টিপুর স্বপ্ন ও ‘অসহিষ্ণু’ ভারত by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

পুনেতে ‘বসন্ত ব্যাখ্যানমালা’ নামে বক্তৃতামালায়
উগ্রহিন্দুত্ববাদী বীরসাভারকারের পৌত্র শ্রী বিক্রম
সাভারকার বলেছে, “প্রত্যেক হিন্দুর জীবনকালে
অন্ততঃ একজন মুসলমানকে হত্যা করা উচিত।
সে দুঃখের সঙ্গে আরো বলেছে, তার এখনও একজন
মুসলমানকে স্বহস্তে হত্যা করে উঠা সম্ভব হয়নি। তবে
তার বিশ্বাস যে, তার ভাষণ থেকে অপর হিন্দুরা
উৎসাহ লাভ করবে। তথ্যসূত্রঃ- সুধন্য দেশপান্ডে,
ক্যানিবল টাইম, সিগনাল থিয়েটার কোয়ার্টারলি পত্রিকা
ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে টিপু সুলতানের জন্মজয়ন্তী পালন নিয়ে যখন বিতর্ক-বিরোধ ও সংঘর্ষ চলছে, ঠিক সে সময়টাতে চট্টগ্রামের একটি মিলনায়তনে বসে টিপুর স্বপ্ন নাটকটি দেখলাম। ব্যাপারটি কাকতালীয় কি না জানি না, তবে এটি যে অত্যন্ত সময়োপযোগী একটি প্রযোজনা, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পশ্চিমবঙ্গের নাট্যদল ‘প্রাচ্য’ এই নাটক নিয়ে এসেছিল বাংলাদেশে। খ্যাতিমান নাট্যকার ও অভিনেতা গিরিশ কার্নাডের লেখা নাটকটির বাংলা রূপান্তর মঞ্চস্থ করেছে তারা এ দেশের দর্শকদের সামনে।
অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে মহীশুরের অধিপতি ছিলেন টিপু সুলতান। ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করেছেন তিনি আজীবন। ইংরেজদের হাত থেকে ভারতকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাই ‘জাতীয় বীর’ আখ্যা দিয়ে তাঁর জন্মজয়ন্তী পালন করার উদ্যোগ নিয়েছিল কর্ণাটক রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল কংক্রেস। কিন্তু টিপু একজন মুসলিম শাসক, তাঁর রাজত্বকালে হিন্দু ও খ্রিষ্টানদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিলেন তিনি—এ ধরনের কিছু বিতর্ক তুলে ওই রাজ্যের বিরোধী দল বিজেপি ও কট্টর হিন্দুত্ববাদী দলগুলো এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছে। বিরোধিতা শুধু বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এমনই সহিংসতার রূপ নিয়েছিল যে দশ জনেরও বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটেছে সেখানে। শেষ পর্যন্ত টিপুর জন্মদিন পালন করা যাবে কি না, এই বিতর্ক হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে পরে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করা গেছে টিপু সুলতানের জন্মদিনের উৎসব।
একজন বিজেপি নেতা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘মৃত্যুর ২১৬ বছর পর কেন আচমকা কংগ্রেসের টিপুকে মনে পড়ল?’ আপাতদৃষ্টিতে এ প্রশ্নকে যুক্তিযুক্ত মনে হতে পারে। কিন্তু ইতিহাস এমনই এক বিষয়, যা বর্তমানের কোনো প্রসঙ্গের হাত ধরে অতীত থেকে ফিরে আসে। যেমন ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর নাম, তাঁর অন্তর্ধান–রহস্য নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা এখনো প্রাসঙ্গিক। প্রকৃত ইতিহাস জানার আগ্রহ ও কৌতূহল মানুষের মনে জাগরূক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। চিন্তাশীল ও অগ্রসর মানুষেরা বর্তমানের বিভ্রান্তি দূর করার জন্য অতীত খুঁড়ে প্রকৃত সত্যকে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন চিরকাল।
১৯৯২-৯৩ সালে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ
ধ্বংসের পর শহরে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা বাধে
সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে তাদের জোটসঙ্গী উগ্র হিন্দুত্ববাদী দলগুলো ভিন্ন সম্প্রদায় ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর যেভাবে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে, তাতে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দাবিদার ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবমূর্তি রীতিমতো প্রশ্নের সম্মুখীন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বারবার সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি না করার আহ্বান জানাচ্ছেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এসব ব্যাপারে তাঁর অবস্থান যথেষ্ট স্পষ্ট নয় বলেই প্রশ্রয় পাচ্ছে কট্টরপন্থীরা। গত সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের উত্তর প্রদেশের দাদরি গ্রামে ফ্রিজে গরুর মাংস রাখার গুজব রটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ইখলাক নামের এক ব্যক্তিকে। এই ঘটনায় প্রথম দিকে স্তম্ভিত হয়ে পড়লেও একপর্যায়ে ক্ষোভে-প্রতিবাদে ফেটে পড়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ।
সত্যের সন্ধান ও শুভ মানবিকতা যে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার উদ্যত তলোয়ারের চেয়েও ধারালো হয়ে উঠতে পারে টিপুর স্বপ্ন দেখে সে কথাই মনে হচ্ছিল আমাদের এর কয়েক দিন আগে ৩০ আগস্ট সাহিত্য আকােদমি পুরস্কারজয়ী যুক্তিবাদী লেখক এস এম কুলবার্গ খুন হয়েছেন তাঁর নিজের বাড়ির কাছে। গত দুই বছরে আরও দুজন যুক্তিবাদী লেখক গোবিন্দ পানসার ও নরেন্দ্র দাভোলকরকে খুন করেছে কট্টরপন্থীরা। খুনখারাবির ঘটনায় উগ্রপন্থীরা দল ও গোষ্ঠীর নাম-পরিচয় প্রকাশ করছে না বটে, কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে শিবসেনাসহ সংঘ পরিবার যে ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে, তাতে সহিংস ঘটনায় কারা জড়িত, কাদের মদদ আছে, তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না।
গজলশিল্পী গুলাম আলী পাকিস্তানের নাগরিক হলেও ভারতে তিনি লাখ লাখ শ্রোতার কাছে আদৃত। এমনকি সেখানকার শিল্পীদের কাছেও তিনি আদর্শ। সেই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীকে মুম্বাইতে অনুষ্ঠান করতে দেয়নি শিবসেনা। সুর ও শিল্প যে সম্প্রদায়ের বিভক্তি, সীমানার গণ্ডি মানে না, এই ধর্মান্ধদের তা কে বোঝাবে? এসব অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন ভারতের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা। জওহরলাল নেহরুর নাতনি বিশিষ্ট লেখিকা নয়নতারা সেহগাল ভিন্নমতের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদে তাঁর সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর পথ অনুসরণ করেন ভারতের বিভিন্ন ভাষার আরও অন্তত ৪১ জন লেখক।
শাহরুখ খান, আমির খানের মতো ভারতের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নায়কেরাও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। আমির খান তাঁর স্ত্রীর উদ্বেগের কথা জানিয়ে হুমকির মুখে পড়েছেন। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাঁদের দেশ (ভারত) ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত কি না, এ কথা ভাবতে বলেছিলেন তাঁর স্ত্রী কিরণ রাও। এতে কট্টরপন্থীরা খেপে গেছে, তাঁকে দেশ ছেড়ে চলে যেতেও বলেছে। অথচ লাখ লাখ ভক্তের ভালোবাসায় সিক্ত মানুষটি কী বেদনায়, কী অভিমানে উদ্বেগের কথাটি প্রকাশ্যে বলতে বাধ্য হয়েছেন তা তারা ভেরে দেখল না।
সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দেওয়া ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশেও যুক্তিবাদী লেখক, ব্লগারদের হত্যা, মুক্তবুদ্ধির মানুষদের হত্যার হুমকি, খ্রিষ্টান ধর্মযাজককে হত্যার চেষ্টা, বিদেশি নাগরিক হত্যা, যাত্রাপালায় বোমা হামলাসহ বেশ কিছু ঘটনা যেন ভারতের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিরই প্রতিচ্ছবি। নাটকের বিষয়বস্তু একই, শুধু দুই দেশের কুশীলব ভিন্ন। ভারতের ‘সনাতন সংস্থা’ আর বাংলাদেশের ‘জেএমবির’ উদ্দেশ্য, আদর্শ ও চরিত্র তো একই। ভারতে হিন্দুত্ব রক্ষার নামে আর বাংলাদেশে ইসলাম রক্ষার নামে একই কায়দায় মধ্য যুগ ফিরিয়ে আনতে চায় ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো।
মুক্তচিন্তার বিকাশকে ধ্বংস করার জন্য ধর্মকে হাতিয়ার করার এই অপচেষ্টা চলছে যুগের পর যুগ। কিন্তু এ কথা তো সত্য হত্যা-আক্রমণ-হুমকি কোনো কিছুই বিশ্বের কোথাও জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতির চর্চাকে রুদ্ধ করতে পারেনি। বন্ধ রাখতে পারেনি ইতিহাসের অনুসন্ধান। টিপু সুলতান জাতীয় বীর, তাঁর বীরত্বের ইতিহাস জাতির কাছে তুলে ধরা হোক, তাঁর নামে মহীশুরের একটি বিমানবন্দরের নামকরণ করা হোক—ইত্যাদি প্রস্তাব দিয়ে হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন নাট্যকার-অভিনেতা গিরিশ কার্নাড। কিন্তু দমে যাননি তিনি। টিপুর স্বপ্ন নামে নাটক লিখে তিনি বলেছেন, ইংরেজদের ফরমায়েশি লেখকের ইতিহাসে টিপু সুলতানের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় না। তাঁকে হিন্দু ও খ্রিষ্টানবিদ্বেষী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে ব্রিটিশরা। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো টিপুর স্বপ্ন ছিল স্বাধীন অসাম্প্রদায়িক ভারত।
টিপু সুলতান সম্পর্কে যে কথা বলেছেন গিরিশ কার্নাড, সে কথারই প্রতিধ্বনি আমরা শুনি দাক্ষিণাত্যের ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শৌভিক মুখোপাধ্যায়ের বয়ানেও। তিনি বলছেন, ‘টিপুকে নিয়ে যাবতীয় গবেষণার মূল উৎস হলো সে আমলে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের রিপোর্ট। শত্রুর (টিপু) সম্বন্ধে তাঁরা যে খুব একটা ভালো কথা বলবেন না, তা তো বলাই বাহুল্য।’
টিপুর স্বপ্ন নাটকটি খুবই হৃদয়স্পর্শী। যুদ্ধে একবার ইংরেজদের পরাজিত ও বিতাড়িত করেছিলেন মহীশুর থেকে। কিন্তু পরেরবার নিজের মন্ত্রী, সেনাপতি, আমির, ওমরাহদের বিশ্বাসঘাতকতায় তাঁর পরাজয় ঘনিয়ে এল। ইংরেজরা হত্যা করল তাঁকে। বাংলায় রূপান্তরিত নাটকের শেষ দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে কবি তুষার রায়ের কবিতা উচ্চারিত হচ্ছে টিপু সুলতানের মুখে, ‘বিদায় বন্ধুগণ, গনগনে আঁচের মধ্যে শুয়ে/এই শিখার রুমাল নাড়া নিভে গেলে/ছাই ঘেঁটে দেখে নেবেন পাপ ছিল কি না।’ ইতিহাস-বিকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রকৃত সত্যের উন্মোচনে একজন সৃজনশীল মানুষ কত বড় ভূমিকা রাখতে পারেন, এ নাটক তার একটি উদাহরণ হয়ে রইল। সত্যের সন্ধান ও শুভ মানবিকতা যে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার উদ্যত তলোয়ারের চেয়েও ধারালো হয়ে উঠতে পারে টিপুর স্বপ্ন দেখে সে কথাই মনে হচ্ছিল আমাদের।
ভারতের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সাম্প্রতিক তৎপরতা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর আক্রমণের বিরুদ্ধে লেখক-শিল্পীসহ উদার মানবতাবাদীদের অবস্থান আমাদের জন্য শিক্ষার বিষয় হতে পারে। কেননা, প্রায় একই রকম সময় ও সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরাও।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.