‘তাহলেই আইএসকে পরাজিত করা সম্ভব'

সিরিয়ায় রুশ হস্তক্ষেপ ওই অঞ্চলের পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। খুব সহজেই ইরাক ও সিরিয়ায় সক্রিয়, সুন্নিপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়াকে (আইএসআইএস) পরাজিত সম্ভব হবে না। বিষয়টি বেশ কঠিন এবং এ সঙ্ঘাতের রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করাও অসম্ভব। কেন? রাশিয়া ডিরেক্টের সাথে এক সাক্ষাৎকারে এ সব প্রশ্নেরই খোলামেলা জবাব দিয়েছেন জর্জি মিরস্কাই
মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমেই বেড়ে চলা উত্তেজনার মধ্যেই সিরিয়ায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে কথা বলতে রাশিয়া ডিরেক্ট বসেছিল ভালদাই ক্লাবের এক সদস্য, অধ্যাপক এবং ইনস্টিটিউট অব ওয়ার্ল্ড ইকোনমি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনার রিলেশনস’র প্রধান গবেষক মিরস্কাই-এর সঙ্গে। এ সাক্ষাৎকারে রাশিয়া কী করে এ অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করল, আইএসআইএসকে পরাজিত করা কেন প্রায় অসম্ভব এবং সিরিয়ার রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের ইতি টানতে কী কী প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে, তিনি তা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
রাশিয়া ডিরেক্ট : সিরিয়ায় রাশিয়ার এই ভয়ঙ্কর ও ধারণাতীত হস্তক্ষেপের কারণ কী?
জর্জি মিরস্কাই : ধারণাতীত বলছেন কেন? একটি পর্যায় পর্যন্ত সবই অনুমান করা সম্ভব। তবে একটি বিষয়ে আমাদের ভুল হচ্ছে; আমরা ভাবছি আমাদের বিমান হামলার কারণে সিরিয়ার সেনাবাহিনী লাগাতার আক্রমণ করতে শুরু করবে (বিরোধী এবং আইএসআইএসের বিরুদ্ধে)। প্রেসিডেন্ট পুতিন ঘোষণা দিয়েছেন, সিরিয়ার সেনাবাহিনীর আক্রমণে যেতে যত দিন প্রয়োজন তত দিন আমাদের বিমান হামলা চলবে।
তবে গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাশিয়া বিমান হামলা শুরু করার পরও এগিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছে সিরীয় সেনাবাহিনী। অদ্ভুত এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কত দিন পর্যন্ত ওখানে বোমা হামলা চালানো সম্ভব? এখন সিরিয়ায় বোমা হামলা চালিয়ে যাওয়া অর্থহীন। সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু সিরীয় সেনাবাহিনী (রুশ সেনাবাহিনীর সমর্থন এবং বিরোধীদের ওপর বিমান হামলা সত্ত্বেও) পরিস্থিতিতে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। কেন? এর মানে কি, আমরা বোমা হামলা বন্ধ করব? সিরিয়া অভিযানের ফলাফল কী হতে পারে তার হিসাব করার ক্ষেত্রে রাশিয়া ব্যর্থ হয়েছিল বলেই মনে হচ্ছে।
এখানে অস্বস্তিকরভাবে আরেকটি প্রশ্নও চলে আসে। রাশিয়ার এই অভিযান শুরু করার কারণ কী? বলা হচ্ছে, মিসরে আমাদের যাত্রীবাহী বিমানের করুণ পরিণতি এবং তুরস্কের রুশ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার জবাব দিতেই এই হামলা শুরু করা হয়েছে। কাজেই এখন ক্রেমলিনের পক্ষে সিরিয়ায় বিমান হামলা বন্ধ করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ সিরিয়া অভিযানের পরিণতি অনুমানে ব্যর্থ হয়েছে রাশিয়া। এর অর্থ কি এই যে, এ হামলা চলতেই থাকবে? কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সেটাই বা কতটুকু সম্ভব?
আকাশ থেকে বোমা ফেলা খুব সহজ, তবে ভূমিতে পা ফেলার কথা কেউ কি ভাবছে? এ বিষয়টি নিয়ে কারো আগ্রহ নেই। রুশ নেতৃত্ব বহুবার বলেছে, সিরিয়ায় স্থলসেনা মোতায়েন করা হবে না। কাজেই সিরিয়ার সেনাবাহিনী পরাস্ত হচ্ছে এবং এ নিয়ে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। না সৌদি আরব, না জর্ডান, না আর কারো।
আইএসকে সামরিকভাবে পরাজিত করা যেতে পারে। যদি ওবামা ইরাকে দুই লাখ সেনা পাঠান আর পুতিন দুই লাখ সেনা পাঠান সিরিয়ায়, তাহলেই আইএসআইএসকে পরাজিত করা সম্ভব। কারণ এরা অদৃশ্য কোনো সেনাবাহিনী নয়। কিন্তু কোনো দেশই স্থলসেনা পাঠাবে না। কাজেই সব দরজা এখানে এসে বন্ধ হয়ে যায়।
রাশিয়া ডিরেক্ট : অনেকেই বিশ্বাস করেন, ভিয়েনা আলোচনার মাধ্যমে সিরিয়ায় রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছা সম্ভব। আপনার দৃষ্টিতে এই সংঘর্ষের কূটনৈতিক সমাধানের পথে প্রতিবন্ধকতা কী কী?
জর্জি মিরস্কাই : এমন কোনো সুযোগই নেই। একটি বিষয় স্পষ্ট, রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ‘প্রথম শক্তি’ (সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সেনাবাহিনী) এবং তৃতীয় শক্তিকে (বিরোধী এবং ফ্রি সিরিয়ান আর্মি) সমঝোতায় আসতে হবে। তাদের ‘দ্বিতীয় শক্তি’কে (আইএস এবং জাবহাত আল-নুসরা) হারানোর জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। শুধু সে ক্ষেত্রেই রুশ বিমান হামলার সহযোগিতা নিয়ে তারা আইএসকে পরাজিত করতে পারবে। কিন্তু কখনোই তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে না। এ কারণেই এই সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব- এমন বিশ্বাসের কোনো কারণ নেই।
রাশিয়া ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, আসাদের প্রতি তারা কখনোই সমর্থন প্রত্যাহার করবে না। আমরা ফ্রান্সকেও এ ক্ষেত্রে রাজি করাতে পারি (ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ রাজি হওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছেন), যুক্তরাষ্ট্রও হয়তো সমঝোতা করতে গররাজি হবে না। তবে তুরস্ক, সৌদি আরব ও কাতারকে রাজি করানো কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
একেবারে অবাস্তবভাবে আপনি যদি ভাবতে চেষ্টাও করেন যে, তারা শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে, তাহলেও তাদের কী করে সামলাবেন যারা গত চার বছর ধরে লড়াই করে রক্ত ঝরাচ্ছে? প্রতিনিয়তই এরা বন্ধু আর স্বজনদের কবরস্থ করে যাচ্ছে। তারা কখনোই আসাদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হবে না। কখনোই না।
রাশিয়া ডিরেক্ট : অনেকেই মনে করেন, সিরিয়ায় রাশিয়ার সরাসরি হস্তক্ষেপ পরিস্থিতিতে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। হস্তক্ষেপের আগেই পুরো বিষয়টি প্রচণ্ড অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছিল। আপনি কি এর সঙ্গে একমত?
জর্জি মিরস্কাই : পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে গেছে। কারণ দীর্ঘ দিন থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল, শিগগিরই বা দেরিতে হলেও সিরীয় সেনাবাহিনী পরাজিত হবে। এখন অবধারিতভাবেই তেমন কিছু আর ঘটবে না। আসাদকে রক্ষা করা পুতিনের মান রক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরেকটি বিষয়ও আছে; বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে আইএসআইএসকে পরাজিত করতে চায়। তবে আজকের পরিস্থিতিতে এটা স্পষ্ট যে, তেমন কিছু আর সম্ভব নয়।
অন্য দিকে আইএসআইএসকে দেখুন। সবাই একে ঘৃণা করে আবার ভয়ও পায়। বাস্তবে কেউ তাদের সঙ্গে লড়াই করছে না। লড়াইয়ের ভান করছে মাত্র। এদের মধ্যে ইরান, সৌদি আরব এবং অন্যরাও রয়েছে। আসাদও সেই একই ভান ধরে আছেন, যেন তিনি আইএসআইএসের সঙ্গে লড়ছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিনি ‘তৃতীয় শক্তি’ অর্থাৎ ফ্রি সিরিয়ান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। ইরাকের অবস্থাও অনুরূপ। তাদের দাবি, আইএসআইএসের বিরুদ্ধে লড়ছে তারা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইরাকিরা নিজেদের এবং বাগদাদকে রক্ষা করে চলেছে; ঠিক যেমনটি কুর্দিরা নিজ ভূখণ্ড রক্ষা করার জন্য লড়ে যাচ্ছে।
পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র আইএসআইএসের বিরুদ্ধে লড়ে চলেছে বলে জানিয়ে আসছে বহু দিন থেকেই। কিন্তু সত্যিটা হলো, খুব বেছে বেছে বোমা ফেলছে তারা যাতে করে হতাহতের সংখ্যা বেশি না হয়। সিরীয়দের মৃত্যুর জন্য ওবামাই দায়ী- এমন একটি অভিযোগ থেকে প্রেসিডেন্টকে বাঁচাতে চাইছে তারা। দেখুন, এখানে সবাই কিন্তু দাবিই করছে। কারণ সবারই নিজ নিজ দ্বিগুণ, তিন গুণ কর্মসূচি আছে, স্বার্থ আছে।
রাশিয়া ডিরেক্ট : এমন অভিযোগও রয়েছে যে, আমরা আইএসআইএসের সম্ভাবনাকে অতিরঞ্জিত করছি। কারো কারো যুক্তি হলো, এটি একটি প্রকল্প মাত্র, একটি রাষ্ট্র সৃষ্টির চেষ্টা- যার কোনো দীর্ঘমেয়াদি দর্শন নেই।
জর্জি মিরস্কাই : এটি আসলেই একটি রাষ্ট্র। প্রয়োজনীয় সব মন্ত্রণালয়, সব সংস্থা, প্রশাসন ও প্রচারণা- সবই তাদের আছে। এর সশস্ত্র বাহিনী আছে। তবে যুদ্ধবিমান ও ট্যাংকের ঘাটতি রয়েছে। তার পরও একটি রাষ্ট্রের যা যা প্রয়োজন তার প্রায় সবই তাদের আছে।
রাশিয়া ডিরেক্ট : আইএসআইএসবিরোধী জোটকে কি হিটলারবিরোধী জোটের সঙ্গে তুলনা করা যায়? গেলে কতটা?
জর্জি মিরস্কাই : হিটলার সত্যিকার অর্থেই পুরো বিশ্বের জন্য হুমকি ছিলেন। সবাই বিষয়টি বুঝত। সবাই বুঝত যে, শুধু ঐক্যবদ্ধ শক্তিই তাকে ধরাশায়ী করতে পারবে। অন্যথায় পুরো বিষয়টিই একটি দুঃস্বপ্নে পরিণত হতো। সভ্যতা ধ্বংস হতো। আইএসআইএসের ক্ষেত্রে এটা স্পষ্ট যে, তারা ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র বা চীনকেও মোকাবেলা করতে পারবে না। এর ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। হিটলারবিরোধী শক্তির সাথে আইএসআইএসবিরোধী জোটের তুলনা করার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।
রাশিয়া ডিরেক্ট : তা হলে এই তুলনা আপনার কাছে বাগাড়ম্বর মনে হচ্ছে?
জর্জি মিরস্কাই : না। তা হবে কেন? বিষয়টি হলো, তুলনা করা মানুষের স্বভাব। মানুষ সাদৃশ্যও খোঁজে। কারণ এগুলো মানুষকে বুঝতে সহায়তা করে। সাদৃশ্য পেলেই বিষয়টি তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।
রাশিয়া ডিরেক্ট : আমরা সাদৃশ্যগুলোই খুঁজে ফিরি। যখন রাশিয়া সিরিয়ায় বোমা ফেলতে শুরু করল, তখন এর সাথে তুলনা শুরু হলো ১৯৭৯ সালে রাশিয়ার আফগানিস্তান অভিযানের। গণমাধ্যম এ নিয়ে প্রচুর কথা বলেছে।
জর্জি মিরস্কাই : আমি সাদৃশ্যের ভক্ত নই। কারণ আনাড়ি লোকেরা এসব খুঁজে ফেরে। গভীরভাবে বোধ তৈরি হওয়া কিংবা ইতিহাস, সমাজ, ধর্ম বোঝার আগেই পুরো বিষয়টিকে তারা খুব সহজ করে ফেলে। তাদের বিশ্বাস, সাদৃশ্য খুঁজে পেলেই সবকিছু খুব সহজেই ব্যাখ্যা করে ফেলবে তারা।
রাশিয়া ডিরেক্ট : আপনি কি মনে করেন ১৩ নভেম্বর প্যারিস হামলা এবং মিসরে রুশ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের ঐক্যবদ্ধ করতে ভূমিকা রাখতে পারে?
জর্জি মিরস্কাই : কোনোভাবেই না। পশ্চিমারা খুব ভালো করেই বোঝে, পুতিন সিরিয়ায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যাননি। বরং আসাদকে রক্ষা করতে গিয়েছেন। আর পশ্চিমারা আসাদকে উৎখাত করতে চায়। কাজেই এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে জোট হওয়ার প্রশ্ন অবান্তর।
রাশিয়া ডিরেক্ট : তাহলে কূটনীতিক ও রাজনীতিকদের জন্য কোন সমাধানের পথ বা উপদেশ দিতে চান আপনি?
জর্জি মিরস্কাই: সমাধানের কোনো পথ নেই, কোনো উপদেশও নেই। এ বিষয়ে কথা বলাই অর্থহীন। কারণ বিবেচনাবোধ আছে এমন লোকদেরই আপনি উপদেশ দিতে পারেন। যারা নিজের নাকের ডগার চেয়েও সামনে দেখতে পারেন, যারা নিজ দেশ, দল, কংগ্রেস, নিজের মেয়াদ, শ্রোতা- সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেন বিশ্ব মানবতার মূল্যবোধ ও স্বার্থকে- শুধু এ ধরনের লোকই আপনার উপদেশ শুনবে। কিন্তু (রাজনীতির) বিশ্বে এমন কোনো মানুষ নেই। কাজেই (রাজনীতিবিদদের) কোনো বিষয় নিয়েই কোনো উপদেশ দেয়ার কোনো মানে হয় না।
১.ভালদাই ক্লাব : ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ ক্লাব বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য রাশিয়া এবং পুরো বিশ্বে পরিচিত ও প্রশংসিত। বিশ্বের ৬২টি দেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নয় শতাধিক শিক্ষাবিদ ও গবেষক এই সংগঠনের সদস্য।
অনুবাদ : তানজিলা কাওকাব

No comments

Powered by Blogger.