বেতন বৈষম্য নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ জরুরি by মো. মোতাহার আলী

দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নতুন বেতন স্কেল কার্যকর হলেও তা প্রজাতন্ত্রের প্রায় ২৩ লাখ কর্মচারীকে হতাশায় নিমজ্জিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের একটি সম্মানজনক বেতন স্কেল উপহার দেয়ার বিষয়ে আন্তরিক থাকলেও প্রশাসনের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা একটি দুষ্টচক্রের কারণে তা আজ হতাশায় রূপ নিয়েছে।
নতুন বেতন স্কেল বাস্তবায়নকারী ও ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, নতুন বেতন স্কেল প্রবর্তনের কারণে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেয়ে ক্ষতির মুখোমুখি আজ লাখ লাখ সরকারি কর্মচারী। নতুন বেতন স্কেলে ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ থেকে ৩০ জুন, ২০১৬ পর্যন্ত বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি প্রথা বাতিল করা হয়। যে কারণে প্রজাতন্ত্রের প্রায় অর্ধেক সমপদের জ্যেষ্ঠ কর্মচারী তাদের কনিষ্ঠ কর্মচারীদের চেয়ে কম বেতন পাচ্ছেন। তা ছাড়া প্রচলিত বিধান অনুযায়ী একই পঞ্জিকা বর্ষে সমমানের পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত অভ্যন্তরীণ কর্মচারীরা সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের তুলনায় জ্যেষ্ঠতাপ্রাপ্ত হন। নতুন বেতন স্কেলে ১৫ ডিসেম্বর থেকে সিলেকশন গ্রেড প্রথা বাতিল করার কারণে ১৩ ডিসেম্বর, ২০১১ তারিখে ৯ম গ্রেডের পদে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীর চেয়ে ১৫ ডিসেম্বর তারিখে ৯ম গ্রেডের পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ কর্মচারী নিু গ্রেডে কম বেতন পাচ্ছেন। অভিজ্ঞ মহলের মতে, কম বেতন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়মে ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত কনিষ্ঠ কর্মচারীর বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির তারিখে জ্যেষ্ঠ কর্মচারীর বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির তারিখ নির্ধারণ করে কনিষ্ঠ ও জ্যেষ্ঠ কর্মচারীর বেতন সমতাকরণ করে এবং নিু গ্রেডে বেতন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে, কনিষ্ঠ কর্মচারীর বেতন গ্রেডের সঙ্গে জ্যেষ্ঠ কর্মচারীর বেতন গ্রেডের সমতাকরণ করে এ সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, ৯ম গ্রেডের পদে দুইজন কর্মচারী ২০০৫ সালে নিয়োগলাভ করেন এবং উভয় কর্মচারী ৪ (চার) বছর সন্তোষজনক চাকরি পূর্তিতে ২০০৯ সালে ৭ম গ্রেডে সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত হন। দুইজনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ কর্মচারী যোগ্যতার ভিত্তিতে ২০১৪ সালে ৭ম গ্রেডের পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন। অর্থাৎ পদোন্নতিপ্রাপ্ত এবং যিনি পদোন্নতিপ্রাপ্ত হননি উভয়ই ৭ম গ্রেডে বেতন পাচ্ছিলেন। জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী যে কর্মচারী পদোন্নতিপ্রাপ্ত হননি তিনি ১০ বছর সন্তোষজনক চাকরি পূতির্তে ১ জুলাই ২০১৫ তারিখে ৬ষ্ঠ গ্রেডে টাকা ৩৫,৫০০-৬৭,০১০ স্কেলে বেতন পাচ্ছেন, অপরদিকে পদোন্নতিপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ কর্মচারী এক গ্রেড নিচে ৭ম গ্রেডে টাকা ২৯,০০০-৬৩,৪১০ স্কেলে বেতন পাচ্ছেন। অভিজ্ঞ মহলের মতে, জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫-এর ৭(১) অনুচ্ছেদে ‘কোনো স্থায়ী কর্মচারী তাদের নিজ বেতন গ্রেডে ৬ বছর সন্তোষজনক চাকরি পূর্তির পরবর্তী তারিখে অথবা, নিজ বেতন গ্রেডের সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছার পরবর্তী তারিখে স্বয়ংক্রিভাবে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেডে বেতন প্রাপ্য হবেন’- এ সংক্রান্ত সংশোধনী এনে এ সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।
জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫ জারির পূর্ব পর্যন্ত ৪র্থ গ্রেডের কর্মচারীরা নিজ পদের বেতন স্কেলের সর্বশেষ ধাপে পৌঁছানোর এক বছর পর ৩য় বেতন গ্রেডপ্রাপ্ত হতেন। এতে দীর্ঘদিন পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মচারীদের একটু আর্থিক ক্ষতি লাঘব হতো। জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫-এর মাধ্যমে পদোন্নতিবঞ্চিত ৫ম ও ৪র্থ গ্রেডের কর্মচারীদের ৩য় বেতন গ্রেডে বেতনপ্রাপ্তির সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫-এর ৭(৩) অনুচ্ছেদে ‘উপ-অনুচ্ছেদ (১) ও (২)-এ উল্লিখিত আর্থিক সুবিধা বেতন স্কেলের ২য় গ্রেড বা তদূর্ধ্ব গ্রেডের কোনো কর্মচারী এই সুবিধা গ্রহণপূর্বক ১ম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব বিশেষ গ্রেডে বেতন প্রাপ্য হইবেন না’- এ সংক্রান্ত সংশোধনী এনে এ সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। ফলে প্রকৃচি সমন্বয় পরিষদ ও নন-ক্যাডার কর্মচারী ঐক্য পরিষদের অন্যতম দাবি পূরণ হবে, উচ্চতর স্তরের পদ সৃষ্টি করতে হবে না এবং স্থায়ী সংস্থাপন ব্যয় হ্রাস পাবে।
একই ধরনের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও নতুন বেতন স্কেলে ৯ম গ্রেডের নন-ক্যাডার ও ক্যাডার কর্মচারীদের প্রবেশ পদে যথাক্রমে ৯ম ও ৮ম গ্রেডে বেতন নির্ধারণে বড় বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। এতে প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে চরম হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বৈষম্যহীন সম্মানজনক বেতন স্কেল নীতির কারণে ১ম শ্রেণী, ২য় শ্রেণী, ৩য় শ্রেণী ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী পরিচয় প্রথা বিলোপ করে গ্রেডভিত্তিক কর্মচারী পরিচয়দানের প্রথা প্রবর্তন করা হলেও এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর বৈষম্যহীন সম্মানজনক বেতন স্কেল প্রদানের নীতির প্রতিফলন ঘটেনি। অভিজ্ঞ মহলের মতে ‘ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মচারীদের প্রবেশ পদ জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫-এর ৮ম গ্রেডে নির্ধারিত হবে’- এ সংক্রান্ত সংশোধনী এনে এ সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।
বৈষম্যমূলক প্রশাসন দিয়ে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। তাই আলোচ্য বৈষম্যসমূহ নিরসনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
মো. মোতাহার আলী : সরকারি চাকরিজীবী

No comments

Powered by Blogger.