বিষক্রিয়া নয় হত্যা

ফুটফুটে নিষ্পাপ দুটি শিশু। ভাইবোন। নুসরাত আমান অরনি (১২) ও আলভী আমান (৬)। সোমবার বিকালে হঠাৎ না ফেরার দেশে চলে গেছে। প্রথমে খাদ্যের বিষক্রিয়ায় তাদের মৃত্যু বলে জানানো হয়েছিল। তবে তাদের ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে পাওয়া গেছে ভিন্ন তথ্য। বিষক্রিয়া নয়, তাদের হত্যা করা হয়েছে। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাশের ময়নাতদন্ত শেষে চিকিৎসকরা জানান, উভয়ের শরীরে আঘাতের চিহ্নও পাওয়া গেছে। শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হতে পারে তাদের। মর্মান্তিক এ ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটনে মাঠে নেমেছে একাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। 
ঢামেকের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ মানবজমিনকে বলেন, প্রাথমিকভাবে শিশু দুটিকে হত্যা করা হয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন। দুই ভাইবোনের শরীরে আঘাতের চিহ্ন আছে। গলায়ও আঘাতের ছাপ পাওয়া গেছে। নখের আঁচড় রয়েছে তাদের শরীরে। দুটি শিশু জিহ্বা কামড়রত অবস্থায় ছিল। তাছাড়া, দুটি শিশুর চোখেও রক্ত জমাট বাঁধা অবস্থায় ছিল। ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়া গেলে চূড়ান্ত মতামত দেয়া যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
স্থানীয়রা জানায়, অরনি ও আলভীকে নিয়ে তাদের বাবা আমান উল্লাহ ও মা মাহফুজা মালেক জেসমিন রাজধানীর রামপুরার বনশ্রীর বি-ব্লকের ৪ নম্বর সড়কের ৯ নং বাসার পঞ্চম তলার ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন। এ দম্পতির আর কোনো সন্তান ছিল না। তাদের সঙ্গে আমানের প্রায় সত্তর বছর বয়সী মাও থাকেন। অরনি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণির ঙ শাখায় পড়তো। তার ক্রমিক নম্বর ছিল ৩৪। আর তার ছোট ভাই আলভী হলি ক্রিসেন্ট স্কুলে নার্সারিতে পড়তো। গত সোমবার বিকালে অরনি স্কুল থেকে বাসায় আসে। তখন তাদের বাসায় একজন মহিলা মেহমানও ছিল। বিকাল ৩টার দিকে বাসায় আসে অরনির গৃহশিক্ষক শিউলি আকতার।
তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমি গত ৮ই ফেব্রুয়ারি থেকে অরনিকে অঙ্ক, বিজ্ঞান ও সমাজ পড়াই। আজ (গতকাল মঙ্গলবার) বিকাল ৩টায় একই সময় বাসায় তাকে পড়াতে এসে দেখি বাড়ির সামনে জটলা। কারণ জানতে চাইলে স্থানীয়রা জানান পঞ্চম তলায় দুটি শিশু মারা গেছে। আমি মনে করেছি অন্য ফ্ল্যাটে হয়তো এমনটা ঘটেছে। উপরে উঠে অরনি ও আলভীর মৃত্যুর খবর জানতে পাই। বুঝতে পারছি না কীভাবে তা হলো?
আগের দিন সোমবারের বর্ণনা দিতে গিয়ে শিউলি আক্তার বলেন, আমি যথারীতি তিনটার দিকে বাসায় এসেছিলাম। তখন অরনির মা শুয়ে ছিলেন। অরনির লুকিয়ে রাখা টেলিভিশনের রিমোটটি ভাইকে দিয়ে তাকে পড়তে বসতে বলেন। গত রোববার তাদের বিবাহবার্ষিকী উদ্‌যাপন করার কারণে পড়া শেষ করতে না পারার জন্য অরনিকে না বকতেও বলে দেন। আসার পর বাসায় একজন মহিলা মেহমানকে নামাজ পড়তে দেখি। তাদের পড়িয়ে বিকাল সোয়া চারটার দিকে আমি চলে যাই। আমার পর বিকালে অরনিকে অন্য এক গৃহশিক্ষক ইংরেজি পড়াতেন।
আমানের বন্ধু মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, আমান গার্মেন্টস সংক্রান্ত ব্যবসা করে। গত সোমবার রাতে জানতে পারি যে আমান ঘটনার সময় উত্তরায় ব্যবসার কাজে ব্যস্ত ছিল। সে বাসা থেকে ফোন পেয়ে তার দুই সন্তানের খারাপ খবর শুনতে পায়। জাহিদ নামে আমাদের অপর এক বন্ধু একই এলাকায় কয়েকটি ভবন দূরত্বে থাকে। তাকে সে বলে বাসা থেকে অরনি ও আলভীকে হাসপাতালে নিতে। এরপর জাহিদ তাদের হাসপাতালে নেয়। পরে রাতে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দু’শিশুর মারা যাওয়ার খবর জানতে পারি।
আমানের বাড়ি জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানার উলিয়াবাহার এলাকার রায়েরপাড়ায়। তার পিতার নাম মৃত আবদুর রহিম সরকার। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে অরনি ও আলভীর লাশ নিয়ে তার ভাই আবুল হোসেন গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা দেন। তার আগেই সকালে আমান, তার স্ত্রী জেসমিন, আমানের বৃদ্ধা মা ও অপর এক আত্মীয় জামালপুরের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। দু’শিশুর চাচা আবুল হোসেন গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মানবজমিনকে বলেন, লাশবাহী গাড়িটি এখন মাঝপথে। জালালপুরে পৌঁছার পর জানাজা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে লাশ দাফন করা হবে।
বাসায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে অরনি-আলভীর স্মৃতি: গতকাল দুপুরে বাসায় গিয়ে দেখা যায় উৎসুক এলাকাবাসী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড়। ফ্ল্যাটে আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। রয়েছেন বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক মো. আব্দুল কাদিরসহ ওই বাসার কয়েকজন লোক। বাসার খাট, টেবিল ও ওয়ারড্রপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অরনির আঁকা ছবি, বইপত্র, ব্যাগ ইত্যাদি। আলভীর খেলনা পুতুল, গাড়িসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র। কিন্তু নেই কেবল এই দুই শিশু।
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চারজনকে আটক: এ ঘটনায় র‌্যাব পিন্টুসহ বাসার ২ দারোয়ান, অরনির গৃহশিক্ষক শিউলী আক্তার এবং অপর এক আত্মীয়কে ওই বাসা থেকে আটক করেছে। গ্রেপ্তার নয়, শুধু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের র‌্যাব-৩ এর কার্যালয়ে নেয়া হয়েছে বলে জানায় র‌্যাব।
র‌্যাব-৩ এর কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মোস্তাক আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, গত সোমবার পর্যন্ত এই ঘটনাকে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু বলে জানা গিয়েছিল। মঙ্গলবার জানা গেল হত্যার শিকার হয়েছে দু’শিশু। ফলে এখন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ঘটনার অনুসন্ধান ও তদন্ত হচ্ছে। রহস্য উদ্‌ঘাটনের চেষ্টা চলছে। এখন পারিবারিক দ্বন্দ্ব, বাসায় বাইরের কারও অনুপ্রবেশ ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো কারণ রয়েছে কিনা তা মাথায় রেখে তদন্ত করা হচ্ছে।
এদিকে নুসরাত জাহান অরনি (১৪) ও আলভী আমানকে (৬) হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে ধারণা করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা। দু’টি লাশ ময়নাতদন্ত শেষে তারা এই তথ্য জানিয়েছেন। তবে ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়া গেলে চূড়ান্ত মতামত দেয়া যাবে বলে তারা উল্লেখ করেন। আর এ জন্য এক থেকে দেড় মাস অপেক্ষা করতে হবে। ভিসেরা রিপোর্টের জন্য নমুনা ইতিমধ্যেই মহাখালীর প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে ঢামেকের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়া গেলে চূড়ান্ত মতামত দেয়া যাবে। এ বিষয়ে জানার জন্য ফোন করা হলে আমান ও জেসমিনের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

No comments

Powered by Blogger.