্ষোভ-আন্দোলনের সময় বিবিসির ঢাকা সংবাদদাতা আতাউস সামাদ এবং আরও কয়েকজন সাংবাদিককে ‘মিথ্যা খবর’ পরিবেশনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিনই আমি এ নিয়ে আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনার একটি সাক্ষাৎকার নিই। ভয়েস অব আমেরিকায় প্রচারিত ওই সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, ‘সাংবাদিকেরা জাতির বিবেক, তাঁদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন দেশের মানুষ মেনে নিতে পারে না।’ আওয়ামী লীগপ্রধান আরও বলেছিলেন, ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীন দেশ আমরা অর্জন করেছি, সেখানে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন কোনোমতেই সহ্য করা হবে না।’
তখনকার আওয়ামী লীগ নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই বক্তব্যের সূত্র ধরে প্রত্যাশা করছি, তিনি সৎ ও নির্ভীক সাংবাদিক মাহ্ফুজ আনামকে সত্বর এসব অন্যায় ও নৈতিকতাবিরোধী মামলা-অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ব্যবস্থা নেবেন।
সৈয়দ জিয়াউর রহ্মান: লেখক, সাংবাদিক ও ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র এডিটর।

No comments

Powered by Blogger.