গাজায় যুদ্ধবিরতি শান্তির পথ সুগম করবে কি? by আলী রীয়াজ

গাজায় সীমিত সময়ের জন্য যুদ্ধবিরতিতে ইসরায়েল ও হামাস সম্মত হয়েছে—এই খবরে ইতিবাচক দিক অন্তত এইটুকু যে গাজার নিরীহ মানুষ কিছু সময়ের জন্য হলেও নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে। জাতিসংঘের উদ্যোগে করা এই ‘মানবিক যুদ্ধবিরতি’র সুযোগে গাজার মানুষেরা নিহত ব্যক্তিদের কবর দিতে পারবে বলে গণমাধ্যমের জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তার মন্তব্য থেকে মনে হতে পারে যেন গাজার মানুষ তাদের প্রিয়জনদের চিরনিদ্রায় শয়নের অধিকারও হারিয়েছে। এই যুদ্ধবিরতিতে দুই পক্ষের সম্মতির কারণে আমরা অনুমান করতে পারি যে আগের দফায় মিসরের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি কাজে না দিলেও এবার তা বাস্তবায়িত হবে। শুধু তা-ই নয়, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। এই আলোচনার বিষয়েও দুই পক্ষের মতৈক্য রয়েছে।

মিসরে অনুষ্ঠেয় আলোচনায় ফিলিস্তিনিদের মূল ও চূড়ান্ত দাবির সমাধান হবে—এমন কেউই আশা করেন না। কেননা, আলোচনার এজেন্ডাতেই তা নেই; এখনকার লক্ষ্য হলো চলমান যুদ্ধের সাময়িক অবসান। ২০১২ সালেও আমরা তা-ই দেখেছি। কিন্তু অন্য যেকোনোবারের সঙ্গে এবারের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো এই যে এবার হামাসকে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। কেননা, আগে এই ধরনের পরিস্থিতিতে মিসরের ক্ষমতাসীনেরা কেবল মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাই পালন করেননি, হামাসের প্রতি সহানুভূতিশীলও ছিলেন; ২০১২ সালের যুদ্ধের সময় ক্ষমতাসীন মুসলিম ব্রাদারহুড ও প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি চেয়েছিলেন যে এই আলোচনার মধ্য দিয়ে তাঁর সরকারের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হোক এবং হামাসের প্রতি বিশ্বের সহানুভূতি বৃদ্ধি পাক। কিন্তু এবার মিসরের ক্ষমতাসীন আবদেল ফাত্তাহ আল–সিসির সরকারের অবস্থান মোটেই তা নয়। এবারের গাজা হামলার সূচনা হাওয়ার পর যদিও মিসরের সরকার প্রত্যক্ষভাবে হামাসের বিরুদ্ধে কথা বলেনি; কিন্তু তাদের করা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের মূল বক্তব্য ইসরায়েলের প্রস্তাবের চেয়ে ভিন্ন ছিল না, যা থেকে এমন অনুমান করা ভুল হবে না যে তারা আলোচনায় মোটেই হামাসের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবে না।
তবে আলোচনায় ফিলিস্তিনিদের কে প্রতিনিধিত্ব করবে, সেটা হামাস একা নির্ধারণ করবে না। সেটা নির্ধারণ করবেন ঐক্য সরকারের প্রধান হিসেবে মাহমুদ আব্বাস। এই আলোচনায় মিসরের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রও থাকবে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ভাষ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র হামাসের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় যাবে না; ইসরায়েলিরাও হামাসের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করবে না। এসব কারণে হামাসের জন্য এই আলোচনা যে খুব বেশি অনুকূলে যাবে না, তা বোঝা যায়। ২৬ দিনের এই ইসরায়েলি অভিযানের ফলে সারা বিশ্বের জনমত যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেছে, তা বলাই বাহুল্য। বিমান হামলায় শিশুদের মৃত্যুর ঘটনা সবাইকে যেভাবে নাড়া দিয়েছে, তা দীর্ঘ মেয়াদে ইসরায়েলের জন্য যে ক্ষতি হয়েছে, ইসরায়েলের নীতিনির্ধারকেরা তা না বুঝলে বা না বুঝতে চাইলেও অন্যরা বুঝতে পারছেন। ফলে, হামাস যেমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আলোচনায় উপস্থিত হবে; তেমনি ইসরায়েলের জন্যও এই আলোচনা খুব অনুকূল পরিবেশে হচ্ছে তা নয়।
তবে প্রায় এক মাস ধরে চলা এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির একটা নতুন বিষয় স্পষ্ট হয়ে পড়েছে, আর তা হলো, এ যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সমর্থন না দিলেও এই অঞ্চলের অনেক দেশই পরোক্ষভাবে ইসরায়েলের এ অভিযানের বিষয়ে খুব বেশি অখুশি হয়নি। এই অঞ্চলের অনেক দেশ যে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় কম সরব হয়েছে, তাতেই এটা স্পষ্ট। আরব লীগ বা ওআইসি যে একটা কঠোর বিবৃতি পর্যন্ত দিতে এগিয়ে আসেনি, সেটা দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা নয়। সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি দেশের অবস্থান থেকে স্পষ্ট যে তারা হামাসের পক্ষে দাঁড়াতে অনিচ্ছুক; এমনকি যদি তার ফলে ইসরায়েল লাভবান হয়, তাতেও তাদের আপত্তি নেই। ইসরায়েল এই আঞ্চলিক অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে, না তার সুযোগ গ্রহণ করেছে, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে; কিন্তু যা বিতর্কের ঊর্ধ্বে, তা হলো গাজার যুদ্ধের একটা সাময়িক বিরতি যদি অর্জনও করা যায়, তাহলেও এই পরিস্থিতি বদলে যাবে তা নয়।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, মধ্যপ্রাচ্যে একদিকে ইরানকেন্দ্রিক বা ইরান-প্রভাবিত একটি বলয়—হামাস, হেজবুল্লাহ, ইরাক, সিরিয়াকে আমরা সেই বলয়ের সদস্য হিসেবে দেখতে পাই, যারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নেওয়া এবং প্রয়োজনে সংঘাত বহাল রাখাকে যথাযথ বলে মনে করে। সৌদি আরব, জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত তার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে এবং যতক্ষণ না পর্যন্ত গাজা ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ফাতাহ গোষ্ঠী ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব স্থাপিত হচ্ছে, ততক্ষণ এই সংকট সমাধানে তারা অংশ নেবে না বলেই মনে হচ্ছে। এই দেশগুলোর মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো দেশ নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয় না যে তার প্রভাববলয় বৃদ্ধি করতে চায়। তবে সৌদি আরবের শাসকেরা আশা করেন যে ইরানের শিয়া নেতৃত্বের বিপরীতে সুন্নিদের নেতৃত্ব তাঁদের হাতেই থাকবে। তাঁরা আঞ্চলিক সংগঠনগুলোকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হচ্ছে।
এই দুই অবস্থানের বাইরে কাতার ও তুরস্ক একধরনের অবস্থান নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কাতারের যে হামাসের প্রতি পক্ষপাত রয়েছে, সেটা সবার জানা। হামাসের নেতা খালিদ মিশাল কাতারে বাস করেন এবং মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় থাকার সময়ে কাতার আট বিলিয়ন ডলারের ঋণ ও অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। হামাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সত্ত্বেও কাতার যে ইরানের প্রভাববলয় বৃদ্ধিকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেবে না, সেটা অনুমেয়। কাতারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কারণেই সেটা সম্ভব নয়। লক্ষণীয় যে কয়েক দিন ধরেই কাতারে যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে হামাসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে পরোক্ষ যোগাযোগ হচ্ছিল, তার মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেয় কাতার। কাতারের সঙ্গে ছিল তুরস্ক। তুরস্ক লক্ষণীয়ভাবে গাজায় ইসরায়েলের হামলার নিন্দা করেছে এবং হামাসের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। কাতার ও তুরস্কের এই ভূমিকা মিসরের পছন্দ নয় এবং মিসরের সরকার মনে করে যে এই দুই দেশের ভূমিকা ইতিবাচক নয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে গত কয়েক দিনের আলোচনা এবং একটি সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি কেবল এই দুই দেশের মধ্যস্থতায় সম্ভব হয়েছে।
গাজার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে বিরাজমান শক্তি ভারসাম্যের প্রতিযোগিতা কেবল আরও স্পষ্টই হয়েছে তা নয়, তাতে নতুন উপাদানও যুক্ত হয়েছে। ফলে, ৭২ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি এবং তার পরে ২০১২ সালের আদলে আরেকটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি অর্জিত হলেও এই যে নতুন শক্তি ভারসাম্যের প্রতিযোগিতা, তা অপসৃত হয়ে যাবে না।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.