কারামুখী রাজনীতি by সাজেদুল হক

রাজনীতি-কূটনীতিতে কমা-সেমিক্লোনই চিরন্তন। পূর্ণচ্ছেদ বলে কিছু নেই। ভারতের  পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের বলা এ কথা হয়তো সারা দুনিয়াতেই সমান সত্য। যদিও এটা অস্বীকার করার যো নেই, ৫ই জানুয়ারির পরের বাংলাদেশ এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি। এতে কার দায় কতটা সে বিতর্ক আলাদা। তবে আট মাসের বেশি সময় ধরে স্থবির থাকার পর রাজনীতি নড়াচড়া শুরু করেছে। হতোদ্যম বিরোধী শক্তিকে নিঃশেষ করার আয়োজন চলছে জোরেশোরে। হরতাল ডেকে বাসায় সময় কাটানো নেতারা এতে বারুদের যোগান দিচ্ছেন ভালো মতোই।
গত কিছু দিনে বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে মামলার গতি বেড়েছে আকস্মিকভাবে। প্রতিদিনই কারও বিরুদ্ধে দেয়া হচ্ছে চার্জশিট। কারও বা শুরু হচ্ছে বিচার। বিরোধী জোটে ভাঙন তৈরির তৎপরতা এরই মধ্যে কিছুটা সফলতার মুখ দেখেছে। জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। একটি গোয়েন্দা সংস্থা এ নিয়ে দীর্ঘদিন থেকেই কাজ করে আসছে। সেনাবাহিনীর একজন সাবেক কর্মকর্তা যিনি বর্তমানে সরকারের উচ্চপর্যায়ে কর্মরত আছেন পুরো বিষয়টি সমন্বয় করছেন। হেফাজতে ইসলামকে বাগে আনার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিরোধী জোটে ভাঙন নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা প্রকাশ্যই উল্লাস প্রকাশ করেছেন। রোববারই আওয়ামী লীগ নেতা ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, বিএনপির অনেক নেতা রাতের আঁধারে আমাদের সঙ্গে দেখা করেন। শুধু ২০-দলীয় জোট নয়, শিগগিরই আপনারা দেখতে পাবেন বিএনপিতেও ভাঙন দেখা দেবে। জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ও রাজনীতিতে বিপুল চাঞ্চল্য তৈরি করেছে। গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান সরকার-জামায়াত সমঝোতার গুঞ্জনের পালে হাওয়া দিয়েছে। যদিও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পুরো বিষয়টিকে ‘রাবিশ’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। অন্য রকমের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে নিয়েও অবশ্য আলোচনা থেমে নেই। একই সঙ্গে সরকার এবং বিরোধী দলে থাকা পৃথিবীর বিরল এ রাজনৈতিক দল প্রতিদিনই কোন না কোন ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। তার কতটা বাস্তব আর কতটা নাটক তা বোঝা দায়। যেদিন রংপুরে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং মশিউর রহমান রাঙ্গার সমর্থকরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছেন সে একই দিনে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে তাদের দেখা গেল হাস্যমুখে। এরশাদের পা ছুঁয়ে সালামও করেন রাঙ্গা। এরশাদ যতদিন আছেন রাজনীতিতে নাটকীয়তার গ্যারান্টি ততদিন নিশ্চিতভাবেই আছে। রাজনীতির অন্দরমহলে যে মূহর্তে নড়াচড়া চলছে তখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, নির্বাচন কমিশনারসহ সাংবিধানিক পদবিধারীদের অপসারণের ক্ষমতা চলে গেছে সংসদের হাতে।  নানা মহলে প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করা হয়েছে। সম্প্রচার নীতিমালাও প্রণয়ন করেছে সরকার। আরও বেশ কিছু নীতিমালা প্রণয়নের কার্যক্রমও চলছে। এ পরিস্থিতিতে পর্যবেক্ষকরা স্মরণ করেছেন আন্তনিও গ্রামসিকে। তার তত্ত্ব অনুযায়ী যখন কোন দেশে ফ্যাসিজম চালু হয় তখন রাজনৈতিক দল বলে কিছু থাকে না। তখন গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা পালন করতে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে রাজনৈতিক দল ও গণমাধ্যম কেউই সে ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ২০১৯ সালের আগে কোন ধরনের নির্বাচনের সম্ভাবনা নাকচ করে এলেও কেউ কেউ এরই আগে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের ইঙ্গিত দিচ্ছেন। লন্ডনের দি ইকোনমিস্টও একই ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে সে নির্বাচন হবে ক্ষমতাসীনদের ছক অনুযায়ী এবং তাদের মেয়াদ বৃদ্ধি করার জন্যই। এক্ষেত্রে ইলেকট্রিক বডিজ ডিজকোয়ালিফিকেশনের আদলে ১৪০ বিরোধী রাজনীতিবিদকে নির্বাচনী রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করার একটি প্রক্রিয়া চলছে। একটি প্রভাবশালী সংস্থা এ নিয়ে কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। প্রাথমিকভাবে বিরোধী জোটের জনপ্রিয় রাজনীতিবিদদেরই টার্গেট করা হয়েছে। কি প্রক্রিয়ায় তাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হবে তা নিয়েও চিন্তাভাবনা চলছে। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের আগে এ ধরনের একটি নিষেধাজ্ঞার কারণে ১০০’র বেশি রাজনীতিবিদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। তাদের বেশির ভাগই ছিলেন বিএনপির। জরুরি আইনে দায়ের করা মামলায় শাস্তির কারণেই তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা সম্পর্কে বলা আছে। ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদে নির্বাচনে অযোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তি লাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে;’।
পশ্চিমা দুনিয়া বাংলাদেশে একটি নতুন ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে থাকলেও উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা প্রকাশের বাইরে তারা কিছু করবে এমন ইঙ্গিত স্পষ্ট নয়। রাশিয়া, চীন, জাপানসহ আন্তর্জাতিক শক্তির একটি বড় অংশ ব্যবসা-বাণিজ্যে আগ্রহী। নরেন্দ্র মোদির ভারত সরকার অনুসরণ করছে ধীরে চলার নীতি। দেশের ভেতরকার নাগরিক সমাজ গত দু’দশকের মধ্যে সবচেয়ে অসহায় অবস্থানে রয়েছে। কর্তৃত্ববাদী আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে তাদের নিদারুণ অসহায়তাই প্রকাশ পাচ্ছে। জামায়াত নেতাদের মধ্যে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে সবচেয়ে জনপ্রিয় মনে করা হয়। দলের বাইরেও তার এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তার আমৃত্যু কারাদণ্ডের প্রতিবাদে জামায়াতের দু’দিনের হরতালে তেমন কোন সাড়া মেলেনি। বিএনপি জোটের হরতালও ছিল ম্লান। যথারীতি বিরোধী জোটের নেতা-কর্মীদের রাজপথে দেখা মিলেনি। যে স্বল্পসংখ্যক কর্মী রাজপথে নামেন তাদের পুলিশের গুলির মুখোমুখি হতে হয়েছে। এরই মধ্যে ঢাকা আলিয়া মাদরাসার বিশেষ আদালতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। শনিবার আওয়ামী লীগের যৌথ সভায় খালেদা জিয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রয়োজনে উনাকেও জেলে পাঠানো হবে। জিয়া অরফানেজ এবং চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার দিকে দৃষ্টি রাখছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। এর আগে আইনি লড়াইয়ে খালেদা জিয়ার বাড়ি রক্ষা হয়নি। এবার আইনি লড়াইয়ে খালেদা জিয়া এবং বিএনপির শীর্ষ নেতারা কারাগার এড়াতে পারেন কিনা সে প্রশ্নই এখন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.