বেতন কাঠামো চূড়ান্ত by মিজান চৌধুরী ও উবায়দুল্লাহ বাদল

সর্বোচ্চ বেতন ৭৫ হাজার টাকা ও সর্বনিম্ন ৮ হাজার ২৫০ টাকা নির্ধারণ করে ২০টি গ্রেডে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অষ্টম পে-স্কেল চূড়ান্ত করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ ও মুখ্য সচিবের বেতন ধরা হয়েছে ৯০ হাজার টাকা (নির্ধারিত) এবং সিনিয়র সচিবের বেতন ৮৪ হাজার টাকা (নির্ধারিত)। তবে নতুন বেতন কাঠামোতে বাদ দেয়া হয়েছে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল। এই বেতন ১ জুলাই থেকে দুই ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে।
বুধবার অষ্টম জাতীয় বেতন কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা করতে গঠিত সচিব কমিটি তাদের প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে জমা দিয়েছে। নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নে বর্তমান বরাদ্দের চেয়ে অতিরিক্ত ১৩ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে বলে পর্যালোচনা কমিটি সূত্র জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সচিব কমিটির প্রতিবেদনটি আমি পর্যালোচনা করে দেখব এবং সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করব। বাজেট নিয়ে ব্যস্ততার কারণে ৪ জুনের আগে এটা নিয়ে কিছু করা সম্ভব হবে না। পে-স্কেল ঘোষণা করতে জুলাই-আগস্ট মাস লেগে যেতে পারে। তবে যখনই এটা ঘোষণা করা হোক না কেন পহেলা জুলাই থেকে এটা কার্যকর হবে।’
এতে নিত্যপণ্যের বাজারে কতটা প্রভাব পড়বে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটার কোনো ইমপ্যাক্ট হয় না।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘প্রত্যেকেরই বেতন বাড়ানো উচিত। প্রতি বছর অটোমেটিক্যালি হওয়া উচিত। প্রতিবেদনে এটি সুপারিশ করা হয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত বেতন কমিশন গত ২১ ডিসেম্বও যে প্রতিবেদন দিয়েছিল তাতে ১৬টি গ্রেডে বেতন কাঠামো প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে পাঁচ সদস্যের সচিব কমিটির সুপারিশে আগের মতো ২০টি গ্রেড রাখার পক্ষে মত দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে ২০টি ধাপই রয়েছে। আমার যেটা মনে হয়, এটাকে আর টাচ করা উচিত হবে না।’
পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশ : পে-স্কেল পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের বেতন ৯০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। জাতীয় বেতন কমিশনের সুপারিশ ছিল এক লাখ টাকা। আর সিনিয়র সচিবের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৪ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে কমিশনের সুপারিশ ছিল ৮৮ হাজার টাকা।
পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, গ্রেড-এক সচিবের বেতন ৭৫ হাজার টাকা, গ্রেড-দুই ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা, গ্রেড-তিন ৫৬ হাজার ৫০০ টাকা, গ্রেড-চার ৫০ হাজার টাকা, গ্রেড-পাঁচ ৪৩ হাজার টাকা, গ্রেড-ছয় ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা, গ্রেড-সাত ২৯ হাজার টাকা, গ্রেড-আট ২৩ হাজার টাকা, গ্রেড-নয় ২২ হাজার টাকা, গ্রেড-দশ ১৬ হাজার টাকা, গ্রেড-এগার ১২ হাজার ৫০০ টাকা, গ্রেড-বারো ১১ হাজার ৩০০ টাকা, গ্রেড-তের ১১ হাজার টাকা, গ্রেড-চৌদ্দ ১০ হাজার ২০০ টাকা, গ্রেড-পনেরো ৯ হাজার ৭০০ টাকা, গ্রেড-ষোল ৯ হাজার ৩০০ টাকা, গ্রেড-সতেরো ৯ হাজার টাকা, গ্রেড-আঠারো ৮ হাজার ৮০০ টাকা, গ্রেড-উনিশ ৮ হাজার ৫০০ এবং গ্রেড-বিশ (সর্বনিু) ৮ হাজার ২৫০ টাকা। কমিশন সর্বনিু বেতন ৮ হাজার ২০০ টাকা করার প্রস্তাব করেছিল। এক্ষেত্রে পে-স্কেল পর্যালোচনা কমিটি আরও ৫০ টাকা বাড়িয়েছে।
কমিশনের সুপারিশ : অষ্টম জাতীয় কমিশন ২০ গ্রেডের বিপরীতে ১৬টি গ্রেডের সুপারিশ করেছিল। এক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদ ও মুখ্য সচিবের বেতন এক লাখ টাকা, সিনিয়র সচিবের বেতন ৮৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করার সুপারিশ করেছিল। এছাড়া গ্রেড-এক ৮০ হাজার টাকা, গ্রেড-দুই- ৭০ হাজার টাকা, গ্রেড-তিন ৬০ হাজার টাকা, গ্রেড-চার ৫২ হাজার টাকা, গ্রেড-পাঁচ ৪৫ হাজার টাকা, গ্রেড-ছয় ৩৭ হাজার টাকা, গ্রেড-সাত ৩২ হাজার টাকা, গ্রেড-আট ও নয় মিলে গ্রেড-আট ২৫ হাজার টাকা, গ্রেড-নয় ১৭ হাজার টাকা, গ্রেড-দশ ১৩ হাজার টাকা, গ্রেড-১১ ও ১২ মিলে গ্রেড-এগারোতে ১১ হাজার ৫০০ টাকা, গ্রেড-বারো ১০ হাজার ৫০০ টাকা, গ্রেড-তেরোতে ১০ হাজার টাকা, গ্রেড-চৌদ্দ ৯ হাজার ৫০০ টাকা, গ্রেড-১৫ ও ১৬ মিলে গ্রেড পনেরো ৯ হাজার টাকা এবং ১৬-২০ মিলে গ্রেড ষোল হচ্ছে ৮ হাজার ২০০ টাকা।
নতুন বেতন স্কেল প্রসঙ্গে পে-স্কেল পর্যালোচনা সংক্রান্ত সচিব কমিটির প্রধান ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বুধবার নিজ দফতরে যুগান্তরকে বলেন, কমিশনের সুপারিশ আমরা পর্যালোচনা করে তা অর্থমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়েছি। অর্থ মন্ত্রণালয় তা দেখে যত দ্রুত সম্ভব মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য পাঠাবে। সুপারিশে ২০টি ধাপ রাখা হয়েছে স্বীকার করলেও এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও বলেন, “কমিটির সুপারিশ কমিশনের সুপারিশ থেকে কম হবে এটাই স্বাভাবিক। অতীতেও তাই হয়েছে। কমিশনের রিপোর্ট দাখিলের পর বাজারের ওপর কোনো প্রভাব পড়েনি, তাই এ পর্যায়েও হওয়ার কোনো যুক্তি নাই।”
অষ্টম জাতীয় বেতন কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশ বহাল রেখেছে পে-স্কেল পর্যালোচনা সংক্রান্ত সচিব কমিটি। তবে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাদ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বলা হয় টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড নিয়ে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। ইতোমধ্যে আদালতে এ সংক্রান্ত মামলা হয়েছে একাধিক। ফলে কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এ দুটি সুবিধা বাদ দিয়েছে পর্যালোচনা কমিটি। প্রসঙ্গত, ১৯৮১ সালে ক্যাডার সার্ভিসে টাইম স্কেল চালু হলেও ১৯৮৩ সাল থেকে তা কার্যকর হয় নন ক্যাডার পদেও। সত্তর দশকে চালু হয়েছে সিলেকশন গ্রেড।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পর্যালোচনা কমিটির একজন সদস্য যুগান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী বেতন কাঠামোতে ১৬ ধাপের বিষয়ে একমত ছিলেন। কিন্তু ১৬ ধাপে নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করা খুবই জটিল হবে- এটি প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হলে তিনি বিষয়টি পর্যালোচনা কমিটিকেই চূড়ান্ত করার নির্দেশনা দেন। পর্যালোচনা কমিটি যে সুপারিশ দিয়েছে তা পরিবর্তন করার মতো কিছু নেই উল্লেখ করে কমিটি এ সদস্য আরও বলেন, আগামী মন্ত্রিসভার বৈঠকে নতুন বেতন কমিশন নাও উঠতে পারে। তবে জুনের আগেই বিষয়টির ফয়সালা করার নির্দেশনা রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২১ ডিসেম্বর প্রায় সাড়ে ১২ লাখ সরকারি চাকরিজীবীদের শতভাগ বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করে অষ্টম বেতন কমিশনের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রী কমিশনের রিপোর্ট পেয়ে ১ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটি টানা চার মাস ১২ দিন পর্যালোচনা করে এ সুপারিশ পেশ করেছে।

No comments

Powered by Blogger.