কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে by এরিক বেইনহকার ও মাইলস অ্যালেন

জলবায়ু পরিবর্তনের রাশ টেনে ধরতে এক ঐতিহাসিক ঐকমত্যে পৌঁছেছে পৃথিবী। প্যারিসে শেষমেশ যা হলো, তাতে দেশগুলো প্রাক শিল্প যুগের তুলনায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশ নিচে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আর সেটাকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখার জন্য দেশগুলো নানা পদক্ষেপ নেবে, এমন প্রতিশ্রুতিও তারা দিয়েছে। এতে উন্নত দেশগুলোকে বাধ্য করা হয়েছে, তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার চাঁদা দেবে। কিন্তু চূড়ান্ত আলোচনায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে এক নম্বর বিষয়টিই বাদ পড়ে গেছে, নিঃসরণের হার বৃদ্ধি প্রাক শিল্প যুগের তুলনায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা।
পৃথিবী নামক গ্রহের তাপমাত্রা কোনো এক পর্যায়ে স্থিতিশীল রাখতে হলে আমাদের আর প্রাক শিল্প যুগের তুলনায় কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার বাড়ানো চলবে না। পৃথিবীর পরিবেশ-সমুদ্র ব্যবস্থা অনেকটা বাথটাবের মতো হয়ে গেছে, যেটি ক্রমাগত কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্য গ্রিনহাউস গ্যাসে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এর মাত্রা যত বেশি হবে, ততই তার তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে।
বাথটাবটা একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে চলে গেলে যদি উষ্ণতার একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তাহলে এই নিঃসরণের ট্যাপটা বন্ধ করতে হবে। যেমন ধরুন ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বিজ্ঞানীরা প্রায় সবাই এ ব্যাপারে একমত যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার এর ওপরে চলে গেলে পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নেবে।
মানবসভ্যতা যে তার সঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারবে, সেটা নিশ্চিত নয়। তা না হলে বায়ুমণ্ডলীয় বাথটাব ক্রমাগত ভরতে থাকবে, ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ৩, ৪ বা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে, যতক্ষণ না নিঃসরণ বন্ধ হয়, অথবা মানবজাতি ধ্বংস হয়। আমরা যত তাড়াতাড়ি এই ট্যাপ বন্ধ করব, তত কম তাপমাত্রায় জলবায়ু স্থিতিশীল হবে, ঝুঁকির পরিমাণও তত কম হবে। আর উষ্ণ পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের অভিযোজিত হওয়ার খরচও তত কম হবে।
বায়ুমণ্ডলে আমরা যত কার্বন ডাই-অক্সাইড ছাড়ি, তার অর্ধেকটা শুধু সেখানে থাকে, বাকিটা সমুদ্র ও জীবমণ্ডলে পুনঃ সঞ্চালিত হয়। কিন্তু সমুদ্র যত দ্রুত অভিসিঞ্চিত হচ্ছে এবং যত তার শোষণক্ষমতা কমছে, ততই এই পুনঃ সঞ্চালনের হার কমছে। একইভাবে তাপমাত্রা বাড়লে মাটির কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হারও বাড়ে, এতে পৃথিবীর তাপমাত্রা আরও বাড়ে।
বায়ুমণ্ডল থেকে এই কার্বন ডাই-অক্সাইড দূর করার একমাত্র উপায় হচ্ছে আক্ষরিকভাবে এটা বের করে দেওয়া। প্রাকৃতিকভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড ফসিলে পরিণত হয়, কিন্তু সেটার গতি এত কম যে তাতে কিছু আসে যায় না। কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ (সিসিএস) প্রযুক্তি কয়লা ও গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র থেকে নিঃসরিত গ্যাসের মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইড সরিয়ে নেয়, এরপর সেটাকে মাটির নিচে সংরক্ষণ করে। এই প্রযুক্তি বায়ুমণ্ডলে বিদ্যমান কার্বন ডাই-অক্সাইড কমাতে না পারলেও তা কয়লা ও গ্যাস থেকে নিঃসরিত কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা কমিয়ে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পারে। কিন্তু এটা খুবই ব্যয়বহুল ব্যাপার, আর বৃহৎ পরিসরে সেটা ব্যবহারের চেষ্টাও খুব ধীরগতিতে চলছে।
ভালো খবর হচ্ছে, আমরা যদি এখনই কোনোভাবে নিঃসরণ কমাতে পারি, তারপরও তাপমাত্রা একটা স্থিতিশীল জায়গায় পৌঁছার আগে আগামী কয়েক দশক ধরে তা বাড়তে থাকবে। কিন্তু নিঃসরণ এখনো বেশি থাকায় এই বায়ুমণ্ডলে আমাদের বসবাসের জায়গা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে এই ‘কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ’ প্রযুক্তি আপেক্ষিকভাবে এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আমরা যদি বিদ্যমান পথে চলতে থাকি, তাহলে সেটাকে যে পরিসরে কাজে লাগাতে হবে, তা চিন্তা করাও মারাত্মক ব্যাপার। অর্থাৎ আমরা এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছি। বাথটাবের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার প্যারিসে নির্ধারিত ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে চলে যাওয়ার আগেই কি আমরা নিঃসরণের ট্যাপটা ঘুরিয়ে তা প্রাক শিল্প যুগের পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারব? বস্তুত, এই ২ ডিগ্রিও যথেষ্ট নয়। প্যারিস সম্মেলনে এটা স্বীকার করা হয়েছে যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে চলে গেলে অভিযোজনের ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জন্য। বিজ্ঞানীরাও এটা মনে করেন।
ভালো খবর হচ্ছে, আমরা যদি এখনই কোনোভাবে নিঃসরণ কমাতে পারি, তারপরও তাপমাত্রা একটা স্থিতিশীল জায়গায় পৌঁছার আগে আগামী কয়েক দশক ধরে তা বাড়তে থাকবে। কিন্তু নিঃসরণ এখনো বেশি থাকায় এই বায়ুমণ্ডলে আমাদের বসবাসের জায়গা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করার আগে আমরা ঐতিহাসিকভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের সীমার অর্ধেকের কম নিঃসরণ করে ফেলতে পারি। এখন আমরা যেভাবে চলছি, তাতে ২০৪০-৫০ সালের মধ্যে সেই পর্যায়ে চলে যাব।
সে কারণে অধিকাংশ বিজ্ঞানী ও ক্রমবর্ধমান সংখ্যক ব্যবসায়ী নেতারা দ্ব্যর্থহীন লক্ষ্য নির্ধারণের আহ্বান জানাচ্ছেন, সেটা হলো, তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি বাড়ার আগেই নিঃসরণের হার প্রাক শিল্প যুগের পর্যায়ে রাখতে হবে। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক চেম্বার অব কমার্স ও বিশ্বের বিভিন্ন করপোরেশনের প্রধান নির্বাহীরা ঠিক এই লক্ষ্যই নির্ধারণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্যারিসে বিনিয়োগকারী, ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর ও ব্লুমবার্গের সিইও মাইকেল ব্লুমবার্গ একই সুরে কথা বলেছেন, কারণ হিসেবে তাঁরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা ক্রমপরম্পরায় ঝুঁকির মুখে পড়বে। এই লক্ষ্যের সুস্পষ্ট বার্তা হচ্ছে, কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণকারী শিল্পকে ব্যবসা বদলাতে হবে, অথবা তাদের ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। আর আমাদের ভবিষ্যৎ নিহিত রয়েছে কার্বন নিঃসরণহীন প্রযুক্তি ও ব্যবসার ওপর।
প্যারিসে আলোচনাকারীরা এই নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যটা পরিত্যাগ করলেও প্রতিটি দেশকে তার নিজ নিজ পরিকল্পনার মধ্যে এটা রাখতে হবে, যেটা আবার জি-২০ কে গ্রহণ করতে হবে, আর পরিণামে জাতিসংঘের চুক্তিতে তা যুক্ত করতে হবে। পৃথিবী নামক গ্রহের জন্য ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে হয় নিঃসরণ বৃদ্ধির হার প্রাক শিল্প যুগের সাপেক্ষ শূন্যের কোঠায় আনতে হবে, অথবা ধ্বংস হতে হবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
এরিক বেইনহকার: ইনস্টিটিউট ফর নিউ ইকোনমিক থিঙ্কিং, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।
মাইলস অ্যালেন: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জিও সিস্টেম সায়েন্সের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.